শ্রমিক ধর্মঘটে স্থবির রপ্তানি বাণিজ্য, আটকে আছে ৬৫০ কোটি টাকার পণ্য
ক্রিসমাসকে কেন্দ্র করে ইউরোপ-আমেরিকায় রপ্তানির জন্য বেসরকারি আইসিডি কেডিএস লজিস্টিকসে পণ্য নিয়ে এসেছিল রপ্তানিকারকরা।
কিন্তু শ্রম আইন লঙ্ঘন করে প্রাইম মুভার শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, গ্রাচুয়িটি সহ ন্যায্য পাওনা না দেওয়ায় গত ছয় দিন ধরে ধর্মঘট কর্মসূচী পালন করছে প্রাইম মুভার চালক ও শ্রমিকরা।
ধর্মঘটের কারণে কন্টেইনার ভর্তি এসব পণ্য জাহাজীকরণের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে নেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে গত ৬ দিনে কেডিএস লজিস্টিকসে জমেছে ২ হাজার ৫৩৬ টিইইউস রপ্তানি পণ্যের কন্টেইনার। এতে আটকা পড়েছে ৬৫০ কোটি টাকার রপ্তানি পণ্য।
জাহাজের শিডিউল মিস হওয়ায় সময়মতো এসব পণ্য বিদেশী ক্রেতাদের হাতে না পৌঁছলে পণ্য বিক্রি বাবদ বিশাল অংকের এই টাকা পাওয়া যাবে কিনা এ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছেন রপ্তানিকারকরা। পণ্যের টাকা না পেলে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী মাসে তাদের প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার কর্মীর বেতন দিন পারবেন কিনা সে নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছে তৈরী পোষাক শিল্পের মালিকরা।
শিপিং এজেন্ট জিবিক্স লজিস্টিকসের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মুনতাসির রুবাইয়াত টিবিএসকে বলেন, "চট্টগ্রাম বন্দর থেকে 'এসওএল হিন্দ' ও 'এসওএল বাংলাদেশ' নামের দুটি জাহাজে দুই দিনে আমাদের ২৮৩ টিইইউস রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার নিয়ে আগামী ৯ অক্টোবর সিঙ্গাপুর বন্দরে পৌছানোর কথা ছিলো। সেসব পণ্যের গন্তব্য ছিলো ইউরোপ আমেরিকায়।
কিন্তু কেডিএস লজিস্টিকসে প্রাইম মুভার চালক ও শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে এসব কনটেইনার জাহাজীকরণ করা যায়নি। ফলে ওই দুটি জাহাজসহ মোট তিনটি জাহাজ ৪০৫ টিইইউস রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার না পেয়ে বন্দর ছেড়েছে"।
তিনি বলেন, "সামনে ক্রিসমাসকে ঘিরে এসব পণ্য তৈরি করা হয়েছিলো। সিঙ্গাপুর পৌঁছে, ১১-১২ অক্টোবর মাদার ভেসেল বা বড় জাহাজে করে সেই রপ্তানি পণ্য ইউরোপ-আমেরিকায় যেত। কিন্তু শ্রমিকদের ধর্মঘটে এটা হলো না। ক্রিসমাসের আগে যদি পণ্য না পৌঁছায় তাহলে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে ব্যবসায়ীদের।"
৩০ সেপ্টেম্বর থেকে স্টাফ হিসেবে স্থায়ী নিয়োগপত্র, গ্র্যাচুয়িটি এবং কর্মঘণ্টাসহ বিভিন্ন দাবিতে কেডিএস লজিস্টিকস-এ প্রাইম মুভার চালক ও শ্রমিকরা টানা ছয়দিনের ধর্মঘট পালন করছে। এতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে। ডিপোতে আটকে পড়া এসব রপ্তানি পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে কবে জাহাজীকরণ করতে পারবেন, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার এসোসিয়েশনের (বাফা) পরিচালক খায়রুল আলম সুজন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "টানা ধমর্ঘটের কারণে সোমবার ( ৪ অক্টোবর) সন্ধ্যা পর্যন্ত ইউরোপ-আমেরিকাগামী ২ হাজার ৫৩৬ টিইইউস কন্টেইনার তৈরী পোষাক শিল্পের পণ্য জাহাজীকরণ করা যায়নি।"
তিনি জানান, প্রতি টিইইউসে গড়ে ৩০ হাজার ডলারের পণ্য থাকে। সেই হিসেবে ৭ কোটি ৬০ লাখ ৮০ হাজার ডলার বা ৬৫১ কোটি ৯৮ লাখ ৮৯ হাজার ৩৮৪ টাকার পণ্য ডিপোতে আটকে আছে। সঠিক সময়ে এসব পণ্য ক্রেতার কাছে পাঠানো নিয়ে শংকা তৈরী হয়েছে।
সংগঠনটির হিসেবে, প্রতিদিন দুই থেকে তিনটি জাহাজ কেডিএস লজিস্টিকসের রপ্তানি পণ্য ছাড়াই চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়ছে। ১ অক্টোবর থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত ৬৭৫ একক কনটেইনার না পেয়েই ১১টি জাহাজ বন্দর ছেড়েছে।
