বাণিজ্য পরিধির সাথে বাড়েনি চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা, ক্রমাগত কন্টেইনার জট
চলমান লকডাউন পরিস্থিতি এবং ঈদুল আযহার ছুটিতে ডেলিভারি সাড়ে চার হাজার থেকে শতকের কোটায় নেমে আসায় চট্টগ্রাম বন্দরে ক্রমাগত বাড়ছে কন্টেইনারের চাপ।
একই সাথে জাহাজ সংকটের কারণে ১৭টি বেসরকারি আইসিডিতে (ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো) রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার জটের সাথে যুক্ত হয়েছে বন্দরের ইয়ার্ড থেকে স্থানান্তরিত আমদানি কন্টেইনারের বাড়তি চাপ। আইসিডির সংখ্যা ১৯টি হলেও বর্তমানে সচল আছে ১৭টি।
বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে সক্ষমতার ৮৭ ভাগ কন্টেইনারে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে ১৫ ভাগ জায়গা খালি রাখার বিধান আছে। ৪৯,০১৮ টিইইউস (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের কন্টেইনার) ধারণ ক্ষমতার চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে গত ২৮ জুলাই সকাল ৮টা পর্যন্ত কন্টেইনার ছিলো ৪২,৬৭৪ টিইইউস।
একই অবস্থা আইসিডিগুলোতেও। গত ২৮ জুলাই পর্যন্ত ১৭টি বেসরকারি আইসিডির প্রায় ৭৫ ভাগ কন্টেইনার পূর্ণ ছিল। খালি আছে ২৫ ভাগ জায়গা। স্বাভাবিক সময়ে আইসিডিগুলোতে ৩০ ভাগ জায়গা খালি থাকে।
গত ১৪ বছরে চট্টগ্রাম বন্দরে ইয়ার্ড এবং জেটির সংখ্যা না বাড়ায় প্রতিবছর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্বাভাবিক সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৫ হাজার টিইইউস কন্টেইনার ডেলিভারি হয়। ঈদের ছুটিকালীন সময়ে কমে যায় ডেলিভারি সংখ্যা।
আইসিডি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান টিবিএসকে বলেন, গত ২৫ মে এনবিআরের নির্দেশনার পর এ পর্যন্ত ৩ হাজার টিইইউস আমদানি কন্টেইনার বন্দরের ইয়ার্ড থেকে আইসিডিতি নিয়ে আসা হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে আইসিডিগুলোতে ৩০ ভাগ জায়গা খালি থাকলেও কন্টেইনারের চাপ বাড়ায় বর্তমানে ধারণ ক্ষমতার প্রায় ২৫ ভাগ জায়গা খালি আছে। ঈদের ছুটিতে কন্টেইনার ডেলিভারি কমে যাওয়ার পর এখনো স্বাভাবিক হয়নি ডেলিভারি পরিস্থিতি। এই অবস্থা চলতে থাকলে কয়েকদিনের মধ্যে বন্দর এবং আইসিডিগুলোতে কন্টেইনার জট আরো বেড়ে যাবে।
বিকডা সুত্র জানায়, বর্তমানে রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার জাহাজীকরণের অপেক্ষায় আছে ১১,৭০০ টিইইউস। স্বাভাবিক সময়ে এই সংখ্যা ৩ হাজার থাকে।
বন্দরের জেটি থেকে কন্টেইনার জট কমাতে সকল ধরনের পণ্য আইসিডিতে সরানোর নির্দেশনার পর এবার আইসিডিগুলোতে কন্টেইনার চাপ বাড়তে শুরু করছে। গত ২৫ জুলাই ৩ শর্তে চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ড থেকে সকল ধরনের আমদানি পণ্য আইসিডিতে সরানোর নির্দেশনা আসে।
বর্তমানে আইসিডিগুলো থেকে শতভাগ রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণ এবং খাদ্যপণ্যসহ ৩৮ ধরনের আমদানি পণ্য ডেলিভারি দেওয়া হয়।
বন্দরের ইয়ার্ড থেকে আমদানি কন্টেইনার সরানো হলেও ডেলিভারি কমে যাওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর এবং বেসরকারি আইসিডি দুটোতেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ঈদের ছুটির পর চলমান টানা ১৪ দিনের কঠোর লকডাউনের কারণে পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করেছে।
এই সময়ে দেশের সকল কল-কারখানা বন্ধ থাকায় আমদানিকারকরা বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারি নিচ্ছেন না। অন্যদিকে গত কয়েকমাস ধরে জাহাজ সংকটের কারণে আইসিডিগুলোতে রপ্তানি পণ্যের চাপের কারণে সেখানেও জট রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবছর ঈদের ছুটি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে একই অবস্থা বিরাজ করলেও বন্দরের সক্ষমতা সেই তুলনায় না বাড়ার কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়েনি ১৪ বছরেও
