প্রতিদিনই রেকর্ড ভাঙছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা
দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রতিদিনিই ভাঙছে আক্রান্তের রেকর্ড। জুন মাসের তুলনার এ মাসের প্রথম ২৪ দিনে ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধি পেয়েছে চার গুণেরও বেশি। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর প্রায় ৯৯ শতাংশই রাজধানীর আর এদের মধ্যে অধিকাংশ রোগীই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের।
দেশে করোনাভাইরাস মহামারিতে বিপর্যস্ত জনজীবনে নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু। হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি শিশুর সংখ্যাও বাড়ছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন এ বছর ডেঙ্গু হঠাত করেই আতঙ্কের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। যদি সম্মিলিতভাবে নিয়ন্ত্রণে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া না হয় তবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১০৪ জন রোগী, যা এ বছর এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত।
এ বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ১৫৭৪ জন। এদের মধ্যে জুলাই মাসের ২৪ দিনেই আক্রান্ত হয়েছে ১২০২ জন।
বর্তমানে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন ৪২২ জন রোগীর মধ্যে ৪১৯ জনই ঢাকার। বাকি ৩ জনের ২ জন ঢাকা বিভাগের এবং একজন ময়মনসিংহ বিভাগের।
ঢাকাতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রোগী ভর্তি রয়েছেন আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি আছেন ৬১ জন ডেঙ্গু রোগী।
এছাড়া ঢাকায় উল্লেখযোগ্য হাসপাতালগুলোর মধ্যে এস.এস.এম.সি. ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ৫৯ জন, কাকরাইলের ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে ৪৪ জন, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ৩৫ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ২৩ জন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ২০ জন, স্কয়ার হাসপাতালে ২০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৫৭৪ জন। চিকিৎসা শেষে হাসপাতালের ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় ফিরেছেন ১১৪৯ জন। আর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, এ বছর জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৯ জন, মার্চে ১৩ জন, এপ্রিলে ৩ জন, মে মাসে ৪৩ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। জুন মাসেই কয়েকগুণ বেড়ে যায় ডেঙ্গু রোগী। জুন মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ২৭২ জন রোগী।
জুন মাস থেকে দেশে বৃষ্টি বেড়ে গেলে রাজধানীতে যেমন দেখা যায় জলাবদ্ধতা, তেমনি বিভিন্ন স্থানে পানি জমে জন্ম নেয় এডিস মশা। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এডিস মশার উপদ্রব কমাতে এবং মশার বংশবৃদ্ধি ঠেকাতে চিরুনী অভিযানসহ নানা পদক্ষেপ নিলেও আদৌ কোনো সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী।
প্রতিদিন দুই সিটির মশক নিধন কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ এডিস মশার লার্ভা পাওয়া বাড়িগুলোকে 'রেডমার্ক' করে দিলেও কমছে না ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বরং বেড়েই চলছে।
সিটি করপোরেশনের এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের যে কার্যক্রম তা ফলপ্রসূ নয় উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজির আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "এভাবে একটি/দুটি এলাকা পরিদর্শন করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। এজন্য জনসম্পৃক্ততা দরকার। ভবন মালিকদের এবং ওয়ার্ডবাসীদের সমন্বয়ে কমিটি করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে। একটি দুটি বাড়ি রেডমার্ক করে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না"।
বে-নজির আহমেদ আরও বলেন, "কোনো দেশে ডেঙ্গু একবার ঢুকে গেলে তা আর সে দেশ থেকে একেবারে উধাও করা সম্ভব না তবে আমাদের কাজের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আমাদের দেশে অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে"।
দেশে করোনা আসার আগে ডেঙ্গুই সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের ছিল আর সেটা নিয়ন্ত্রণেই সবার উদ্যোগ ছিল কিন্তু এ বছর করোনার মধ্যে ডেঙ্গু বেড়ে যাওয়া আমাদের আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এডিস মশার জন্য মিলিমিটার পানি জমে থাকাই যথেষ্ট। একটি ফ্রীজের পিছনের পানিতেও এডিস মশার বংশবিস্তার হতে পারে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার বিষয়ে আগেই সতর্ক করা হয়েছিলে উল্লেখ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার টিবিএসকে বলেন, "জুন মাসে আমাদের এক জরিপে ঢাকার কয়েকটি স্থানে এডিস মশার ঘনত্ব অনেক বেশি পাওয়া যায়। তখন থেকেই আমরা সতর্ক করে আসছি। তখনই জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল"।
এডিস মশার বিষয়ে গা-ছাড়া ভাব না দেখিয়ে এখনই জরুরি ব্যবস্থা না নিলে আগস্ট, সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে বলেও উল্লেখ করেন এ গবেষক।
দেশে ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে প্রায় এক লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। আর মারা গিয়েছিলেন ১৭৯ জন। ২০২০ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কম ছিল। সে বছর ১৪০৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। ডেঙ্গু সন্দেহে ১২ জনের মৃত্যুর তথ্য আইইডিসিআরে পাঠানো হয়। এর মধ্যে ডেঙ্গুর কারণে ৭ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২০১৯ সালের আগে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল ২০০০ সালে, ৯৩ জন। ওই বছরই রোগটি প্রথম ভয়াবহ আকার নেয়, আক্রান্ত হয় ৫ হাজার ৫৫১ জন।
এরপর ধারাবাহিকভাবে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসে। ২০০৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা চার হাজারের নিচে ছিল, মৃতের সংখ্যাও ছিল খুব কম।