অবাক মাছ ধরা!
দক্ষিণ চীন সাগরের বুকে জেগে থাকা দেশ তাইওয়ানের উত্তর উপকূলজুড়ে সার্ডিন মাছের ছড়াছড়ি। আর এই মাছটি ধরতেই জেলেরা আশ্রয় নেন এক ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির।
বড়শি কিংবা নানা ধরনের জাল দিয়ে বিশ্বের অঞ্চলভেদে জেলেদের মাছ ধরার প্রচলন থাকলেও তাইওয়ানের জেলেরা ব্যবহার করেন আগুন।
রাত নেমে আসলে জেলের দল সমুদ্রে নৌকা ভাসান।
এরপর একটি লাঠির মাথায় অ্যাসিটিলিন গ্যাস দিয়ে আগুন জ্বেলে দেন জেলেরা। সেই আগুনে পানি দিলে তা আরও জ্বলে ওঠে।
এরপর দেখা যায় এক অদ্ভুত দৃশ্য। পানি থেকে মাথা উচিয়ে আগুনের উজ্বল আলোর দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে সার্ডিন মাছ। জেলেরা তখন সেগুলোকে জালে ঢুকিয়ে ফেলেন।
মাছ ধরার সময়, গ্যাসের তীব্র গন্ধ মিশে যায় বাতাসে।
শতাব্দীব্যাপী তাইওয়ানের উত্তরাঞ্চলের স্থানীয় জেলেরা আগুন দিয়ে মাছ ধরার ঐতিহ্যবাহী এই পদ্ধতিকে টিকিয়ে রেখেছিলেন।
নিউ তাইপেই শহরের সাংস্কৃতি বিষয়ক বিভাগের তথ্যানুসারে, ক্যালসিয়াম কার্বাইড যোগে মাছ ধরার কৌশলটির প্রথম সূত্র মেলে প্রায় এক শতাব্দী আগে; যখন দ্বীপটি শাসন করতো জাপানিরা।
ধারণা করা হয়, এ অঞ্চলে শতবর্ষ ধরে বসবাসরত 'বাসায়' নামক আদিবাসী গোষ্ঠীর কাছ থেকেই প্রথাটি এসেছে।
দশক ছয়েক আগেও, মে থেকে আগস্টের মাঝে প্রায় ১০০টি মাছ ধরার নৌকা সমুদ্রকে নরম হলুদ আগুন শিখায় আলোকিত করতো। তবে, এখন সার্ডিনের চাহিদা ও মূল্য উভয়ই কমে যাওয়ায়, তাইওয়ানে আজ একটি মাত্র 'ফায়ার ফিশিং বোট' রয়েছে।
শতাব্দী ধরে চলমান প্রথা
তাইওয়ানের একজন ভ্রমণ আয়োজক সু চেং-চেং এ ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার মিশনে নেমেছেন।
২০১২ সাল থেকে, সু উত্তর তাইওয়ানের গ্রামীণ উপকূলীয় শহর জিনশানে নিয়মিতভাবে ভ্রমণের ব্যবস্থা করে যাচ্ছেন, যেন পর্যটকরা শতাব্দী পুরনো এই ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন এবং এর প্রশংসা করতে পারেন।
তিনি বলেন, আগেকার দিনে আগুন ব্যবহার করে মাছ ধরার এই অভ্যাস ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছিল; কারণ তাইওয়ানের জনপ্রিয় এই পদ্ধতি সার্ডিন ধরতে ছিল শতভাগ কার্যকর।
সিএনএনকে তিনি আরও বলেন, "আগের দিনগুলোতে সার্ডিন মাছের পরিচিতি ছিল, একটি সুস্বাদু খাবার হিসেবে। এই মাছ স্বাদে মিষ্টি এবং এতে রয়েছে ছোট ছোট হাড়, তাই এটি ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ। মাছটি সাধারণত সয়া সসে ভিজিয়ে, আদাকুচির সঙ্গে কড়াইতে ভাজা হয়।"
সার্ডিন সাধারণত গ্রীষ্মকালে ধরা পড়ে; কারণ এই সময়ে মাছটি প্রশান্ত মহাসাগর দিয়ে উত্তর তাইওয়ানের তীর বরাবর জলস্রোত অনুসরণ করে।
মাছ ধরার স্থানে নৌকাটি পৌঁছানোর পর, একজন জেলে আগুন জ্বালেন। তিনি তার মাছ ধরা দলের কাছে "ফায়ার চিফ" নামে পরিচিত। তিনিই তার দলকে সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে জল যোগ করার নির্দেশ দিয়ে থাকেন।
সার্ডিন আলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে জল থেকে লাফিয়ে, আগেই পেতে রাখা মাছ ধরার জালে ঢুকে পড়ে।
