'স্কুইড গেম'-এ চাঙা কোরিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি
উৎপাদন খাতে দক্ষিণ কোরিয়ার দোর্দণ্ড প্রতাপের কথা বহু আগে থেকেই সর্বজনবিদিত। কিন্তু স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত শো 'স্কুইড গেম' দেশটির সাংস্কৃতিক প্রভাবকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে, যা একইসঙ্গে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিরও ইঙ্গিত দিচ্ছে।
কোরিয়ান পপ ও টিভি ড্রামাগুলো বেশ কয়েক বছর ধরে বিদেশে জনপ্রিয়তা পেলেও, বয় ব্যান্ড বিটিএসের মতো হাতেগোনা অল্প কিছু কোরিয়ান বিনোদন কনটেন্টই এশিয়ার বাইরেও সমানভাবে মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছে। কিন্তু 'স্কুইড গেম' এখন বিশ্বব্যাপী নেটফ্লিক্সের সর্বকালের সবচেয়ে বেশি দেখা শোতে পরিণত হতে যাচ্ছে, এবং এর মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে কোরিয়ান সংস্কৃতির দৃশ্যপটেও আসতে চলেছে বড় ধরনের পরিবর্তন।
২০২০ সালের অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র 'প্যারাসাইট'-এর সাফল্যের পর কোরিয়া থেকে নির্মিত নতুন নেটফ্লিক্স শোতে দেখা যায়, দেনার দায়ে জর্জরিত জনগণ একটি প্রাণঘাতী সারভাইভাল গেমে লড়াই করছে। এটি খুব সহজেই বৈশ্বিক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে, এবং এর মাধ্যমে প্রতিফলিত হচ্ছে কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান সফট পাওয়ারের চিত্র। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এটি দেশটির সাংস্কৃতিক রপ্তানিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে আরও বড় ভূমিকায়ও দাঁড় করাতে পারে।
নেটফ্লিক্স জানাচ্ছে, তাদের ব্যবসা গত বছর কোরিয়ার অর্থনীতিতে ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যোগ করেছে। তবে সামগ্রিকভাবে তাদের বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি নামে-ভারে ক্রমশ নতুন উচ্চতায় উঠে যাচ্ছে। নিচের তিনটি চার্টের মাধ্যমেও তা দেখা যাচ্ছে :
বিনোদন রপ্তানি
কোরিয়ার সুবিশাল উৎপাদন খাতের সঙ্গে তুলনা করলে তাদের কনটেন্ট ইন্ডাস্ট্রিকে বেশ ছোটই বলা যায়। কিন্তু এর উন্নতির ধারা যথেষ্ট স্থিতিশীল। কনটেন্ট রপ্তানির মাধ্যমে তারা গত বছর আয় করেছে ১০ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ পরিমাণটি কোরিয়ার অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি চিপসের এক-দশমাংশ মাত্র। তবে ইতোমধ্যেই কনটেন্ট ইন্ডাস্ট্রি অন্য অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি দ্রব্য যেমন হোম অ্যাপ্লায়েন্স ও কসমেটিকসের চেয়ে বেশি আয় করছে।
কোরিয়ার বিনোদন রপ্তানির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত প্রকাশনা, গেমস, মিউজিক, মুভি ও টিভি শো। গত বছর মহামারির কারণে সামগ্রিকভাবে পণ্যের রপ্তানি হার ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হ্রাস পেলেও, বিনোদন রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ।
কোরিয়া ফাউন্ডেশন ফর ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল এক্সচেঞ্জের (কোফিস) মতে, এমনকি তথাকথিত কোরিয়ান ওয়েভের সঙ্গে সম্পর্কিত যেসব ভোক্তা পণ্য, যেমন কসমেটিকস, পোশাক ও খাদ্যদ্রব্যের রপ্তানিও গত বছর বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
পর্যটক আকর্ষণ
চীনের উপর নির্ভরতা
কোরিয়ার পর্যটন খাত অনেক বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল এশিয়ান ভ্রমণকারীদের উপর।
কোরিয়ান সোপ অপেরা ও আইডল তারকাদের তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে কোভিড আক্রমণের আগের বছরগুলোতে দেশটিতে চীনা পর্যটকদের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু এই অতি-নির্ভরশীলতা দেশটির পর্যটন খাতের ভঙ্গুরতার নেপথ্য কারণে পরিণত হয়েছে।
২০১৭ সালে কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্সের মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম স্থাপনের জের ধরে কোরিয়া-চীন সম্পর্কে চিড় ধরে। ফলে দেশটিতে চীনা ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে পর্যটন খাতে বিরাট ধস নামে। সে বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে ০ দশমিক ৪ শতাংশ ক্ষতি হয়।
২০১৯ সালে কোরিয়ার ইনবাউন্ড ট্যুরিস্ট অর্থাৎ বাইরে থেকে ভ্রমণে এসে আবার ফিরে গেছে এমন পর্যটকদের মধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশই দেশটিতে এসেছিল পপ কালচারের অভিজ্ঞতা এবং ফ্যান ইভেন্টে অংশ নিতে। কোফিসের মতে, ওই পর্যটকরা মোট খরচ করেছিল ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
কোরিয়ার জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো তাদের পর্যটক গোষ্ঠীর ভিত্তির বিস্তৃতি এশিয়া মহাদেশ ছাপিয়ে বিশ্বের অন্যান্য জায়গাতেও ছড়িয়ে দেয়া। পপ কালচারের ক্রমবর্ধমান আবেদন এক্ষেত্রে হতে পারে বিশেষ সহায়ক।
চাকরি সৃষ্টি
সফট পাওয়ার
নতুন কর্মসংস্থান ও চাকরির সুযোগ বৃদ্ধিতে কোরিয়ার সৃজনশীল খাত অন্যান্য খাতকে পেছনে ফেলে দিয়েছে।
আকারে এখনও বেশ ছোট হলেও, বিনোদন এখন প্রযুক্তির পাশাপাশি কোরিয়ার সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল খাত। স্ট্যাটিসটিকস কোরিয়ার ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত উপাত্ত জানাচ্ছে, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সৃজনশীল ও শৈল্পিক পরিষেবায় কর্মজীবীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৭ শতাংশ। একই সময়ে কোরিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি যে উৎপাদন খাত, সেখানে কর্মজীবীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ।
গত মাসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে কোরিয়ায় বিনোদন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট খাতে তারা ১৬,০০০ ফুল-টাইম চাকরি সৃষ্টি করেছে। নেটফ্লিক্সের হিসাব মতে, এই সময়কালে তারা দেশটির অর্থনীতিতে অবদান রেখেছে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
- অনুবাদ: জান্নাতুল নাঈম পিয়াল
- সূত্র: ব্লুমবার্গ