চাকরি ছাড়ার আগে নিজেকে যেসব প্রশ্ন করবেন
মহামারির কারণে মানুষের প্রাধান্যের ক্ষেত্র বদলে যাওয়ার জন্য হোক, কিংবা শুধুমাত্র নিজের কর্মক্ষেত্র পরিবর্তনের জন্য হোক; সাম্প্রতিক সময়ে অনেক মানুষই নিজেদের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন অথবা দেওয়ার কথা ভাবছেন।
মাইক্রোসফটের এক জরিপে উঠে এসেছে, বিশ্বজুড়ে মোট ৪১ শতাংশ মানুষ চলতি বছরেই নিজেদের কর্মক্ষেত্র পরিবর্তনের কথা ভাবছেন। এদের কেউ কেউ আবার পরিবর্তন করেও ফেলেছেন ইতোমধ্যে।
কিন্তু মহামারির মধ্যে আপনার এই সিদ্ধান্ত কতখানি যৌক্তিক? অথবা আপনি কীভাবে বুঝবেন যে কর্মক্ষেত্রের এই পরিবর্তনটা সত্যিই আপনার প্রয়োজন? ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের জীবিকা উপার্জনের পথটা আপনি বন্ধ করে দিচ্ছেন না তো? হতে পারে বর্তমান কর্মস্থলের চাইতে ভবিষ্যতে আপনাকে আরও সমস্যায় পড়তে হতে পারে?
এসব সমস্যার সমাধান করতে আমরা আপনার সামনে তুলে ধরছি ১৫ টি প্রশ্ন যা চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে স্বচ্ছতা অর্জন করতে আপনাকে সাহায্য করবে।
১। বর্তমান কর্মস্থলেই থাকার কথা কি ভাবা উচিত?
আপনার বর্তমান কর্মস্থলের কাজের ফলে যদি আপনার উপরে চরম শারীরিক বা মানসিক যন্ত্রণা তৈরি হয়; এই যেমন, ক্রমাগত কটূক্তির শিকার হচ্ছেন অথবা মাত্রাতিরিক্ত কাজের ভার, তাহলে হয়তো আপনাকে সেই চাকরি ছেড়ে দেওয়াই উচিত।
আপনার কর্মজীবনের সাফল্যের সঙ্গে যদি এই সিদ্ধান্তটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে, সিদ্ধান্তটা না নিলে যদি আপনার শরীরের উপর ক্রমশ নেতিবাচক প্রভাব পড়তে থাকে; তাহলে আপনাকে সেই চাকরি ছাড়তে হবে।
কিন্তু এক্ষেত্রে অবশ্যই আপনাকে নিজের সঙ্গে সৎ থাকতে হবে।আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে আপনার হতাশার জায়গা কোনগুলো, ঠিক কোন কারণে আপনি কাজে ভারসাম্য রাখতে পারছেন না। এই প্রশ্নগুলোর যত বেশি যৌক্তিক উত্তর খুজে বের করতে পারবেন, আপনার সিদ্ধান্তে তত বেশি স্বচ্ছতা আসবে।
শুধুমাত্র কর্মক্ষেত্রে নিজের ভূমিকা ও দায়িত্বই নয়; নির্দিষ্ট কোনো প্রজেক্ট, পারিশ্রমিক, সম্ভাব্য উন্নতি, কর্মস্থলের পরিবেশ ও সংস্কৃতি, কাজের চাপ, সহকর্মীদের মনোভাব, কোম্পানির মূল্যবোধ- এই সবকিছু নিয়েই গভীরভাবে চিন্তা করে তারপর চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্তে আসুন। টানা ১০ দিন নিজ প্রতিষ্ঠান ও কাজ সম্পর্কে আপনার মনোভাব ও অভিজ্ঞতা টুকে রেখে পরে সে অনুযায়ী বিশ্লেষণ করতে পারেন।
২। কীভাবে চাকরি শুরু করেছিলেন?
চাকরি ছাড়ার ক্ষেত্রে আপনার পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার আগে একবার ভেবে দেখতে পারেন যে, কেন আপনি বর্তমান চাকরিটা নিয়েছিলেন? এতদিন যাবত আপনার ক্যারিয়ার কোন দিকে এগোচ্ছিল?
অতীতের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে আপনি ভবিষ্যতের জন্য একটা নীলনকশা প্রণয়ন করতে পারেন।আপনার যদি আগেও এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভিজ্ঞতা থাকে, বর্তমান কর্মস্থলের চেয়ে ভবিষ্যতের কর্মস্থলের সার্বিক পরিবেশ সহজ হবে-এমনটা নিশ্চিত হয়ে তবেই চাকরি ছাড়ুন।
৩। কতোদিন যাবত আপনি এই চাকরি নিয়ে অসুখী?
