এই মামলা আমাকে ও পরিবারকে ওলট-পালট করে দিয়েছে: সাংবাদিক প্রবীর শিকদার
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের (আইসিটি অ্যাক্ট) মামলায় খালাস পাওয়ার পর প্রবীণ সাংবাদিক প্রবীর শিকদার এক প্রতিক্রিয়ায় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এই মামলার প্রভাবে আজ আমি নিঃস্ব। মামলা পরিচালনার ব্যয়ভার একটি বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন বহন করলেও নানাভাবে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। মামলা হওয়ার পর গত ছয় বছরে মানসিক ট্রমা এতোটাই ছিল যে, একরকম আইসোলেটেড ছিলাম। দিন দিন শারীরিক জটিলতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।'
'এ মামলা আমাকে ও আমার পরিবারকে ওলট-পালট করে দিয়েছে। ফলে জীবিকা নির্বাহের জন্য কিছুই করতে পারিনি। বাধ্য হয়ে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমি বিক্রয় করে পরিবার চালাতে হচ্ছে,' যোগ করেন তিনি।
সাবেক স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার ঘটনায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের (আইসিটি অ্যাক্ট) ৫৭ ধারায় দায়ের হওয়া মামলায় বৃহস্পতিবার খালাস পেয়েছেন সাংবাদিক প্রবীর শিকদার।
ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আস সামছ জগলুল হোসেন এ রায় ঘোষণা করেন।
প্রবীর শিকদার বলেন, '২০১৫ সালের ১০ আগস্ট ফেসবুকে তৎকালীন এলজিআরডিমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেই। সেই স্ট্যাটাসে মামলা হওয়ার মতো কোনো উপাদান ছিল না। কিন্তু ক্ষমতার দাম্ভিকতায় মামলা হয়। আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নেওয়ার আগেই শারীরিকভাবে আমাকে নির্যাতন করা হয়। এই নির্যাতনের বর্ণনা তুলে ধরার মতো না।'
ফরিদপুরের রাজাকারদের নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে তার ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশের জেরে ২০০১ সালে তার ওপর হামলা হলে পঙ্গুত্ব বরণ করেন এই প্রবীণ সাংবাদিক। তিনি বলেন, 'হামলায় একটি পা হারিয়েছি। পুরোই প্রতিবন্ধী জীবনযাপন করছি।'
'এই অবস্থায় মামলা হলো। জেলে যেতে হলো। একটি রাষ্ট্র কতটা নির্দয় হলে এ রকম হতে পারে?' প্রশ্ন তোলেন তিনি।
প্রবীর শিকদার বলেন, 'কারাগার থেকে বের হওয়ার পর অন্তত ৫০ বার এই মামলায় হাজিরা দিতে হয়েছে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে। প্রতিবন্দী হওয়ায় আমার সহযোগী হিসেবে পরিবারের সদস্যরাও নিয়মিত আমার সঙ্গে আদালতে গেছে। আদালতে হাজিরার একেকটি দিন ছিল বছরের মতো। এছাড়াও অনেক তারিখ গেছে, হয়তো বিচারক বসেননি, সরকারি আইনজীবী উপস্থিত হননি, এভাবে দিনের পর দিন শুনানি না হয়েই ফেরত এসেছি।'
'মামলা পরিচালনার ব্যয়ভার মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক) বহন করলেও হাজিরা দেওয়ার জন্য যাওয়া-আসা এবং অন্যান্য খরচ হয়েছে, এটা হিসেব রাখিনি। কিন্তু একজন প্রতিবন্ধী মানুষের ওপর এই অযথা ব্যয়ভার ছিল পাহাড়ের মতো।'
'এছাড়াও এভাবে প্রতিনিয়ত আদালতে যাওয়া-আসার যে ভোগান্তি, তা শারীরিক নির্যাতনে সামিল। সেটির ফলে আমার শরীরে আরও নানা জটিল রোগ বাসা বেঁধেছে। এখন শরীরের আবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ছাড়াও এই মামলার কারণে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবেও হয়রানির শিকার হয়েছি।'
আরও পড়ুন: আইসিটি মামলায় খালাস পেলেন সাংবাদিক প্রবীর শিকদার
প্রবীর শিকদার বলেন, 'এই মিথ্যা মামলার ফলে যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি, এজন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে আইনগত পদক্ষেপ নিতে আইনজীবীদের সাথে পরামর্শ করব। এখন শারীরিক অবস্থা বেশি ভালো না। একটু সুস্থ হলেই পদক্ষেপ নেব।'
'শুধু আমি নই, আইসিটি আইন ও ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে অনেক সাধারণ মানুষ আমার মতো নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আইসিটি আইন পরিবর্তন করে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন প্রণয়ন করলেও চরিত্র ও অপপ্রয়োগ একই রয়েছে। এই কালো আইনের মামলায় সকল কারাবন্দির জামিন, মামলা বাতিল ও আইন বাতিলের দাবি করছি; যাতে করে আমার মতো আর কাউকে এভাবে নিঃস্ব হতে না হয়,' যোগ করেন তিনি।
প্রবীর শিকদার আরও বলেন, 'ডিজিটাল সিকিউরিটি অথবা আইসিটি আইন, যেটাই বলেন, এটি সৃজনশীল মানুষ ও সাধারণ নাগরিকের মত প্রকাশে বড় বাধা। আদালত আমাকে খালাস দেওয়ার রায়ে বলেছেন, এই মামলা করে আমার স্বাধীন মত প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'আমি আদালতে ন্যায়বিচার পেয়েছি। এ রায়ে আমি খুশি এবং মনে করি এ রায়ে সত্যের জয় হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ রায় আমাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে আরও সাহস যুগিয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এই দেশকে আমি আমার বাবার কবর মনে করি। কারণ একাত্তরে যুদ্ধের সময় আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। বাবার লাশটা পাইনি আমরা। এ দেশে লুটপাট হোক, সেটা আমি মেনে নিতে পারব না। যতক্ষণ পর্যন্ত আমার এ জীবন আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি লড়াই করে যাব। প্রয়োজনে একাই লড়ব।'
গত ২২ মার্চ আদালতে ওই মামলার দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষ হয়। সেদিন প্রবীর শিকদারের পক্ষে যুক্তিতর্ক শুনানি করেন আইনজীবী আমিনুল গনী টিটো। তিনি আদালতের কাছে দাবি করেন, প্রবীর শিকদার ফেসবুকে মানহানিকর কোনো পোস্ট দেননি। তিনি নির্দোষ।
অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন সরকারি কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম শামিম। যুক্তিতর্ক শুনানিতে তিনি আদালতে বলেন, প্রবীর শিকদারের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
সরকারের সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে নিয়ে ফেসবুকে মানহানিকর পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে ২০১৫ সালের ৬ আগস্ট প্রবীর শিকদারের নামে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা হয়। মামলার বাদী জেলা পূজা উদ্যাপন কমিটির উপদেষ্টা স্বপন পাল। মামলার পর প্রবীর শিকদারকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি জামিনে কারামুক্ত হন।
মামলা ও আদালতের নথিপত্রের তথ্য বলছে, প্রবীর শিকদারের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। রাষ্ট্রপক্ষে এই মামলায় ১০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়।