আফগানিস্তান: তালেবান শাসনের অধীনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা
আফগানিস্তানের নতুন সরকার কাঠামো গঠনের বিষয়ে কয়েকদিন আগেই তালেবান নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন, "আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছি, যা আফগানিস্তানের সকল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করবে।"
দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে কাবুল দখলের পর দলের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে সশস্ত্র এই সংগঠনটির মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছিলেন, "আমরা শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপন করতে চাই। আমরা কোনো অভ্যন্তরীণ এবং বহিঃশত্রু চাই না।"
তবে বিদেশী সরকার, মানবিক সংস্থা এবং বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, তালেবানকে তাদের "কথা নয়, বরং তাদের কাজ বিচার করুন।"
তবে 'কাজ বিচারের' ক্ষেত্রে শুধু আফগানরাই তালেবানকে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখছে। কারণ তারা বাধ্য।
যেদিন নতুন তালেবান সরকার ঘোষণা করা হলো, সেদিন কাবুল এবং অন্যান্য শহরে সাহসী কিছু নারী কর্মী ব্যানার হাতে তাদের অধিকারের দাবিতে রাস্তায় একটি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে নেমেছিল।
এরপরই তালেবানদের ফাঁকা গুলি, কাঁদানে গ্যাস ও পেপার স্প্রে ছোঁড়াসহ রাইফেলের বাট এবং লাঠিপেটা করে প্রতিবাদকারীদের ছত্রভঙ্গ দেওয়ার খবর বিশ্ব সংবাদের শিরোনামে উঠেছিল।
অথচ এই বিক্ষোভটি ছিল একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের আয়োজন। সমাজের সর্বস্তরের নারী-পুরুষদের নারী অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা এবং আসন্ন সরকার ব্যবস্থায় নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল নারীদের এই দলটি। কিন্তু সেই প্রতিবাদে হামলা চালিয়ে তালেবানরা বুঝিয়ে দিল তারা তাদের প্রতিশ্রুতি কতোটা বাস্তবায়ন করতে চলেছে!
নতুন সরকার কাঠামোয় তালেবান নেতাদের একচেটিয়া আধিপত্য দেখা যাচ্ছে; সেখানে সকল জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি অনেক দূরের কথা। তালেবান আন্দোলনের সেই পুরনো সংগঠনের আলোকেই তারা নতুন সরকার গঠন করেছে। সেই আগের কমিশন, অধিদপ্তর এবং আমির হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদাকেই সর্বোচ্চ নেতার পদ দিয়ে একই রাজনৈতিক কাঠামো এবং মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে।
সরকার ব্যবস্থা থেকে নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয় বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কাঠামোতে পশতুন জাতিগোষ্ঠীর আধিপত্য দেখা যাচ্ছে বেশি; শুধুমাত্র একজন তাজিক এবং একজন হাজারকে মন্ত্রী পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে তারা উভয়েই আবার তালেবান। মন্ত্রী পরিষদে একজন নারীও নেই, এমনকি উপমন্ত্রীর পদও তাদের কাউকে দেওয়া হয়নি।
পুরানো তালেবান সরকারের দ্বাররক্ষী হিসেবে ফিরেছে নতুন তালেবান দল। নতুন সরকারের বিভিন্ন পদে দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছে সাবেক গুয়ানতানামো বে বন্দি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের কালো তালিকায় রয়েছে এমন কিছু সদস্য এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা। তারা নিজেরাই নিজেদেরকে শান্তি নির্মাতা হিসেবে ঘোষণা করে আলোচনার টেবিলে বসেছিল এবং একটি মার্জিত, সহনশীল ও নমনীয় নতুন তালেবান দলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রদেশিক রাজধানীগুলোর চারপাশ বন্ধ করে দিয়েছিল।
মন্ত্রিসভার তত্ত্বাবধায়ক প্রধান হলেন তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মোল্লা হাসান আখুন্দ। তিনি বর্তমানে জাতিসংঘের ব্ল্যাক লিস্টেড বা নিষিদ্ধ ব্যক্তিদের তালিকার অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে রয়েছেন সিরাজউদ্দিন হাক্কানি। বাদামি রঙের চাদরে ঢাকা অস্পষ্ট একটি ছবি ছাড়া তার মুখ খুব কমই দেখা গেছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই হাক্কানীর সন্ধান চেয়ে ৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে যেই পোস্টার ছাপিয়েছিল, সেই পোস্টার থেকেই তার এই ছবি পাওয়া গেছে। হাক্কানি নেটওয়ার্ক আফগানিস্তানের একটি দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী দল হিসেবে পরিচিত। হাক্কানি পরিবারের বিরুদ্ধে আফগান বেসামরিক নাগরিকের উপর হামলা, হত্যা ও অপহরণের মত মারাত্মক সব অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। তবে হাক্কানি জোর দিয়ে বলছে, তার পরিবারের এই ধরনের কোনো নেটওয়ার্ক নেই; তারা এখন নিজেদেরকে তালেবানের অংশ হিসেবে দাবি করছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হলেন তালেবান প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের বড় ছেলে মোল্লা ইয়াকুব। তিনিও পশ্চিমাদের নিষিদ্ধ তালিকার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তি।
তবে, এটি কেবল একটি তত্ত্বাবধায়ক মন্ত্রিপরিষদ।