বর্তমান চাকরি নিয়ে কতদিন ধরে আপনি অস্বস্তিতে আছেন বা অসুখী, তা চিন্তা করুন। মহামারিকাল হিসাবে যদি আপনার অসন্তুষ্টির খুব সাম্প্রতিক সময়ের হয়, এই ধরুন ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে- তাহলে ধরে নিতে হবে যে আপনার অসন্তুষ্টির পেছনে মহামারির বড় প্রভাব রয়েছে। এখন যদি পরিস্থিতি খানিকটা শিথিল হয়, তাহলে আপনি এই কর্মস্থলে আরও ছয় মাস সময় কিন্তু দিতেই পারেন। হতে পারে, এই সময়ে আপনার গত ১৮ মাসের দুশ্চিন্তা বা কাজের চাপ অনেকটা কমে আসবে।
আপনি আপনার উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে পারেন নিজেকে কিছুটা সময় দেওয়ার জন্য। কারণ চাকরি পরিবর্তন মানেই কিন্তু আপনার সার্বিক পরিস্থিতি ভালো হওয়া নয়।
৪। আসলে কী চাই?
একজন মানুষের পেশাদার জীবনের ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন। আপনার বর্তমান কাজে ঠিক কী সমস্যা, আপনার ড্রিম জব কিংবা প্যাশনের জায়গাটা কী- এই সবকিছু নিয়ে খুব বেশিই চিন্তা করতে হয়।
কিন্তু চাকরির ক্ষেত্রে বরং এভাবে ভাবা যেতে পারে, 'আপনি কী উপায়ে জীবনধারণ করতে চান? আপনি কী হতে চান জীবনে?' এই প্রশ্নের উত্তর পেলেই আপনার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ হয়ে যাবে।
৫। পরিবার ও বন্ধুবান্ধব কী বলবে?
বিশ্বস্ত বন্ধু ও পরিবারের সদস্য থাকলে আপনার চিন্তাভাবনা সঠিক পথে পরিচালিত করা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। অনেক সময় তারা আপনার চাইতে বেশি স্পষ্ট ও স্বচ্ছভাবে যুক্তিগুলো দেখতে পায়।
তাই ঘনিষ্ঠজনদের সমর্থন ছাড়া জীবনের যেকোনো বড় পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন। তাই জীবনে এমন কিছু মানুষ রাখুন যারা কঠিনতম সময়েও আপনাকে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে সাহায্য করবে কিংবা দিকনির্দেশনা দিবে।
৬। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি আর কী কী ছাড়তে হচ্ছে?
পরিবর্তন মানেই পুরনো অনেক কিছুকে ছেড়ে আসা, ছাড় দেওয়া। বন্ধুবান্ধব, সুযোগ-সুবিধা, স্থিতিশীলতা, একটা পরিচিত রুটিন- এই সবকিছু আপনাকে ছেড়ে আসতে হবে তখন। এই বিষয়গুলো ছাড়ার জন্য আপনি মানসিকভাবে প্রস্তুত কিনা তা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিন।
৭।এই চাকরি ছাড়ার বিনিময়ে কী পাবেন?
বেশিরভাগ সময় মানুষ চাকরি চেড়ে দেয় কারণ তাদের মনে হয় যে, তাদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। যেমন, অনেকদিন যাবত যদি আপনার কোনো উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে একসঙ্গে থাকেন; তাহলে আপনার নিজের গুরুত্ব হয়তো কমতে থাকে।
দীর্ঘদিন যাবত যদি আপনার প্রমোশন না হয় অথবা বেতন না বাড়ে, তাহলে আপনি চাকরি ছাড়ার চিন্তা করতেই পারেন।
৮। থেকে যাওয়ার কোনো সুযোগ আছে কি?
নতুন একটা চাকরিতে গিয়ে আপনি যা যা পাওয়ার আশা করছেন, তাহয়তো আপনি বর্তমান কর্মস্থলেই পেতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে আপনাকে আপনার নিয়োগকর্তার সঙ্গে আপনার দাবিদাওয়ার ব্যাপারে আলাপ করতে হবে। একটা পারফেক্ট-ডে প্ল্যান নিয়ে আপনি তার সঙ্গে সমঝোতায় আসতে পারেন।
অনেক সময় একক ব্যক্তি হিসেবে আপনার যে মূল্য, ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে তা ততটা নয়। একটা কোম্পানিতে আপনি খুব বাধ্য ভাবে ১০ বছর কাটানোর পর আপনি হয়তো ভিন্নধর্মী কিছু করার কথা ভাবতেই পারেন না।
৯। বসের খারাপ আচরণের জন্য কি চাকরি ছেড়ে দিবো?
আপনি যদি খুব বড় কোনো কোম্পানিতে কাজ করেন, তাহলে আপনি আপনার রিপোর্টিং লাইন বদলে ফেলতে পারেন সেই বসের কাছ থেকে দূরত্ব তৈরি করার জন্য। কিন্তু ছোটখাটো কোম্পানিতে তা সম্ভব হয় না।
যদি হাতে কোনো বিকল্পই না থাকে, আপনার মানসিক স্বাস্থ্যই যদি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন; তাহলে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতেই হচ্ছে।
তবে অনেক সময়ই নতুন আরেকটা চাকরি শুরু করার আগপর্যন্ত মানুষ আগের চাকরির বাজে পরিবেশ সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা পায় না।ভালো বেতনের জন্য মানুষ অনেক সময় একাধিক প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে।
১০। কাজের চাপ বেশি বলে চাকরি ছাড়বেন?
