‘ফুটবলের সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদদের একজন’—রাংনিকের কাছ থেকে কী আশা করতে পারে ইউনাইটেড?
মৌসুমের শেষ পর্যন্ত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অন্তর্বর্তীকালীন ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত হতে চলেছেন জার্মান কোচ ও ফুটবল বিশেষজ্ঞ রালফ রাংনিক।
ওলে গুনার সুলশারের স্থলাভিষিক্ত হতে যাওয়া এই জার্মান তার প্রাথমিক ছয় মাসের দায়িত্ব পালন শেষে ক্লাবে পরামর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করবেন।
কিন্তু কী দেখে ইউনাইটেড এই জার্মানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে? তিনি কেমন ম্যানেজার? তার সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু এবং এ মৌসুমের পর তার ভূমিকা কী হবে?
এবং রাংনিকের নিয়োগ ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর জন্য কী অর্থ বহন করে?
নিয়োগ: 'বর্তমান বাজারে তার চেয়ে সেরা কেউ নেই'
অনেক যাচাই-বাচাই শেষেই রাংনিকের নাম প্রস্তাব করেছে ইউনাইটেড বোর্ড। একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জিনেদিন জিদান, আর্নেস্তো ভালভার্দের মতো বেশ কয়েকজন ম্যানেজারের সঙ্গেই যোগাযোগ করেছিল রেডডেভিলরা।
বিবিসি জানায়, এ সপ্তাহের শুরুতে রাংনিকের সঙ্গে হওয়া প্রাথমিক কথোপকথনেই মুগ্ধ হয় ইউনাইটেড বোর্ড। চিত্তাকর্ষক ফুটবলের জন্য খ্যাতি অর্জন করা এই ৬৩ বছর বয়সী নিজ দেশে স্টুটগার্ড, হ্যানোভার, হফেনহাইম, শালকা এবং আরবি লাইপজিগের মতো দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ফরাসি ফুটবল সাংবাদিক জুলিয়ান লরেন্স বলেন, "গত ২০ বছরে ফুটবলের সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদদের একজন তিনি। এবং এ সময়ে বের হয়ে আসা সব দুর্দান্ত জার্মান কোচদের অনুপ্রাণিত করেছেন তিনি।
"তিনি একজন নির্মাতা। এটাই তার কাজ। কিন্তু (ইউনাইটেডে) ছয় মাসে সেটা সম্ভব হবে না।"
রাংনিকের সঙ্গে পূর্বে কাজ করা সেন্ট লুই এসসির স্পোর্টিং ডিরেক্টর লুটজ ফানেনস্টিয়েল বলেন, "রালফ এখন পর্যন্ত যা করেছেন, তাতেই সফল হয়েছেন। এবং তিনি সবসময়ই বলেছেন, ইংল্যান্ডের বড় কোনো ক্লাবে কাজ করার সুযোগ পেলে তিনি করবেন।
"আমার মনে হয় অন্তর্বর্তীকালীন কোচের দায়িত্ব নিলেও সবকিছু স্থিতিশীল করে তিনি ইউনাইটেডকে আবার ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন। আমি মনে করি, বর্তমান বাজারে তার চেয়ে সেরা কেউ নেই।"
দর্শন: 'প্রেসিং, কাউন্টার-প্রেসিং, হাই-ইনটেনসিটি ফুটবল'
ম্যানেজার হিসেবে তেমন শিরোপা জেতেননি রাংনিক। কিন্তু আধুনিক ফুটবলে তার প্রভাব কম না।
তার সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে হফেনহাইম ও আরবি লাইপজিগের মতো দলগুলোকে একদম শূন্য থেকে গড়ে তোলা।
ফুটবলে আধুনিক প্রেসিংয়ের জনক হিসেবেই আখ্যায়িত করা তাকে। ইয়ুর্গেন ক্লপ, টমাস টুখেল, জুলিয়ান নাগেলসম্যান ও রালফ হাজনহুটলের মতো ম্যানেজাররা প্রভাবিত হয়েছেন তার দর্শনে।
