লন্ডনের ডাউনিং স্ট্রিটে অবসরপ্রাপ্ত গোর্খাদের অনশন ধর্মঘট
দু'শ বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে কাজ করে আসছে নেপালের গোর্খা সৈন্যরা। এ সৈন্যদের মূলমন্ত্র হলো, "কাপুরুষ হওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো"।
গত শনিবার বেশ কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত গোর্খা যোদ্ধা লন্ডনের ডাউনিং স্ট্রিটে অনশন ধর্মঘটে বসেন। এদের মধ্যে ৬৩ বছর বয়সী জ্ঞানরাজ রায়ও রয়েছেন, যিনি সেদিন সকালের নাস্তা করে ধর্মঘটে বসার পর থেকে এখন পর্যন্ত কিছু খাননি।
রায় বলেন, ব্রিটিশ সৈন্যদের পাশে তিনি ২০ বছর ধরে যুদ্ধ করেছেন। সরকার যদি তার পেনশন ব্রিটিশদের পেনশনের সমান না করে তাহলে তিনি অনাহারে মরতেও প্রস্তুত আছেন।
তার সাথেই ডাউনিং স্ট্রিট গেটসের পাশে হুইলচেয়ারে বসে আছেন প্রাক্তন সৈনিক ধান গুরুং এবং নেপাল থেকে আসা গোর্খা বিধবা পুষ্প রানা ঘেল। তারা দুজনই ৫৯ বছর বয়সী।
গত বুধবার তাদের অনশন ধর্মঘটের পঞ্চম দিন শুরু হয়। রাস্তার ধারে বসে থাকায় তাদের মাথার ওপর কোনো ছাউনি পর্যন্ত নেই। এছাড়া, "স্থানীয় বিধি লঙ্ঘনের" অভিযোগে সেখানকার ছায়াযুক্ত আশ্রয়স্থলও সরিয়ে ফেলেছে পুলিশ।
জ্ঞানরাজ রায় বিবিসিকে বলেন, "আমরা প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ব্রিটিশদের মতো করে সুযোগ-সুবিধা পেতে চাই। এ কারণেই মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে আজ আমরা এখানে এসেছি।"
গোর্খা কারা?
গোর্খা বা গুর্খারা মূলত নেপাল ও উত্তর ভারতের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে আসা সেনা। সাধারণত প্রতি বছর সেনাবাহিনীর ২০০ পদের জন্য নেপালের পাহাড়ি অঞ্চলের যুবকদের নির্বাচন করা হয়। বাছাইপর্বে তাদেরকে বেশ কঠিন কিছু পর্যায় অতিক্রম করে আসতে হয়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে ৭০ পাউন্ড ওজনের পাথর দিয়ে ভরা একটি ঝুড়ি পিঠে করে ৪০ মিনিটের জন্য পাহাড়ের ওপরের দিকে দৌড়ে ওঠা। মূলত গোর্খা বাছাইয়ের পদ্ধতি বিশ্বের কঠিনতম পদ্ধতিগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বর্তমানে গোর্খা ব্রিগেডে প্রায় ৩,৫০০ পুরুষ আছে যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছিল ১ লাখ ১২ হাজার। তবে, গোর্খারা বর্তমানে ফোকস্টোনের কাছে শর্নক্লিফে থাকা সত্ত্বেও তারা ব্রিটিশ নাগরিক নয়।
১৯৪৭ সাল থেকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পাশে থেকে যুদ্ধ করে আসছে গোর্খারা। এমনকি বিভিন্ন যুদ্ধে হাজার হাজার গোর্খা সৈন্য মৃত্যবরণও করে। এছাড়া, দুটি বিশ্বযুদ্ধে ৪৩ হাজার গোর্খা সৈন্য নিহতের রেকর্ড রয়েছে। এ দুটি বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ২ লাখ গোর্খা অংশগ্রহণ করার পাশাপাশি বিগত ৫০ বছর ধরে তারা বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালন করে আসছে। গোর্খা সৈন্যরা হংকং, মালয়েশিয়া, বোর্নেও, সাইপ্রাস, দ্য ফকল্যান্ডস, কসোভো, ইরাক এবং আফগানিস্তানের বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নিয়েছে।
তবুও, ১৯৯৭ সালের আগে অবসর নেওয়া গোর্খা সৈন্যরা ব্রিটিশ আর্মিদের প্রাপ্ত পেনশনের ক্ষুদ্র একটি অংশ পেনশন হিসেবে পেয়ে থাকেন। দ্য গোর্খা পেনশন স্কিম (জিপিএস) অনুযায়ী, যারা কমপক্ষে ১৫ বছর দায়িত্ব পালন করেছে, সেসকল গোর্খাদের পেনশন নির্ধারণে ভারতীয় সৈন্যদের পেনশনের হারকে ভিত্তি ধরা হয়। সরকার বলে, নেপালে জীবন-যাপনের খরচ যুক্তরাজ্যের চেয়ে অনেকাংশেই কম হওয়ায় তারা পেনশনের এই মান নির্ধারণ করেছে। তবে, ২০০৯ সালে অভিনেত্রী জোয়ানা লুমলির অধীনে চালানো একটি প্রচার অভিযানের মাধ্যমে অবসরপ্রাপ্ত গোর্খারা যুক্তরাজ্যে বসবাসের অধিকার পায়। জোয়ানার বাবা ষষ্ঠ গোর্খা রাইফেলসে দায়িত্ব পালন করায় তিনি এ প্রচার চালিয়েছিলেন।