চাকরির কারণে যদি আপনার জীবনমান, মানসিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি ঘটতে থাকে, ঘুমের ব্যঘাত পর্যন্ত ঘটে, পরিবারের সাথে সময় কাটানোর কোনো সুযোগই থাকে না, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন; তখনই আপনার মধ্যে চাকরি সম্পর্কে বিতৃষ্ণা চলে আসে।
কিন্তু এটাকে সাময়িক ব্যস্ততা হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইলে, আগে নিশ্চিত করতে হবে যে এই সমস্যা আসলেই স্থায়ী নয় এখানে।
আবার অনেকের মধ্যে নিজস্ব সংস্কার বা আচরণগত সমস্যা থেকেও দুশ্চিন্তা জন্ম নেয়। আপনি চাইলে আপনার একজন বন্ধুর কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারেন যে, একই পরিস্থিতিতে থাকলে সে কিভাবে সামলে উঠতো? অতিরিক্ত চাপের মধ্যে থাকলে থেরাপিস্ট এর সাহায্যও নিতে পারেন। ভিন্নভাবে কাজের কৌশল-পরিকল্পনা ঠিক করলেও দুশ্চিন্তা কমতে পারে।
১১। প্রত্যাশাগুলো কি আসলেই বাস্তবমুখী?
আপনার বর্তমান চাকরির চাইতেও আদর্শ চাকরি সহজেই পাবেন-এই ধারণা আসলে ভুল। 'নিজেই নিজের কাজ নিয়ন্ত্রণ করবো'-এমনটা শুনতে চটকদার লাগলেও, সেখানেও কঠোর পরিশ্রম করতে হয়।
তাই চাকরি ছেড়ে দিয়ে নতুন আরেকজন কর্মকর্তার সাথে মানিয়ে নেওয়ার শক্তি আপনার আছে কিনা, তা বুঝতে হবে।
১২। চাকরিটা ছাড়লে কি চলবে?
চাকরি ছাড়ার আগে অবশ্যই আপনার হাতে অন্তত ছয় মাস বা এক বছর চলার মতো টাকা থাকা উচিত। কারণ আপনি জানেন না পরবর্তী চাকরি আপনার জন্য আসলেই কতটা সুবিধাজনক হবে। হয়তো সেটা বর্তমান চাকরির চেয়েও খারাপ অবস্থায় দাঁড়াতে পারে।
নিজে ব্যবসা বা স্টার্ট-আপ দাঁড় করাতে চাইলেও ভালো রকম পুজি নিয়ে শুরু করা উচিত। তাই চাকরি ছেড়ে দিলে আপনি ঠিক কতটা ঝুঁকির মুখে পড়বেন তা আপনাকেই পরিমাপ করতে হবে।
১৩। কাজ নিয়ে চিন্তা কমানো যায় কি?
আমাদের পেশাদার জীবন খুব সহজেই ব্যক্তিগত জীবনের দখল নিয়ে নেয়, যা অনেক সমস্যার মূল। কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের সীমারেখাটা আপনাকেই ঠিক করতে হবে।
পর্যাপ্ত খাওয়াদাওয়া, স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখা, পরিবার পরিজনের সাথে সময় কাটানো এই সবকিছুকে শুরু থেকেই ভারসাম্যের মধ্যে রাখতে হবে।
১৪। এখনই কি সঠিক সময়?
চাকরির বাজার সবসময়ই খুব অনিশ্চিত থাকে। একটা নতুন চাকরি পেতে ছয় মাস বা তার অধিক সময়ও লেগে যায়।তাই আপনার বর্তমান চাকরির পরিবেশ একেবারেই সহ্যের বাইরে চলে না গেলে, আপনি ধাপে ধাপে এগোতে পারেন্ পরিবর্তনের দিকে।শুধুমাত্র পরিবর্তন আনার জন্য এক লাফে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সাহস দেখালে, তা হয়তো আরও নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনতে পারে। তাই নিজেকে প্রশ্ন করুন, এখনই কি চাকরিটা ছাড়ার উপযুক্ত সময়?
১৫। কেনো সিদ্ধান্ত নিতে বেগ পেতে হচ্ছে?
আপনার সামনেই কখনোই সবকিছু একদম সুন্দরভাবে গোছানো ও আদর্শ রূপে থাকবে না। আপনাকে নিজেই ঝুঁকি নিতে হবে এবং কাজ করতে হবে।
নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করুন, প্রশ্ন করুন, চিন্তা করুন, পুনঃমূল্যায়ন করুন যে কিভাবে জটিল অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা যায়। একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে স্বাধীনভাবে কাজ করুন যাতে পরে অনুতাপ করতে না হয়।
- সূত্র- দ্য গার্ডিয়ান