কোভিড-১৯ মহামারি শেষ করতে এখন যা লাগবে
কোভিড-১৯ মহামারি শেষ হতে সম্ভবত বেশি দেরি নেই। ডেল্টার প্রাদুর্ভাব কমে যাওয়ার পাশাপাশি সেপ্টেম্বরের শুরু থেকেই কোভিডের শনাক্ত সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা এখনো সুনিশ্চিত না হলেও মানুষ আশাবাদী হতে শুরু করেছে। কিন্তু এই জনস্বাস্থ্য সংকটকে অতিক্রম করতে আমাদের করণীয় কী?
প্রথমেই আমাদের মেনে নিতে হবে যে কোভিড-১৯ এত সহজে আমাদের ছেড়ে যাবে না। নিউজিল্যান্ডের মতো দেশও শেষ পর্যন্ত কঠোরভাবে কোভিড নিয়ন্ত্রণের 'জিরো-কোভিড' পলিসি থেকে সরে এসেছে। এই নীতি অনুসারে কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হলেই গণহারে পরীক্ষাসহ আশেপাশের এলাকায় কঠোর লকডাউন আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। 'জিরো-কোভিড' পলিসি থেকে সরে আসার অর্থ কোভিডকে এখন জনজীবনের অংশ হিসেবে মেনে নেওয়ার বিকল্প নেই।
আমাদের একইসঙ্গে আরও দুটি বাস্তবতাকে স্বীকার করতে হবে। প্রথম বিষয়টি হলো, হঠাৎ করেই কোভিড ভাইরাসের প্রাণঘাতী প্রভাব কমে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। এমনকি, নতুন অভিযোজন ঘটিয়ে ভাইরাসটি আরও ভয়াবহ ও সংক্রামক রূপও ধারণ করতে পারে। তবে, এর থেকেও খারাপ জিনিস ঘটতে পারে। ভাইরাসের এমন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব ঘটতে পারে যা বিদ্যমান সকল ভ্যাকসিনের কার্যকারিতাকেই নাকচ করে দিতে সক্ষম।
দ্বিতীয়ত, গণহারে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনার মাধ্যমে গোষ্ঠীগত অনাক্রম্যতা অর্জন করার চেষ্টা অব্যাহত রাখলেও খুব দ্রুত আমরা সংক্রমণ কমাতে সক্ষম হব না।
বিশিষ্ট সংক্রমণ ব্যাধি বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি এস ফাউচি বলেছেন, "যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হওয়ার উচিত দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা ১০ হাজারের নিচে নিয়ে আসা। বিষয়টি ভয়াবহ শোনাতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমাদের অতটুকু অর্জন করে ধরে রাখার মতো অবস্থাও নেই। মাত্র ৫৭ শতাংশ মার্কিন নাগরিক পূর্ণাঙ্গভাবে ভ্যাকসিন নিয়েছেন। মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক করার ক্ষেত্রেও রয়েছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।"
শিশুদের জন্যও ভ্যাকসিন সহজলভ্য করার সময় এসেছে। একথা সত্যি যে শিশুরা এই ভাইরাসের সংস্পর্শে আসলেও সাধারণত বড়দের মতো অসুস্থ হয়ে পড়ে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোভিডে আক্রান্ত হয়ে শত শত শিশু মারা গেছে। চারটি সংক্রমণের ঘটনার মধ্যে অন্তত একটিতে শিশুরা সংক্রমিত হচ্ছে। পরিবারের শিশু সদস্যরা টিকা না নেওয়া পর্যন্ত টিকা গ্রহণকারী অন্য সদস্যদেরও সতর্ক থাকতে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সীদের জন্য ফাইজারের টিকাদান নিয়ে আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ ছয় মাস থেকে চার বছর বয়সী শিশুদের টিকাদান সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করার আশাবাদও ব্যক্ত করেছে ফাইজার। এমন হলে আগামী বছরের শুরুতেই হয়তো ছোট শিশুরাও ভ্যাকসিন পাওয়া শুরু করবে।
এছাড়া, কোভিডের জন্য মুখে সেবন করা সম্ভব এমন চিকিৎসাও সহজলভ্য করা দরকার। তবে, এর জন্য আমাদের সম্ভবর দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হবে না।
মার্কিন ফার্মাসিউটক্যাল প্রতিষ্ঠান মার্ক 'মনুপিরাভিয়ার' নামের একটি অ্যান্টিভাইরাল পিল থেকে অভূতপূর্ব ফলাফল লাভের কথা জানিয়েছে। এই পিল হাসপাতালে ভর্তি বা মৃত্যুহার প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে বলে প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছে।
পাঁচদিন ধরে দিনে দুইবার এই পিল সেবন করতে হবে। কোভিডের প্রথম দিককার বিশেষায়িত ট্রিটমেন্ট ছিল মোনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি থেরাপি। শিরায় সঞ্চালনের মাধ্যমে একাধিক শট দেওয়া এই চিকিৎসা পদ্ধতির তুলনায় মুখে সেবনের বড়ি অনেক সহজ চিকিৎসা হবে।
পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে অ্যান্টিভাইরাল পিল দিয়ে কোভিড-১৯ সারবে না। শুরুতেই ভ্যাকসিন গ্রহণ কিংবা ভাইরাস প্রতিরোধ করাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
তবে, এখনও বহু মানুষ টিকা গ্রহণ করেননি। সেক্ষেত্রে পিল সেবনে রোগীর হাসপাতাল শয্যার প্রয়োজন অর্ধেক কমে গেলে অন্তত আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর থেকে চাপ কমবে। একইসঙ্গে রক্ষা পাবে অগণিত প্রাণ।
মনুপিরাভিয়ার এখন পর্যন্ত শুধু টিকা গ্রহণ করেননি এমন ব্যক্তিদের ওপর পরীক্ষা করা হয়েছে। তবে, ভ্যাকসিন গ্রহণের পরেও যারা করোনা আক্রান্ত হন তাদের ক্ষেত্রেও গুরুতর অসুস্থতা কমাতে এই বড়ি সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইনফ্লুয়েঞ্জার ওষুধ ট্যামিফ্লু সাধারণত চিকিৎসার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধেও কার্যকর। গবেষকরা তাই মনুপিরাভিয়ারের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও যাচাই করবেন। মার্ক ছাড়াও ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান রশ এবং ফাইজার মুখে খাওয়ার ওরাল অ্যান্টিভাইরাল নিয়ে ক্লিনিকাল ট্রায়ালের শেষ ধাপে রয়েছে।
অর্থাৎ, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই টিকাদান এবং চিকিৎসা মিলে কোভিড-১৯ প্রাণঘাতী থেকে সাধারণ সর্দি-কাশির ফ্লুতে পরিণত হতে পারে।
তবে, এর বাইরেও আমাদের আরও একটি জিনিসের প্রয়োজন হবে। আর তা হলো বিনামূল্যে দ্রুত করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা।
অ্যান্টিভাইরাল বড়ি এবং অ্যান্টিবডি সঞ্চালনের এই দুই পদ্ধতি কেবল সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে গুরুতর অবস্থায় যাওয়ার হাত থেকে রোগীকে রক্ষা করতে পারে। এর অর্থ হলো, খুব দ্রুত আমাদের করোনা রোগী শনাক্ত করতে হবে। এছাড়া, করোনা সংক্রমণের প্রায় অর্ধেকই ঘটে থাকে উপসর্গহীন আক্রান্তদের মাধ্যমে।
কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ করতে উপসর্গবিহীন এই আক্রান্ত ব্যক্তিদের ভাইরাস ছড়ানোর পূর্বেই শনাক্ত করতে হবে।
ব্যবসায়িক পরিসরে কানাডা বিনামূল্যে দ্রুত শনাক্তকরণ পরীক্ষার সুবিধা দিচ্ছে। সিঙ্গাপুর ও জাপানে নামমাত্র মূল্যে ভেন্ডিং মেশিনের সাহায্যেই করোনা পরীক্ষা করা সম্ভব। পরিবারের সদস্যরা যদি ঘরে বসেই সপ্তাহে দুবার করোনা পরীক্ষা করাতে পারেন তাহলে স্কুলগামী শিক্ষার্থী ও অফিসগামী অভিভাবকরাও নিশ্চিন্ত হতে পারবেন। বিয়ে, জন্মদিন কিংবা অন্য কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদানের পূর্বে সহজ র্যাপিড টেস্টের প্রচলন করা গেলে কোভিড-১৯ সামাজিকতার ক্ষেত্রেও আর বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
ভ্যাকসিন ও ওষুধের পাশাপাশি করোনা পরীক্ষাও সহজলভ্য করতে হবে। কিন্তু, দুঃখজনক হলেও এক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি নেই।
ভ্যাকসিনের মতো করোনা পরীক্ষার ক্ষেত্রেও আমাদের জোর উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। বিনামূল্যে দ্রুত ও সহজে কোভিড শনাক্ত করা সম্ভব হলে কর্মক্ষেত্র, স্কুল-কলেজ, ভ্রমণ কিংবা জনসমাগমে যোগদানেও তেমন কোনো বাধা থাকবে না।
মহামারির সমাপ্তি অসম্ভব কিছু নয়। ইতোমধ্যেই আমরা কোভিডের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ধাপগুলো পার করে এসেছি বলে আশা করা যেতে পারে। কোভিড ভাইরাসকে হয়তো জনজীবন থেকে পুরোপুরি উৎখাত করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা যদি সঠিক সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করতে পারি, তাহলে কোভিড আমাদের জীবনে আর তেমন কোনো প্রভাব খাটাতে পারবে না।
- সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট