দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় কোভিড-১৯ যেভাবে বৈশ্বিক সরবরাহ চক্রকে ব্যাহত করছে
কারখানা কার্যক্রমের প্রাণচাঞ্চল্য কেড়ে নেয় দক্ষিণপূর্ব এশিয়া জুড়ে সংক্রমণের নয়া প্রাদুর্ভাব, যা কোভিড-১৯ মহামারি থেকে এ অঞ্চলের পুনরুদ্ধারকে ঝুঁকির মুখে ফেলার পাশাপাশি পোশাক, মোটরগাড়ি ও ইলেকট্রনিক্সের মতো নানান পণ্যের বৈশ্বিক সরবরাহে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে।
কাঁচামালের বৈশ্বিক দরবৃদ্ধির সাথে তাল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে এশীয় উৎপাদন খাত, তার ওপর চাপছে করোনাভাইরাস জনিত বিধিনিষেধ। যেকারণে অনেক কোম্পানি তাদের কারখানা সম্পূর্ণরুপে বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়, কেউ কেউ কার্যক্রম আংশিকভাবে বন্ধ রেখেছে বা সীমিত পরিসরে উৎপাদন কাজ চালাচ্ছে।
চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্রমহ্রাসমান লক্ষণও এতে নতুন মাত্রা যোগ করছে।
অথচ আঞ্চলিক উৎপাদন কেন্দ্র বলেই পরিচিত ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো প্রভাবিত দেশগুলো। তারা বিশ্বের বৃহৎ বেশকিছু ভোক্তা ব্রান্ডের জন্য পণ্য উৎপাদন করে।
একনজরে ভিয়েতনামের চিত্র:
গত এপ্রিল থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের তরঙ্গ ভিয়েতনামের বড় বড় শহর ও শিল্পাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে, কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েই কড়া লকডাউন আরোপ করে। এতে ইলেকট্রনিক্স, পোশাক ও পাদুকা উৎপাদনের মতো শ্রমঘন শিল্প কারাখানাগুলোকে কার্যক্রম স্থগিত রাখা অথবা সীমিত পরিসরে চালু রাখার মতো সিদ্ধান্ত নিতে হয়। গত কয়েক সপ্তাহে অবশ্য কিছুটা শিথিল হয়েছে এসব বিধিনিষেধ।
অ্যাপল, স্যামসাং-সহ অন্যান্য বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলীয় শিল্পাঞ্চলগুলোয়, ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবও প্রথমে সেখানেই আঘাত হানে।
ফলে গত মে'তে উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ বাক গিয়াং- এর প্রশাসন চারটি শিল্প পার্ক অস্থায়ীভাবে বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। এরমধ্যে একটি পার্কে তাইওয়ানের বিখ্যাত ইলেকট্রনিক্স উৎপাদক ফক্সকনের কারখানাও ছিল।
তারপর ভিয়েতনামের দক্ষিণাঞ্চলেও ছড়ায় প্রাদুর্ভাব। জুলাইয়ে হো চি মিন সিটি-সহ আশেপাশের প্রদেশগুলোয় কড়া লকডাউন জারি হয়।
ওই মাসেই নাইকি ও অ্যাডিডাসের জন্য জুতা উৎপাদক তাইওয়ানের পু চেন কর্প ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটি ও চাংশিনে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম স্থগিত করে। অন্যদিকে, নাইকির জন্য জুতা উৎপাদক একটি দক্ষিণ কোরীয় কোম্পানি তাদের তিনটি কারখানা বন্ধ রাখে।
উৎপাদন গতি হারানোয় ইতোমধ্যেই ২০২২ সাল পর্যন্ত বিক্রিবাট্টার পূর্বাভাস কর্তন করেছে নাইকি, এমনকি আসন্ন ছুটির মৌসুমেও পণ্য ঘাটতির ব্যাপারে ক্রেতাদের সতর্ক করেছে।
ভিয়েতনামে প্রাদুর্ভাবের কারণে অ্যাপলের নতুন আইফোন ক্রেতাদের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। কারণ এ ডিভাইসের ক্যামেরা মডিউল সেদেশেই সংযোজন করা হয়।
ভিয়েতনামের টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্প সমিতি জানিয়েছে, বেশকিছু আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ভিয়েতনাম থেকে তাদের কার্যাদেশ অন্য দেশে নিয়ে গেছে। সরবরাহে দেরীর কারণেও জরিমানা দিতে হয়েছে দেশটির ৬০ শতাংশ পোশাক ও জুতা উৎপাদককে।
দুর্ভোগে মালয়েশিয়া:
