আমার ‘নৃত্যশিল্পী’ পরিচয় লুকানোর জন্য লোকজনকে বাবা বলতেন, আমি ফিজিক্সে পড়ি: পূজা সেনগুপ্ত
জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী ও নির্দেশক পূজা সেনগুপ্ত। গড়ে তুলেছেন 'তুরঙ্গমী রেপার্টরি ড্যান্স থিয়েটার' ও 'তুরঙ্গমী স্কুল অব ড্যান্স'। এখানে নিয়মিত নাচের চর্চা ও পারফরমেন্সের সুযোগ পাচ্ছেন নৃত্যশিল্পীরা।
দেশের পাশাপাশি দেশের বাইরেও নিয়মিত নাচের শো ও উৎসবে অংশ নিচ্ছেন তিনি। এসব নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে।
শুরুতেই তার কাছে জানতে চাই, 'দেশে এখন নাচের অবস্থা কেমন?'
বেশ কিছু তথ্য যুক্ত করে পূজা সেনগুপ্ত বলেন, "খুবই ভালো। আমরা শুধু দেশেই খুব ভালো করছি এমন নয়, দেশের বাইরেও আমাদের কাজ বাড়ছে। সুযোগ বাড়ছে। যেমন ইউনেস্কোতে আমাদের দেশ থেকে নাচের প্রতিনিধিরা যাচ্ছেন। তারা নাচের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা বলছেন। পাশাপাশি এখন দেশে নানা উৎসবে আলাদা করে নাচকে রাখা হচ্ছে। যেমন মুজিববর্ষে আমরা 'অদম্য' নামে একটা পারফরমেন্স করছি। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আমরা আগে বিদেশি নাচগুলোকে গ্রহণ করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এখন সেটা হয় না।"
'২০১৮ সালে ফিলিপাইনে আমি যখন আরতী নাচের ওপর ওয়ার্কশপ করালাম, তখন প্রায় এক হাজার ড্যান্স ইনস্ট্রাক্টর আমার সেই ওয়ার্কশপে অংশ নিয়েছিলেন এবং তারা তাদের নাচের মধ্যে আমাদের নাচ ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা শুধুই বিদেশিদের কাছ থেকে নিলাম, কিন্তু কিছুই দিলাম না- তা ঠিক হবে না। তারা যখন আমাদেরটা গ্রহণ করছেন, তার মানে আমরা একটা পর্যায়ে এসেছি বলা যায়,' যোগ করেন তিনি।
তবে নিজের দেশের নাচ দেশের বাইরে পৌঁছে দিতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি পূজা সেনগুপ্তকে। নিজে ভারতের রবীন্দ্রভারতীতে পড়াশোনা করেছেন নাচ নিয়ে। সেটাও স্কলারশিপ পেয়েই পড়তে গিয়েছিলেন। ২০১১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সেখানে পড়েছেন।
পড়াশোনা শেষ করে দেশে এসে পূজা সেনগুপ্তের উপলব্ধি হলো, 'আমি একজন প্রফেশনাল ড্যান্সার এবং কোরিওগ্রাফার, এটা রিসিভ করার জন্য সোসাইটি একদমই প্রস্তুত ছিল না। সোসাইটি শুধু না, নিজের পরিবারও প্রস্তুতও ছিল না। আমার সামনে তেমন কোনো আইডলও ছিল না, যাকে দেখিয়ে বলতে পারি বা ভাবতে পারি, আমি তার মতো হতে চাই। আমাদের দেশে নাচ শেখাতে পারলেই মনে করা হয় নাচের শিল্পী। কিন্তু তা নয়, নাচের শিল্পী ও শিক্ষক দুটা একেবারেই আলাদা।'
আর আলাদা কিছু করবেন বলেই রবীন্দ্রভারতী থেকে পড়াশোনা করে এসে গড়ে তোলেন নিজের নাচের দল 'তুরঙ্গমী রেপার্টরি ড্যান্স থিয়েটার'। শুরু করেন নাচ নিয়ে একটা যুদ্ধ। চাইলে ভালো কোনো চাকরি করতে পারতেন। পাশাপাশি শখের বসে নাচ। কিন্তু পূজা সেটা করেননি। নাচ নিয়েই সামনে এগোতে চেয়েছেন। তবে টাকার জন্য টেলিভিশন চ্যানেলে ও ইভেন্টে উপস্থাপনা করেছেন। সেটারও কারণ আছে। উপস্থাপনা করে যে টাকা পেতেন, সেটা জমিয়ে নাচের প্রোডাকশনের জন্য খরচ করতেন।
পূজা বলেন, 'শুরুতে আমরা শোয়ের জন্য স্পন্সর পেতাম না। কিন্তু নাচের প্রোডাকশনের অডিও, রিহার্সেল এবং শো-টা শেষ অবধি নামানো, এসবের জন্য তো খরচ ঠিকই হতো। আমার উপস্থাপনার টাকা দিয়ে সেটা করতাম। তারপর ধীরে ধীরে মানুষ আমাদের নাচ পছন্দ করা শুরু করল এবং ধীরে ধীরে স্পন্সর পাওয়া শুরু করলাম।'
"তবে আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জটা ছিল নিজের পেশার পরিচয় দেওয়া। ব্যাংকে যখন ক্রেডিট কার্ড করতে যাই, তখন ব্যাংক থেকে জানতে চাইল, 'আপনার প্রফেশন কী?' বললাম, 'নৃত্যশিল্পী।' মাসিক আয় কত, সেটাও জানতে চাইল। এটাই বিপদ, আমাদের তো নির্দিষ্ট কোনো আয় নেই। একেক মাসে একেক রকম। অনুরোধ করলাম, 'আমার পুরো ব্যাংক স্টেটমেন্টটা দেখুন এবং আমি প্রতি বছর ইনকাম ট্যাক্স দিই- সেটা দেখুন, তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিন।' তারা সেটা যাচাই করে রাজি হলেন এবং আমি প্রফেশনাল নৃত্যশিল্পী হিসেবে ক্রেডিট কার্ড পেলাম," যোগ করেন তিনি।
পূজা আরও বলেন, "বাবা-মার সঙ্গে যখন কোনো দাওয়াতে যেতাম, তখন কেউ এসে যখন জিজ্ঞেস করত, আমি কী করি? তখন আমি উত্তর দেওয়ার আগেই আমার বাবা বলতেন, 'ও ফিজিক্সে পড়েছে।' যেন নাচটা বলার মতো কিছু না!"
