মহামারি সত্ত্বেও মোদির বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনের ঝুঁকি কমেনি
বিতর্কিত কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে রোববার ভারতের অন্যতম কৃষিপ্রধান রাজ্য উত্তর প্রদেশে জড়ো হন কৃষকরা। মাসখানেক বাদে আন্দোলনে ফের নতুন মাত্রা যুক্ত হওয়ায় সংকটে নরেন্দ্র মোদির সরকার।
জেলা কর্মকর্তা অমিত সিং সিএনএনকে জানান, উত্তর প্রদেশের মুজাফফরনগরে আন্দোলনে প্রায় দেড় লাখ মানুষ যোগ দেন। তবে, কৃষকদের সংগঠন সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার (এসকেএম) তথ্য অনুসারে বিক্ষোভে প্রায় ১০ লাখ আন্দোলনকারী উপস্থিত ছিলেন।
গত ডিসেম্বরে রাজধানী নয়া দিল্লির বাইরে প্রধান সড়কগুলো দখল করে রাস্তায় অচলাবস্থার সৃষ্টি করেন লাখো বিক্ষোভকারী। তবে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে স্তিমিত হয়ে পড়ে আন্দোলন। রোববারের সমাবেশের মধ্য দিয়ে কৃষক আন্দোলন নতুন করে জ্বলে উঠবে বলে মন্তব্য করেন প্রভাবশালী কৃষক নেতা রাকেশ টিকাইত।
আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, "যখন এই আন্দোলন সফল হবে; যখন দেশের কৃষক আর তরুণদের জয় হবে, কেবল তখন-ই আমরা মাঠ ছাড়ব।"
এর আগের অবরোধগুলো তেমন কোনো ফলাফল দেখাতে না পারলেও ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে দেশব্যাপী অবরোধের ডাক দিয়েছেন কৃষক নেতারা।
চ্যালেঞ্জের মুখে মোদি সরকার
কৃষিখাত ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। মোদির ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির জন্য (বিজেপি) প্রচ্ছন্ন হুমকির সৃষ্টি করেছে এই আন্দোলন।
ভারতীয় ভোটারদের সবচেয়ে বড় অংশই কৃষক। ভারতের ১৩০ কোটি জনগণের ৫৮ শতাংশই কৃষিখাতের ওপর নির্ভরশীল। কৃষকরা ক্ষুদ্ধ হলে ২০২৪ সালের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে মোদি বিপুল সংখ্যক ভোট হারাতে পারেন।
গত নয় মাস ধরে নতুন তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন কৃষকরা। নতুন এই আইনগুলোর কারণে কৃষভিত্তিক জীবিকা ধ্বংসের পাশাপাশি বড় করপোরেশনগুলোর শোষণের শিকার হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে পাস হওয়া আইনগুলোর মাধ্যমে কৃষি পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও মূল্য নির্ধারণে সংশোধন আনা হয়। ফলে, কয়েক দশক ধরে অনিয়ন্ত্রিত মুক্তবাজার থেকে কৃষকরা রক্ষা পেলেও এখন আর সেই নিশ্চয়তা থাকছে না।
পুরোনো আইন অনুসারে, কৃষকরা রাজ্যের কৃষি উৎপাদন বাজার কমিটির নিলামে তাদের পণ্য বিক্রি করতেন। এখানে, সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মূল্যের নিশ্চয়তা ছিল। নির্ধারিত ক্রেতারাই কৃষিপণ্য কিনতে পারতেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামও সীমিত রাখা হতো।
নতুন আইনে পুরোনো নিয়ম বাতিল করা হয়। কৃষকরা এখন যে কারও কাছে যেকোনো মূল্যে কৃষি পণ্য বিক্রি করতে পারবেন। মুক্তবাজারে কৃষিপণ্যের দাম অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ায় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এর সুযোগ নিয়ে কৃষকদের ঠকিয়ে প্রকৃত লাভ করবে বলেই কৃষকদের আশঙ্কা।
সরকারের বক্তব্য অনুসারে, দেশের কৃষিশিল্পকে উন্নত করতে এই সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বহু কৃষকদের দাবি, আইনের সুযোগ নিয়ে বৃহদাকার করপোরেশনগুলো দাম নামিয়ে আনবে।
বিক্ষোভ দমনে ব্যর্থ হয়েছেন মোদি। কৃষকদের ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনার পরেও সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ তার সরকার।
কৃষকরা ভরসা রেখে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আলোচনায় আসতে আগ্রহ হবে ভেবে জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সাময়িকভাবে আইনগুলোর স্থগিতাদেশ ঘোষণা করে।
কিন্তু, আইন পুরোপুরি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কৃষকদের একাংশের অনড় অবস্থানে আন্দোলন অব্যাহত থাকে।
সরকারের সমালোচনা
মুজাফফনগরের রোববারের আন্দোলন এখন বিশেষ গুরুত্ব রাখছে। ভারতের অন্যতম জনবহুল রাজ্য হলো উত্তর প্রদেশ। আগামী বছর উত্তর প্রদেশে রাজ্যসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে।
রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে এই র্যালি এক 'হুঁশিয়ারি' ছিল বলে জানিয়েছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি জানায়, "সরকার যদি তিনটি কৃষি আইনই বাতিল না করে এবং কৃষি পণ্য ক্রয়ের আইনি নিশ্চয়তা না দেয়, তাহলে আন্দোলন আরও শক্তিশালী হবে।"
ফেব্রুয়ারিতে বিক্ষোভের সময় পুলিশ এবং কৃষকদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষের পর সরকার নয়া দিল্লির সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় "জনসুরক্ষা বজায় রাখতে এবং জরুরি অবস্থা এড়ানোর স্বার্থে" এই উদ্যোগ গৃহীত হয়। তবে, আন্দোলনকারীরা ইন্টারনেট বন্ধের তীব্র নিন্দা জানান। কৃষক ইউনিয়ন নেতা দর্শন পাল এই সরকারের এই পদক্ষেপকে 'অগণতান্ত্রিক' আখ্যায়িত করেন।
মোদি এবং বিজেপির বিরুদ্ধে ফেব্রুয়ারি মাসে ১৬টি বিরোধী দল এক যৌথ বিবৃতিতে "উদ্ধত, একরোখা ও অগণতান্ত্রিক আচরণের মাধ্যমে" মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ আনে।
এরপর পপস্টার রিয়ানা, সুইডিশ জলবায়ু অ্যাক্টিভিস্ট গ্রেটা থুনবার্গ এবং লেখিকা মিনা হ্যারিসের মতো আন্তর্জাতিক সেলিব্রিটিরা আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানান।
রোববার বিজেপি নেতা অনুরাগ ঠাকুর বলেন, মোদির সরকার কৃষক দলের সঙ্গে আলোচনা করতে প্রস্তুত রয়েছে। কৃষকদের আয় বৃদ্ধির জন্যও সরকার কাজ করছে বলে জানান তিনি।
ভারতে করোনা ভাইরাসের তৃতীয় ঢেউয়ের ঝুঁকির মুখেই রোববার আন্দোলনে বিপুল সংখ্যক মানুষ উপস্থিত হন।
কৃষক দলের গণমাধ্যম বিষয়ক সমন্বয়ক আশুতোষ মিশ্র সিএনএনকে বলেন, "কৃষক এবং আন্দোলনের অন্যান্য সমর্থকদের কাছে গিয়ে গিয়ে আমার মাস্ক পরার অনুরোধ জানাচ্ছি।"
- সূত্র: সিএনএন