কোভিড-১৯ মোকাবিলায় চীনা ভ্যাকসিনের সাফল্য কি হারিয়ে যাচ্ছে?
টিকা নিয়ে সংরক্ষণবাদী মনোভাবের চূড়ান্ত করেছে উন্নত ও ধনী দেশগুলো। প্রতিষেধক উদ্ভাবক পশ্চিমা কোম্পানিগুলোও আগে ধনী দেশের চাহিদা পূরণ করতে থাকে। অন্যদিকে, সংক্রমণ বৃদ্ধি আর মৃত্যুর মিছিলের মধ্যেই টিকার ডোজ সংকটে ভুগেছে বাংলাদেশসহ অনেক স্বল্প আয়ের দেশ।
এ অবস্থায় নিজেদের আবিষ্কৃত টিকা নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়ায় চীন। অনেক দেশ চীনে আবিষ্কৃত প্রতিষেধকের মাধ্যমেই টিকাকরণ শুরু করে, আবার বাংলাদেশের মতো কিছু দেশে সহজে সরবরাহ থাকায় পরবর্তীকালে প্রধান ডোজ হয়ে উঠছে চীনের টিকা।
এভাবে এশিয়াজুড়ে লাখ লাখ মানুষকে কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষা দিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে চীনের ভ্যাকসিনগুলো। বেশিরভাগই পেয়েছেন সিনোভ্যাক অথবা সিনোফার্মের আবিষ্কৃত টিকা।
তবে এশিয়ায় নতুন করে কোভিড-১৯ সংক্রমণ তরঙ্গ দেখা দেওয়ায় এ টিকাগুলোর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এমনকি ইতঃপূর্বে চীনের টিকাকে নিজস্ব টিকাকরণ কর্মসূচির প্রধান ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা কয়েকটি এশীয় দেশ অন্যান্য টিকা ব্যবহারের কথা ঘোষণা করেছে।
এতে চীনা টিকার কার্যকারিতার পাশাপাশি এশীয় পরাশক্তিটির ভ্যাকসিন কূটনীতির প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন উঠছে।
থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার অবস্থা
গত সপ্তাহে নিজস্ব টিকাকরণ নীতি পরিবর্তনের ঘোষণা দেয় থাই কর্তৃপক্ষ। নতুন নীতির আওতায় এখন থেকে সিনোভ্যাকের দুই ডোজ টিকার বদলে এক ডোজ সিনোভ্যাক ও আরেক ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা মিশ্র পদ্ধতিতে দেওয়া হবে।
অন্যদিকে, সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসেবে যেসকল স্বাস্থ্যকর্মী ইতোমধ্যেই সিনোভ্যাকের দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন, তাদেরকে বুস্টার শট হিসেবে তৃতীয় আরেকটি কোম্পানির টিকা দেওয়া হবে।
তার আগের সপ্তাহে একই রকম সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ইন্দোনেশিয়া। সিনোভ্যাকের টিকা পাওয়া স্বাস্থ্যকর্মীদের মডার্নার তৈরি টিকার ডোজ বুস্টার শট হিসেবে দেওয়া শুরু করে দেশটি।
এর আগে সিনোভ্যাকের দুই ডোজ টিকা নিয়েও শত শত স্বাস্থ্যকর্মী কোভিড-১৯ আক্রান্ত হচ্ছেন, এমন খবর প্রকাশিত হয় দেশ দুটিতে। আক্রান্ত কর্মীদের মধ্যে দুজন থাই ও ৩০ জন ইন্দোনেশীয় স্বাস্থ্যকর্মী মারাও গেছেন। তারপরই মিশ্র ডোজের নীতি ঘোষণা করা হয়।
উভয় দেশেই বেশ দেরিতে টিকা কর্মসূচি শুরু হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ভাইরাসের নতুন ধরনের মারাত্মক প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে দেশ দুটিতে। থাইল্যান্ড এখন প্রায় প্রতিদিনই রেকর্ড সংখ্যক নতুন সংক্রমণ ও মৃত্যুর কথা জানাচ্ছে। অন্যদিকে, এশিয়ায় করোনা মহামারির নতুন কেন্দ্রবিন্দু ইন্দোনেশিয়ায় এখন চরম অক্সিজেন ও হাসপাতালের শয্যা সংকট দেখা যাচ্ছে।