এ প্রতিবাদে অংশ নিতে রিডিং শহর থেকে আসা রায় বলেন যে, তিনি তার চাচাদেরকে অনুসরণ করে ১৭ বছর বয়সে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি বলেন, "দায়িত্বরত অবস্থায় ব্রিটিশদের তুলনায় খুবই সামান্য পরিমানে বেতন দেয়া হতো আমাদেরকে। পরবর্তীতে দেখি আমাদের পেনশনের পরিমাণও বেশ কম। যেখানে একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সৈনিকের মাসিক পেনশন ছিলো ৮০০ পাউন্ড, সেখানে আমাকে দেওয়া হত মাত্র ৪৭ পাউন্ড।"
তিনি আরো জানান যে, অবসরে যাওয়ার সময় তিনি এককালীন ৩ হাজার পাউন্ড পেয়েছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশদের ক্ষেত্রে এটি ছিলো ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার পাউন্ড। বর্তমানে তিনি ৩৫০ পাউন্ড মাসিক পেনশন পেয়ে থাকেন, যেখানে একই পদমর্যাদার একজন ব্রিটিশ সৈন্য পায় ১২০০ থেকে ১৩০০ পাউন্ড।
বিবিসি যখন এ তথ্যগুলো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামনে তুলে ধরে তখন তারা এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
তবে, জ্ঞানরাজ রায়ের জন্য এটিই প্রথম অনাহার অনশন নয়। ২০০৭ সালে বসা এক অনশনের দরুন তিনি ১৫ দিন না খেয়ে ছিলেন। দায়িত্বরত গোর্খা সৈন্যদেরকে ব্রিটিশদের সমান পেনশনের অধিকার দেওয়ার পরই কেবল তিনি অনশন ভাঙেন। তবে, ১৯৯৭ সালের জুলাইয়ের আগে অবসর নেওয়া ২৫ হাজার সৈন্য নতুন এ নিয়মের আওতার বাইরে থাকবে বলে জানায় ব্রিটিশ গোর্খা ওয়েলফেয়ার সোসাইটি।
এদিকে বেসিংস্টোকের ধান গুরুং বলেন, তিনি তার দাদাকে অনুসরণ করে এখানে আসেন। গোর্খা সৈন্যদের জন্য নির্ধারিত সময় অর্থাৎ ১৫ বছর ধরে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সঙ্গে কাজ করা ব্রিটিশ সৈন্যদেরকে ২২ বছর দায়িত্ব পালনের সময় দেওয়া হলেও তাকে ১৫ বছর পরই অবসর নিতে বাধ্য করা হয়। গুরুংয়ের কাছে এটি একটি 'বড় বৈষম্য'।
তিনি বলেন, "১৯৯৪ সালে যখন আমি অবসর নেই তখন আমার মাসিক পেনশন ছিল মাত্র ২০ পাউন্ড। কীভাবে আমি আমার স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকলাম!"
বর্তমানে কাজ করা গোর্খা সৈন্যদের নিয়ে তিনি বলেন, "যথেষ্ট শিক্ষার সুযোগ না থাকায় এখন তারা সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইসরায়েলের মত নোংরা, কঠিন এবং বিপজ্জনক জায়গায় দায়িত্ব পালন করছে।" ব্রিটিশদের জন্যে জীবন দেওয়া গোর্খাদের কথা মনে পড়লে তার "রক্ত গরম হয়ে আসে" বলে উল্লেখ করেন গুরুং।
"যারা যুদ্ধে আহত হয়েছিল, তাদেরকে যুদ্ধ শেষে বলা হয়েছিল "তোমরা আহত, তাই তোমরা আর্মিতে থাকার উপযুক্ত নও।" ফলে, তাদেরকে খালি পায়ে এবং পেনশন ছাড়াই ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। এসকল ঘটনা মনে পড়া আদতেই হৃদয়বিদারক," বলে যোগ করেন তিনি।
ডাউনিং স্ট্রীটের বাইরে বসে থাকা ক্লান্ত গুরুং বলেন, "২০৭ বছর ধরে অবিচার চালানোর পর তারা এ সমস্যাগুলো থেকে আর মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে না। এ কারণেই আমি আমার জীবন উৎসর্গ করছি। আমরা চাই একটি উচ্চ পর্যায়ের দল গঠন করে আলোচনার জন্য একটা দিন ঠিক করতে। যদি তারা এটি করতে রাজি হয় তাহলে আমরা অনশন ধর্মঘট স্থগিত করব। যদি তারা এ সমস্যার সমাধান করে তাহলে আমরা থেমে যাব। আর যদি না করে তাহলে আমি মরে গেলেও তার তোয়াক্কা করছি না।"
এদিকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, 'ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে গোর্খারা যে বিশাল অবদান রেখেছে তা আমরা মূল্যায়ন করি। নেপালে অবসর নেওয়ার পর তাদের পরিমিত পেনশন ও চিকিৎসাসেবার বিষয়টিও বিবেচনা করি আমরা। যুক্তরাজ্যে অন্যান্য সরকারি খাতের পেনশনের পাশাপাশি গোর্খা পেনশন স্কিম জোরদার করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবিদ্ধ।"
সূত্র: বিবিসি