প্রতিবছর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের পরিধি বাড়ছে। কিন্তু বন্দরের সক্ষমতা না বাড়ায় প্রতিবছর ঈদের ছুটি কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে কন্টেইনার জট দেখা দেয়। নানা উদ্যোগের পরও কন্টেইনার জট ঠেকানো যায়নি।
রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তারা বিদেশী ক্রেতাদের কাছে সময়মতো পণ্য পাঠাতে পারছেন না। এতে অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে যাচ্ছে।
সর্বশেষ ২০০৭ সালে নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের পর চট্টগ্রাম বন্দরে জেটির সংখ্যা আর বাড়েনি। বর্তমানে বন্দরে জেটির সংখ্যা ১৮টি।
চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল, বে টার্মিনালসহ বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিলেও শুধুমাত্র পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালের কাজ চলমান আছে।
২০২০ সালের মধ্যে লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের লক্ষমাত্রা নিয়ে প্রকল্প হাতে নিলেও শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্প থেকে সরে আসে।
২০১৯ সালে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ৩ দফা বাড়িয়ে ২০২২ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া ২০২১ সালের মধ্যে বে টার্মিনাল প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার লক্ষমাত্রা নিয়ে প্রকল্প হাতে নিলেও এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ এখনো শুরু হয়নি।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে বর্তমানে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে।
জার্মান কোম্পানি এইচপিসি হামবুর্গ পোর্ট কনসাল্টিং জিএমবিএই চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য ৩০ বছরের একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরী করে, যেটি ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়।
এতে বলা হয়েছিল, যদি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পুরোদমে চালু করা যায় তাহলে চট্টগ্রাম বন্দর ২০১৭ সাল পর্যন্ত কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের চাপ সামলাতে পারবে।
সংস্থাটি ২০১২ সালের আগে তিনটি মূল টার্মিনাল নির্মাণের পরামর্শ দেয়। ওই সংস্থার মাস্টারপ্ল্যানে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম বন্দর ২০২০ সালের মধ্যে ২.৭ মিলিয়ন টিইউস, ২০২৫ সালের মধ্যে ৪.৪ মিলিয়ন টিইইউস এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৫.১ মিলিয়ন টিইইউস কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং করবে। যদিও ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দর ৩ মিলিয়ন টিইইউস কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের লক্ষমাত্রা পূরণ করে।
১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে সিসিটি (চট্টগ্রাম কন্টেইনার টার্মিনাল) নির্মিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে চট্টগ্রাম বন্দরে জেটি ছিল ১২টি। ২০০৭ সালে নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের পর এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮টিতে।
চট্টগ্রাম বন্দর ২০০৭ সালে শূন্য দশমিক ৯ মিলিয়ন টিইইউস কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং করে। ২০১৬ সালে হ্যান্ডেলিং করে ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন টিইইউস। ২০১৯ সালে ৩ মিলিয়ন টিইইউস কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং করে।
বন্দর কতৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, 'বর্তমানে একটি জাহাজ বন্দরের জেটিতে বার্থিং পেতে সময় লাগছে ২ দশমিক ৫ দিন। ঈদের ছুটিতে কন্টেইনার ডেলিভারি কমলেও আস্তে আস্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে'।