বিজিএমইএর সহ-সভাপতি রকিবুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "স্বাভাবিকভাবে অফডক থেকে কন্টেইনার ভর্তি করে রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণ করা হয়। তাই টানা ধমর্ঘটের কারণে রপ্তানিকারকরা বিরাট ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছেন"।
"ব্যবসায়ীদের ক্ষতির এ দায় কেডিএস লজিস্টিকস ও শ্রমিক নেতা উভয়ের উপর বর্তায়। দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে ইতোমধ্যেই স্থবিরতা নেমে এসেছে। দু'একদিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ছাড়া এ সমস্যার সমাধান হবে না," বলেন রকিবুল আলম।
যেভাবে শ্রম আইন লঙ্ঘন করছে কেডিএস
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ৫ ধারা মোতাবেক, কোন মালিক নিয়োগপত্র প্রদান না করলে কোন শ্রমিককে নিয়োগ করতে পারবেনা। নিয়োজিত প্রত্যেক শ্রমিককে ছবিসহ পরিচয়পত্র প্রদান করতে হবে।
কিন্তু কেডিএস লজিস্টিকস গত ১৫ বছরেও তাদের চালক ও চালকের সহকারীদের কোন ধরনের পরিচয়পত্র প্রদান করেনি।
প্রাইমমুভার ট্রেইলর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাইনুদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "২০০ চালক ও ২০০ হেলপার দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে কেডিএস লজিস্টিকসে কর্মরত আছেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় চাকরি করার পরেও তাদের কোনো পরিচয়পত্র নেই, নেই গ্র্যাচুয়িটি। এসব শ্রম আইনের লঙ্খন। বেশ কয়েকবার কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে বলেছি। এখনও বৈঠক চলছে, তবে কোনো সমাধান হয়নি।"
"আজ (মঙ্গলবার) সমাধান না হলে আগামী ৬ তারিখ আমরা কেডিএস লজিস্টিকসের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবো। ৭ তারিখ সারা চট্টগ্রামের প্রাইমমুভার চালকরা ধর্মঘট পালন করবেন। এরপরেও সমাধান না হলে ৮ তারিখ সারা দেশে ধর্মঘট পালন করা হবে," বলেন মাইনুদ্দিন। তবে দাবি আদায়ে ধর্মঘটকারীদের নিজেদের কর্মচারী মানতে নারাজ কেডিএস কর্তৃপক্ষ।
কেডিএস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "যে শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন তারা কেডিএস লজিস্টিকসের কেউ না। এরা মূলত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্মী। গত পাঁচ বছর ধরে তারা এ সমস্যা করছে। এভাবে চলতে থাকলে আমরা বাইরের প্রতিষ্ঠান দিয়ে কাজ করাতে বাধ্য হব।"
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল সাকিব মুবাররাত দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কেডিএসের দাবি ঠিক নয়। শ্রম আইন অনুযায়ী থার্ড পার্টি দিয়ে কাজ করালেও মূল প্রতিষ্ঠানের কাছে শ্রমিকদের দাবিদাওয়া থাকবে। এসব শ্রমিকদের পরিচয় ও বেতন-ভাতা কেডিএস লজিস্টিকসকেই নিশ্চিত করতে হবে। এ ঘটনায় আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করছি।"
কেডিএস লজিস্টিকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম জানান, কেডিএস লজিস্টিকের কন্টেইনার ধারণ ক্ষমতা ৭ হাজার টিইইউএস। ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে পণ্য আনা-নেওয়ার কাজ বন্ধ থাকায় আইসিডি থেকে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বন্দরে কনটেইনার জট সৃষ্টি হচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বলেন, "ধর্মঘটের কারণে রপ্তানি পণ্যবোঝাই কনটেইনার নির্দিষ্ট সময়ে জাহাজীকরণ করা যাচ্ছে না। নির্দিষ্ট সময়ে বিদেশি ক্রেতার কাছে পণ্য পাঠাতে রপ্তানিকারক ব্যর্থ হলে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব তৈরী হবে"।