কর্ণফুলী টানেলের দুই প্রান্তেই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল ২০২২ সালের ডিসেম্বরে উদ্বোধনের কথা। কিন্তু, টানেলের দুই প্রান্তের সংযোগস্থলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি চিহ্নিত করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)।
এতে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হয়ে চালু হলেও ত্রুটিমুক্ত ও আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রকৃত সুফল পেতে লাগবে 'বাড়তি সময়'।
বর্তমান নকশায় টানেলের উত্তর প্রান্তের প্রবেশ মুখে মিলিত হয়েছে পাঁচটি সড়ক। সড়কগুলো হলো- আউটার রিং রোড, কাটগড় সড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, এয়ারপোর্টমুখী সড়ক, পতেঙ্গা বিচমুখী সড়ক এবং টানেলের প্রবেশ পথ। এতে এই মোড়ে যানজটের সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করছে সিএমপি।
সিএমপি আরও জানিয়েছে, আনোয়ারা প্রান্তে কোরিয়ান ও চায়না ইপিজেড, কর্ণফুলী সার কারখানা, পারকি সৈকতসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, বাঁশখালী ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং টেকনাফ পর্যন্ত প্রস্তাবিত নতুন মেরিন ড্রাইভ সড়কের যানবাহনের চাপ নিতে পারবে না। অথচ এই টানেল ব্যবহার করে মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণসহ টেকনাফের সাবরাংয়ে নতুন পর্যটন এলাকা গড়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে।
এতে কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলে পর্যটকবাহী যানবাহনের ভিড়ও বাড়বে।
টানেলের নির্মাণকাজ ৭৫ শতাংশ শেষ হওয়ার পর নকশায় ত্রুটি শনাক্ত করেছে সিএমপি। এখন ২০২২ সালের ডিসেম্বর নাগাদ বাকি কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
টানেলটি নির্মাণ করছে সেতু বিভাগ। দুই প্রান্তে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার নতুন ব্যবস্থা প্রণয়নে একটি কমিটিও গঠন করেছে সেতু বিভাগ, তবে এটি শেষ করতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে।
তার আগপর্যন্ত বর্তমানের ত্রুটিপূর্ণ ট্রাফিক নকশার আওতাতেই টানেলের ভেতর ট্রাফিক পুলিশ দিয়ে ম্যানুয়ালি যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যা কার্যকর ব্যবস্থা হবে না বলে জানিয়েছে সিএমপি।
ফলে ট্রাফিকের চাপ বাড়লে টানেলের ভেতরেই যানবাহনকে অপেক্ষা করতে হবে।
অন্যদিকে, ছুটির সময়ে টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে হাজার হাজার পর্যটক ও তাদের বহন করা বাহনের অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হবে। যা এই এলাকায় যানজট ও দুর্ঘটনা বাড়াবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিপুল এই ট্রাফিকের চাপ মোকাবিলায় ফরিদপুরের ভাঙা কিংবা ঢাকার কুডিল ফ্লাইওভারের মতো ভিন্ন ধরনের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সুপারিশ করেছে- সিএমপি।
নতুন ট্রাফিক ব্যবস্থা প্রণনয়নের উদ্যোগ:
গত ২২ সেপ্টেম্বর সেতু সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক চট্টগ্রাম সফরে এলে ত্রুটির বিষয়ে তাঁকে অবহিত করেন সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর। এরপর ত্রুটি দূরীকরণে সেতু সচিব সিএমপি কমিশনারকে প্রধান করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেন।
এই কমিটি গত ২৮ সেপ্টেম্বর সভায় মিলিত হয়ে দুটি কারিগরি উপ-কমিটি গঠন করে। উপ-কমিটির মধ্যে পতেঙ্গা প্রান্তের নকশা তৈরি করবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) আর আনোয়ারা প্রান্তের নকশা করবে সেতু বিভাগ।
এই বিষয়ে সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর টিবিএসকে বলেন, 'উভয় উপ-কমিটিই তাদের প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। আগামী বুধবার (৩ নভেম্বর) অনুষ্ঠেয় একটি বৈঠকে তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে টানেলের দুই প্রান্তে আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সুপারিশ থাকবে।'
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী হারুনূর রশিদ বলেন, 'আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে দুই টেকনিক্যাল কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে নকশা প্রণয়ন করা হবে। তবে আগে টানেলের কাজ শেষ হোক। এসব বিষয়ে পরে দেখা যাবে।'
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের পরিবহন বিষয়ক সম্পাদক প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, 'টানেলের সংযোগ সড়কের ডিজাইনের সময়ই পরিকল্পিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি চিন্তা করা দরকার ছিল। মাঝপথে এসে ত্রুটি চিহ্নিত হওয়া দুঃখজনক। এই সমস্যা দ্রুত সমাধান না হলে টানেলের সুফল পাওয়া যাবে না।'
আনোয়ারা প্রান্তে টোলপ্লাজা থেকে দুই কিলোমিটার দূরে চায়না ইপিজেডের একটি চৌরাস্তার সৃষ্টি হচ্ছে। টোলপ্লাজার সন্নিকটে বিপুল সংখ্যক গাড়ি চলাচলের জন্য সার্ভিস সড়ক নেই। ফলে পারকি বিচ ও কাফকো সার কারখানার গাড়ি যাওয়া-আসা করবে উভয়পথে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে চায়না ইপিজেড চৌরাস্তার মোড় থেকে। ওই চৌরাস্তায় যানজট নিরসনে পরিকল্পনা নেই।
সেতু কর্তৃপক্ষ, চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসিএল) ও অভি অরূপ অ্যান্ড পার্টনার্স হংকং লিমিটেড যৌথভাবে টানেল নির্মাণের কারিগরি ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা করে।
এরপর ২০১৪ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকালে দুই দেশের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে (সরকারের সঙ্গে সরকারের) সমঝোতা স্মারক সই হয়। চীন সরকারই সিসিসিসিএলকে এই টানেল নির্মাণের জন্য মনোনীত করে। এ বিষয়ে ওই বছরের ৩০ জুন সেতু কর্তৃপক্ষ ও সিসিসিসির মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি সই হয়।
২০১৫ সালের নভেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) নির্বাহী কমিটি কর্ণফুলী নদীর তলদেশে মাল্টি-লেন টানেল নির্মাণ প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়। ২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়ার জন্য নির্ধারিত এ প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল প্রায় ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা।
তবে ২০১৫ সালে অনুমোদিত হলেও প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। তখন প্রাথমিক ব্যয় লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়, যা এক হাজার ৯২৭ কোটি টাকা বেশি।
মোট ব্যয়ের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। ২ শতাংশ সুদে প্রকল্প সাহায্যের বাকি ৫ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক।
মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেন থাকবে। মূল টানেলের সঙ্গে পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক থাকবে। আর রয়েছে ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ওভারব্রিজ।