তবে, ধীরে ধীরে এই ঐতিহ্যটি ম্লান হয়ে যাচ্ছে। কারণ এলাকায় সার্ডিনের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে; সেইসঙ্গে মাছটির চাহিদাও দিন দিন কমে আসছে এবং দামেও সস্তা হয়ে উঠছে। যার ফলে অনেক জেলেই সার্ডিন ধরা বাদ দিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন, যা এই শিল্পকে ফেলেছে বিলুপ্তির মুখে।
ঐতিহ্য রক্ষা
ষাট বছর বয়সী সু বলেন, তিনি এই ঐতিহ্য রক্ষা করতে এবং ধরে রাখতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। কেননা এটি তাইওয়ানের স্থানীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
তিনি বলেন, "আমার মনে হচ্ছিল, এটি শীঘ্রই বিলুপ্ত হতে চলেছে।"
ইকো-ট্যুরের নেতৃত্বদাতা সু আরও বলেন, তিনি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন; কারণ এর সঙ্গে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের রয়েছে গভীর সম্পর্ক।
যেহেতু সার্ডিন ধরা এখন আর লাভজনক নয়, তাই সু-এর ভ্রমণ থেকে যা আয় হয়, তা দিয়েই জেলেদের দিন চলে। এবং এভাবেই তারা এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চেষ্টা করছেন, সেইসঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এর প্রচার চালাচ্ছেন।
এ ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ এবং এ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে, ২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার আগুন দিয়ে মাছ ধরার এই প্রথাকে "সাংস্কৃতিক সম্পদ" হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
আশার আলো
সার্ডিনের চাহিদা এবং আয় কমে যাওয়ায় যখন এ পেশা থেকে অনেক জেলেই অবসর নিচ্ছেন, তখন ২৮ বছর বয়সী চিয়েন শি-কাই পারিবারিক ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য এই পেশাতেই যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে, কীভাবে আগুন দিয়ে সার্ডিন ধরতে হয় তা শিখতে শুরু করেছেন চিয়েন।
তিনি বলেন, "আমার বাবা একটি ফায়ার ফিশিং বোটের মালিক, তাই আমার এই ব্যবসায় যোগদানের সিদ্ধান্ত খুবই স্বাভাবিক।"
ইতোমধ্যে, চিয়েন এবং সু একত্রিত হয়েছেন।
সমুদ্রে যেন সার্ডিনের সংখ্যা ব্রৃদ্ধি পায় সে উদ্যোগও নিয়েছেন সু।
পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সু প্রতি গ্রীষ্মে সার্ডিন ধরার আয়োজন করেন। চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টার সার্ডিন শিকারের সেই সময়ের তোলা ছবি ও ধারণ করা ভিডিওচিত্র প্রচার করা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এছাড়া, পর্যটকদের সামনে এ সময় যে পরিমাণ মাছ ধরা হয়, তার অধিকাংশই ছেড়ে দেওয়া হয় কৃষ্ণসাগরে।
সু মনে করেন, এটি ভবিষ্যতে মাছের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।
তিনি আশা করেন, তার বর্তমান ব্যবসায়িক মডেলটি পুরনো এই ঐতিহ্যকে টিকে থাকার সুযোগ করে দিতে পারে।
তিনি বলেন, "যদি মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং আমাদের এই উদ্যোগ যথেষ্ট অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করতে পারে, তাহলে হয়তো নতুন জেলেরাও এই ব্যবসায়ে যোগ দেবেন এবং ঐতিহ্যটি পুনরুজ্জীবিত হবে।"
- সূত্র-সিএনএন