এ অবস্থায় দেশ দুটির জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলেছেন, সুরক্ষা বা রোগ প্রতিরোধ বাড়ানোর অংশ হিসেবেই তারা মিশ্র টিকাদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। থাই কর্মকর্তারা স্থানীয় গবেষণার বরাত দিয়ে জানান, মিশ্র টিকায় রোগ প্রতিরোধ বাড়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সিনোভ্যাকের টিকা 'বেশ কার্যকর' সম্প্রতি বিবিসিকে এ কথা বলেছেন ইন্দোনেশিয়ার পর্যটনমন্ত্রী সান্দিয়াগা উনো। তবে কর্তৃপক্ষ মুখে যাই বলুন, 'টিকা বদলের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার সরকার চীনা টিকার ব্যর্থতা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে ওঠার বার্তা দিয়েছে' বলে মন্তব্য করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক প্রাদুর্ভাব সতর্কতা ও প্রতিক্রিয়া নেটওয়ার্কের প্রধান ডেল ফিশার।
তবে স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনায় পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি বলেও জানান তিনি। টিকার ব্যর্থতা নিয়ে দাবির আগে কর্তৃপক্ষের প্রতি পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আহ্বান জানান এ বিশেষজ্ঞ।
এসব ঘটনায় সিনোভ্যাক এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
তবে ইন্দোনেশিয়ার প্রতিবেশী মালয়েশিয়াও সিনোভ্যাকের বর্তমান চালান শেষ হওয়া মাত্র ফাইজারের টিকার মাধ্যমে টিকাদান শুরুর ঘোষণা দিয়েছে।
অবশ্য, ফিলিপাইন ও কম্বোডিয়ার মতো এশিয়ার কয়েকটি দেশ এখনো চীনা প্রতিষেধকের মাধ্যমেই টিকাদান চালিয়ে যাচ্ছে।
চীনা ভ্যাকসিনগুলো আসলেই কার্যকর?
বিশ্বজুড়ে পরিচালিত মানব ট্রায়ালে সিনোভ্যাক ও সিনোফার্মের নিষ্ক্রিয় ভাইরাস ভিত্তিক কোভিড-১৯ টিকাগুলো লক্ষণযুক্ত সংক্রমণ রোধে ৫০-৭৯ শতাংশ পর্যন্ত সফল বলে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়।
পশ্চিমা টিকাগুলোর তুলনায় কার্যকারিতা হারে পিছিয়ে থাকলেও চীনা প্রতিষেধকগুলো এখনও হাসপাতালে ভর্তির মতো গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যু হার কমাতে সাহায্য করে। এমনকি ব্রাজিলের একটি গবেষণায় সিনোভ্যাকের টিকা এক্ষেত্রে শতভাগ সফল হয়। ইন্দোনেশিয়ার স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে পরিচালিত আরেক গবেষণায় এটি ৯৬-৯৮ শতাংশ ফলপ্রসূ বলেও প্রমাণ মেলে।
হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বেঞ্জামিন কাউলিং বলেন, সম্পূর্ণরূপে টিকা পাওয়াদের মধ্যেও ভাইরাস সংক্রমণের পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করতে পারে। তার মধ্যে একটি হতে পারে, অন্য কিছু টিকার মতো হয়তো চীনা টিকাগুলোর কার্যকারিতাও সময়ের সাথে সাথে দুর্বল হতে থাকে। যেমন চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত থাইল্যান্ডের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ডোজ সিনোভ্যাক টিকা নেওয়ার ৪০ দিন পর থেকে অ্যান্টিবডির পরিমাণ কমতে থাকে।
আরেকটি কারণ, মানব ট্রায়ালের তুলনায় রিয়েল ওয়ার্ল্ড ইনফেকশন বা টিকা নেওয়ার পরও সংক্রমণ পর্যবেক্ষণের তথ্যাবলী যথেষ্ট পরিমাণে সংগ্রহ করা হয়নি। বিশেষ করে, দৈনিক হাজার হাজার নতুন সংক্রমণের কেন্দ্র ইন্দোনেশিয়ায় শেষোক্ত এ পর্যবেক্ষণের তথ্য অত্যন্ত কম।
ইন্দোনেশিয়ায় মোট সংক্রমিতের ৬০ শতাংশই এখন ডেল্টা ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত, আর থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে এই হার ২৬ শতাংশ। অতি-সংক্রমক এ ধরনটির প্রভাবেও টিকার সুরক্ষা দুর্বল হতে পারে।
এ ক্ষেত্রে বড় সমস্যা, নতুন ধরনগুলোর বিরুদ্ধে চীনা টিকাগুলোর কার্যকারিতা সম্পর্কে এখনো কোনো তথ্য প্রকাশিত হয়নি। তবে প্রফেসর কাউলিং জানান, প্রাথমিক কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাকের মতো নিষ্ক্রিয় ভাইরাস ভিত্তিক টিকাগুলো মূল সার্স কোভ-২ ভাইরাসের তুলনায় ডেল্টা ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে ২০ শতাংশ কম সুরক্ষা দেয়।