মালয়েশিয়ায় গাড়ি ও সেমিকন্ডাক্টর চিপ প্রস্তুতকারক বেশ কিছু কোম্পানি জানিয়েছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় মহামারি জনিত বিধিনিষেধে তাদের সরবরাহ চক্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গত জুনে সংক্রমণ রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছানোর পর জাতীয় লকডাউন দেয় মালয়েশিয়া, অবশ্য জুলাই থেকে উৎপাদন খাতের জন্য তা ধীরে ধীরে শিথিল করা হয়।
তবে ক্ষতি ঠেকানো যায়নি, বিশ্বের ৬৭ শতাংশ রাবার গ্ল্যোভ সরবরাহকারী মালয়েশিয়ার গ্লোভ উৎপাদকেরা জুন ও জুলাই মাসজুড়ে কার্যক্রম স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়।
এসটি মাইক্রোইলেকট্রনিক্স ও ইনফিনিওন- এর মতো ইউরোপের বৃহৎ সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদক কোম্পানিতে সরবরাহকারী কারখানা রয়েছে মালয়েশিয়ায়, আছে টয়োটা মোটর কর্প ও ফোর্ড কর্পের মতো অন্যতম মোটরকার উৎপাদকদের কারখানাও।
গত জুলাইয়ে এসটি মাইক্রোইলেকট্রনিক্স সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে মালয়েশিয়ায় তাদের সংযোজন প্ল্যান্ট ১১ দিন বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়।
আগস্টে জার্মান চিপ উৎপাদক ইনফিনিওন জানায়, শাটডাউনের কারণে তাদের মাল্টি মিলিয়ন ডলার লোকসানের মুখ দেখতে হবে।
মালয়েশিয়ায় প্রাদুর্ভাবের কারণে গাড়ি উৎপাদনকারীরা সেমিকন্ডাক্টর চিপের স্বল্পতার মধ্যে পড়েছেন। আগস্টে ফোর্ড মোটর কর্প এ সমস্যার কথা উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রে একটি কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। কারখানাটিতে নিজেদের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত পণ্য- পিকআপ ট্রাক উৎপাদন করতো কোম্পানিটি।
থাইল্যান্ড:
জুলাই ও আগস্টে ব্যাংকক-সহ ঝুঁকিপূর্ণ প্রদেশগুলোয় কড়াকড়ি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়।
এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো কারখানা শাটডাউন ঠেকাতে থাই সরকার 'বাবল অ্যান্ড সিল' কৌশল গ্রহণ করে। এ পদ্ধতিতে কোভিড-১৯ সংক্রমিতকে হাসপাতালে পাঠানোর সাথে সাথে আক্রান্তের ঘনিষ্ঠদের অন্যান্য কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়।
কিন্তু, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় সংক্রমণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় বেশ কিছু কোম্পানিকে উৎপাদন বন্ধ রেখে কারখানা জীবাণুমুক্ত করতে হয়েছে। চ্যারোয়েন পোকফ্যান্ড ফুডস, থাই প্ল্যাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল এবং সোমবুন অ্যাডভান্স টেকনোলজির মতো বড় কোম্পানির কারখানাও এর আওতায় পড়ে।
যন্ত্রাংশ স্বল্পতায় গত জুলাইয়ে থাইল্যান্ডের মোট তিনটি প্ল্যান্টে গাড়ি উৎপাদন স্থগিত করে টয়োটা মোটরস।
অথচ এশিয়ার চতুর্থ বৃহৎ মোটরযান সংযোজন কেন্দ্র থাইল্যান্ড। এখান থেকে উৎপাদিত গাড়ি রপ্তানি করে টয়োটা ও হোন্ডার মতো বৈশ্বিক জায়ান্ট।
সীমান্তে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও কোয়ারেন্টিনের কারণে অভিবাসী শ্রমিকের সংকটও বেড়েছে, যা থাই কৃষিখাতকে ক্ষতির মুখে ফেলে, কমেছে রাবার ও খাদ্য উৎপাদন।
প্রক্রিয়াজাত ফল উৎপাদক সিয়াম এগ্রো-ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে ৫৫০ ধরনের কাজের সুযোগ থাকলেও, কর্মী স্বল্পতার কারণে কোম্পানিটি মাত্র ৪০০ ধরনের কাজে নিয়োগ দিতে পেরেছে। সীমান্ত বন্ধ থাকার কারণে নিজ দেশে ফিরে যাওয়া তাদের অনেক অভিবাসী কর্মীই আর থাইল্যান্ডে ফিরতে পারেনি।
- সূত্র: রয়টার্স