পূজা বলেন, 'ওই সময় যদিও আমি কখনো বলতাম, নাচের কোরিওগ্রাফার ও নৃত্যশিল্পী- তখন কেমন যেন নাক সিটকানো একটা ভাব ফুটে ওঠত প্রশ্নকর্তার মধ্যে। পরে আমি বাবা-মার সঙ্গে এসব প্রোগ্রামে যাওয়া বন্ধ করে দিই। পরে যখন দু-চারটা আন্তর্জাতিক উৎসবে যাচ্ছি এবং পত্রপত্রিকায় নিউজ প্রকাশ পাওয়া শুরু করল, তখন তারা ঘুরে গেলেন। তখন আমার নামে আলাদা করে ইনভাইটেশন কার্ড আশা শুরু করল। এটাই বোধহয় প্রাপ্তি।"
পূজা ভরত নাট্যমে পড়াশোনা করেছেন। শিখেছেন জ্যাজও। তবে নিজে সবচেয়ে বেশি শান্তি পান দেশের কোনো নাচ নিয়ে কাজ করতে পারলে। নিজের প্রোডাকশনের মধ্যে চেষ্টা করেন দেশের ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস তুলে ধরতে।
এ রকমই কয়েকটা প্রোডাকশন হলো 'ওয়াটারনেস', 'প্রতিকৃতি', 'অনামিকা সাগরকন্যা', 'নার্গিস', 'অদম্য বৈশাখী' প্রভৃতি। এরইমধ্যে ঢাকা, ঢাকার বাইরে এবং দেশের বাইরের দর্শকেরা এসব প্রোডাকশনের বেশ কিছু শো উপভোগ করেছেন। গত সাত বছরে ১৪টি প্রোডাকশন তৈরি হয়েছে 'তুরঙ্গমী রেপার্টরি ড্যান্স থিয়েটারে'র।
পূজা বলেন, 'একটা সময় ছিল, যখন শুধু যে কোনো গানের সাথে নাচকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। আমাদের বেলায় সেই সুযোগ নেই। আমরা নতুন মিউজিক করি এবং প্রপস, সেট সবই নতুন করে করি। পুরোটাই একটা পরিকল্পনার মাধ্যমে হয়।'
এসব করার জন্য নতুন নতুন তরুন-তরুণী দরকার হয়। এ কারণেই তিনি গড়ে তুলেছেন 'তুরঙ্গমী স্কুল অব ড্যান্স'। এখানে নতুন নতুন ছেলে-মেয়েরা নাচ শিখছেন, তারপর 'তুরঙ্গমী রেপার্টরি ড্যান্স থিয়েটারে'র মাধ্যমে প্রফেশনালি নাচের পারফর্ম করছেন, যেখানে সবাই সন্মানী পান।
পূজা সেনগুপ্ত বলেন, "২০১৯ সালে 'তুরঙ্গমী স্কুল অব ড্যান্স' ইউনেস্কোর ইন্টারন্যাশনাল ড্যান্স কাউন্সিলের সদস্যপদ পেয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও পেয়েছি। এটি বড় একটি প্ল্যাটফর্ম। আমাদের নাচে বিদেশি নাচের প্রভাব পড়েছে। আবার বাইরের দেশেও নাচের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। আদান-প্রদান যখন উভয়পক্ষ হতে হয়, তখন তা সম্মানজনক; এখন এই জায়গাটা তৈরি হয়েছে।'
কথা শেষ করার আগে আগে বলেন, 'আমার মা চাইতেন আমি যেন সবকিছু শিখি। নাচ, গান ছবি আঁকা, অভিনয়। সব জায়গায় মা আমাকে নিয়ে যেতেন। শিখতামও। কিছুদিন শেখার পর আমিই মাকে বললাম, শুধু নাচটাই করতে চাই। এটা আমাকে টানে বেশি। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয় পড়াশোনা ফিজিক্সে করলেও প্রফেশন হিসেবে বেছে নিলাম নাচ।'
পূজার মা গত বছর চলে গেছেন না ফেরার দেশে। পূজা বলেন, 'হয়তো সামনে অনেক সাফল্য আসবে। কিন্তু মাকে দেখাতে পারব না। এটাই দুঃখ।'