তিনি বলেন, 'কোভিড সংক্রমণ থেকে এপর্যন্ত আবিষ্কৃত কোনো টিকাই সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেয় না। চীনা টিকাগুলোও শতভাগ কার্যকারি না হলেও, তাদের কল্যাণে অনেক জীবন রক্ষা পাচ্ছে।'
অন্য বিশেষজ্ঞরাও টিকাদানে গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, টিকা নেওয়ার পরও সংক্রমণ হওয়া মানেই প্রতিশেধক অকার্যকর এমনটা নয়; কারণ এটি মানুষের গুরুতর অসুস্থতা রোধে সাহায্য করে, আবার ভাইরাসের বিস্তারও কমে।
টিকা নিয়ে কারও আক্রান্ত হওয়াকে বিজ্ঞানীরা বলেন- ব্রেক থ্রু কেস। চীনে এপর্যন্ত মোট ৬৩ কোটি মানুষ টিকার অন্তত এক ডোজ করে পেয়েছেন এবং সেখানে এপর্যন্ত কোনো ব্রেক থ্রু কেসের কথা জানা যায়নি।
একইসঙ্গে এটাও সত্য, চীন সরকার সংক্রমণ রোধে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। ভাইরাসের নতুন সংক্রমণও নিয়ন্ত্রণের রাখায় দৈনিক সংক্রমিতের সংখ্যা রয়েছে নিম্ন পর্যায়ে। কোভিড-১৯ ঠেকাতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে দেশটির স্থানীয় প্রশাসনও, ফলে কোনো অঞ্চলে প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়া মাত্র তা নিয়ন্ত্রণে দ্রুত ও কঠোর পক্ষেপেও নেওয়া হচ্ছে।
চীনের ভ্যাকসিন কূটনীতি কীভাবে প্রভাবিত হয়েছে?
চীন সবচেয়ে বেশি কোভিড-১৯ টিকা বিক্রি ও অনুদান দিয়েছে এশিয়ায়। তাই এ অঞ্চলই হয়ে উঠেছে দেশটির ভ্যাকসিন কূটনীতির চাবিকাঠি।
এ পর্যন্ত এশিয়ার ৩০টি দেশ চীন থেকে টিকা কিনেছে অথবা অনুদান পেয়েছে। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ইন্দোনেশিয়া সিনোভ্যাকের সাড়ে ১২ কোটি ডোজ অর্ডার করেছে।
তাছাড়া, 'উহানের ল্যাব থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে- পশ্চিমা বিশ্ব ও তার মিত্রদের এমন প্রচারণা ও দাবিও ঠেকাতে সচেষ্ট ছিল চীন। এজন্য স্বপ্রণোদিতভাবে লাখ লাখ ডোজ অনুদান পাঠানো হয় বিভিন্ন দেশে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে চীন বৈজ্ঞানিক গবেষণার নতুন শক্তিকেন্দ্র হিসেবেও নিজেকে তুলে ধরার সুযোগ পায়,' বলে মন্তব্য করেন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের চীন গবেষক ইয়ান চং।
তার মতে, ধনী দেশগুলো প্রথম দিকে টিকার সরবরাহকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করায় এশিয়ার অনেক দরিদ্র দেশ চীনের ভ্যাকসিন সহায়তাকে স্বাগত জানায়।
'ওই সময়ে সকল দেশের কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করেছিল, কোনো সুরক্ষা না থাকার চাইতে কিছুটা সুরক্ষা থাকাই শ্রেয়। তাই কার্যকারিতার হার উচ্চ মানের না হলেও তারা চীনা টিকা দিয়ে টিকাকরণ শুরু করে।'
স্থানীয়ভাবে টিকা উৎপাদনেও ছিল সমস্যা। যেমন থাইল্যান্ডের রাজার মালিকানাধীন কোম্পানি আস্ট্রাজেনেকা আবিষ্কৃত টিকা উৎপাদন করছে, যা দেশের অধিকাংশ চাহিদা মেটাবে বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু উৎপাদনের গতি দুর্বল হওয়ায় থাই সরকারকে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ের মুখাপেক্ষী হতে হয়।
তবে সম্প্রতি থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার অন্য দেশের টিকা নির্বাচন করা চীনা টিকার প্রাথমিক সফলতার সুনাম ক্ষুণ্ণ করবে। বেইজিংয়ের টিকার সুরক্ষা ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির দাবিকেও এটি প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলে মনে করেন ড. চং।
-
সূত্র: বিবিসি