কাবুলে সংবাদ সম্মেলনে, সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সাংস্কৃতিক কমিশনের ডেপুটি হেড আহমাদউল্লাহ ওয়াসিক বলেন, "আমরা এখনও সব মন্ত্রণালয় এবং প্রতিনিধিদের নাম ঘোষণা করিনি; সুতরাং এই তালিকাটি বাড়ানো হবে।"
বিশ্লেষকরা ধারণা করেছিলেন, সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেবেন মোল্লা বারাদার। কিন্তু তাদের ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে মোল্লা আখুন্দ হঠাৎ করেই আলোচনার শীর্ষে উঠে এসেছেন।
এছাড়া তালেবানরা আগের প্রশাসনের রাজনৈতিক নেতাদেরও সরকার ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করতে চান না। কারণ তালেবানের মতে তাদের অধিকাংশই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত।
এ পর্যায়ে তালেবানের শান্তি আলোচক এবং বর্তমান উপ -পররাষ্ট্রমন্ত্রী শের মোহাম্মদ আব্বাস স্টানিকজাইয়ের একটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন-তালেবান সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের সময় তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আফগান জনগণ, যারা তালেবানের প্রত্যাবর্তনকে ভয় পাচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্যে তিনি কী বলবেন। তখন স্টানিকজাই অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন, "আমি তাদেরকে বলবো, আমরা এমন একটি সরকার গঠন করবো যা সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।"
এখানে তিনি "সংখ্যাগরিষ্ঠ" শব্দটির ব্যবহার বেশ জোর দিয়েই করেছিলেন।
নারী আলোচকদের তারা আশ্বস্ত করেছিলেন, সরকার ব্যবস্থায় মন্ত্রীর পদ ও রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়া নারীরা অন্য সব দায়িত্বে থাকতে পারবে।
কিন্তু এটি যখন তারা বলেছিল, সেসময় আর বর্তমান সময়ের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। তালেবানরা এখন ক্ষমতার আসনে।
যারা তালেবানদের সেসব প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করেছিল তাদেরকে আলোচক এবং সাবেক এমপি ফওজিয়া কওফি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, "যারা আফগানিস্তানের সামাজিক কাঠামোর দিকে মনোযোগ দেয় না তারা মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।"
সেই চ্যালেঞ্জ ইতিমধ্যেই রাস্তায় নারী বিক্ষোভকারীরা বুঝতে পেরেছে। সেই সঙ্গে সারা বিশ্বও দেখেছে তালেবানরা তাদের প্রতিশ্রুতি কীভাবে রক্ষা করছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিবৃতিতে তালেবানদের সতর্ক করে বলা হয়েছে, "বিশ্ব গভীরভাবে তাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছে।"
রাশিয়ার নেজাভিসিমায়া গেজেটা -এর একটি সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, "তালেবানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির সুযোগ কমে আসছে।"
এছাড়া, তালেবানের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে থেকেও একটি নতুন ধরণের চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে।
একজন তরুণ আফগান সম্প্রতি বিবিসি'র প্রতিবেদককে বলেছেন, "আমাদের অবশ্যই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে।"
তিনি জোর দিয়ে বলেন, "যদি তালেবানরা আবার আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে, তাহলে তারা আবারও ক্ষমতাচ্যুত হতে পারে; ঠিক যেভাবে ২০০১ সালে তাদের পতন হয়েছিল।"
আরেকজন অস্বস্তি প্রকাশ করে বলেন, "মোল্লারা শুধুমাত্র ধর্মীয় বিষয়েই শিক্ষিত হয়, তাদেরকে এত পদ দেওয়া ঠিক হচ্ছেনা।"
তত্ত্বাবধায়ক মন্ত্রিসভা ঘোষণার পরপরই জারি করা এক বিবৃতিতে আমির উল্লেখ করেন, "সকল মেধাবী এবং পেশাদার ব্যক্তিদের তাদের প্রতিভা, নির্দেশনা এবং কাজ দেশের জন্য খুবই প্রয়োজন।"
তবে তার সব নির্দেশনায়, এটাও স্পষ্ট ছিল, তারা "ইসলামিক আমিরাত" প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এবং এই বিষয়টিকেই তারা সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে।
বিশ্বের প্রধান সাহায্য সংস্থাগুলো, যারা পুরনো সরকারের বাজেটের প্রায় ৮০ শতাংশই প্রদান করতো, তারা নতুন তালেবান সরকারকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
এছাড়া, বিশ্বব্যাপী ইসলামী শরিয়া আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একটি নতুন ইসলামী শাসনব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়েছিল, এমন জিহাদি আন্দোলনকারী গোষ্ঠীর নজরদারিতেও রয়েছে আফগানিস্তানের নতুন নেতারা।
চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সম্ভাব্য নিরাপদ আশ্রয় হয়ে ওঠার সতর্কতা, মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ এবং ক্ষুধা ও কষ্টের গভীরতর মানবিক সংকটকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আফগানিস্তান। অনেক নেতারাই হয়তো এইসব সংকট কাটিয়ে ওঠার পথ খুঁজবেন, অনেকেই হয়তো জনগণের উপর কঠোরতা চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে থাকবে। নতুন সরকারের কার্যক্রমের প্রেক্ষিতে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ছুটে চলেছে দেশটি।
তবে বিশ্ব নেতাদের সেই মন্ত্রটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে; কথা নয়, কাজই এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সূত্র- বিবিসি