ফানেনস্টিয়েল বলেন, "রাংনিকের দর্শক খুবই সরাসরি। প্রচুর প্রেসিং, কাউন্টার-প্রেসিং, হাই-ইনটেনসিটি ফুটবল, যা দেখতে সবসময়ই আকর্ষণীয়। তিনি খুবই স্পষ্টভাষী, অকপট স্বভাবের। এবং তিনি যা-ই করেন, একটি পরিষ্কার লক্ষ্য নিয়ে করেন।"
রাংনিকের দর্শন সম্বন্ধে তার সাবেক শিষ্য ক্রিশ্চিয়ান ফুচ বলেন, "তিনি কীভাবে খেলাতে চান এ ব্যাপারে তার পরিষ্কার ধারণা আছে। তার কোচিং ও প্রেসিংয়ের দর্শন কখনো বদলাবে না।"
রাংনিকের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের ব্যাপারে ফুচ জানান, অস্ট্রিয়া জাতীয় দলের সঙ্গে থাকাকালে একদিন তার সঙ্গে দেখা করতে চান এই জার্মান। তৎকালীন হফেনহাইম ম্যানেজার তার দর্শনের ব্যাপারে বিশদ বক্তৃতা দেওয়া শেষে ফুচকে বলেন, "কিন্তু এই মুহূর্তে আমার হয়ে খেলতে পারবে না তুমি।"
"সামনা-সামনি বসে এভাবে সরাসরি বলে দেওয়াটা বেশ ভালো লেগেছিল আমার। দুই বছর পর একদিন তিনি বললেন, এখন তোমাকে দলে ভেড়াতে চাই আমি," বলেন ফুচ।
এরপর রাংনিকের অধীনে শালকাতে যোগ দেন ফুচ। এই জার্মানের ম্যান-ম্যানেজমেন্ট সম্বন্ধে ফুচ বলেন, "তিনি জানেন কোন খেলোয়াড়ের কাছ থেকে তার কী লাগবে এবং তিনি খেলোয়াড়দের সবসময় সঙ্ঘবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেন। খেলোয়াড়দের একসাথে প্রচুর পরিশ্রম করতেও বাধ্য করেন তিনি।"
'হয়তো রাংনিকের দর্শন বদলাতে হবে, অথবা রোনালদোর নিজেকে বদলাতে হবে'
রাংনিকের ক্যারিয়ারে ইউনাইটেডই হতে যাচ্ছে প্রথম সত্যিকারের অভিজাত ইউরোপীয় ক্লাব। গত মৌসুমে লিগে রানার আপ হওয়া দলটি এই গ্রীষ্মেও দলে ভিড়িয়েছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোসহ তিনজন বিশ্বমানের খেলোয়াড়কে।
সবকিছু ঢেলে সাজানোতে ওস্তাদ রাংনিক ইউনাইটেডে সেই স্বাধীনতাটা পাবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থাকছেই। আর প্রেসিং ও কাউন্টার-প্রেসিং যার ফুটবল দর্শন, তার দলে রোনালদো কীভাবে মানিয়ে নিবেন তা নিয়েও থাকছে সন্দেহ।
জার্মান সাংবাদিক রাফায়েল হোইগস্টাইন বলেন, "রোনালদোকে যদি তিনি 'না' বলে দেন, তাহলে ব্যাপারটা কঠিন হয়ে যাবে। এটা তার জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি হবে। রোনালদো কি রাংনিকের ফুটবলে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন? হয়তো পারবেন। হয়তো রাংনিকের দর্শন বদলাতে হবে, অথবা রোনালদোর নিজেকে বদলাতে হবে। এই গল্পের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হতে যাচ্ছে এটি।"
ক্রীড়া সাংবাদিক গুইলেম বালোগ বলেন, "এটি একটি অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব, যা খোলা চোখে কিছুটা বিপজ্জনক মনে হচ্ছে। নতুন একটি কাঠামো তৈরি করার বেলায় রালফ বেশ ভালোভাবেই জানেন তার কী করতে হবে।
"পরিবর্তন চায় না এমন লোকদের সহ্য করতে পারেন না তিনি। কিন্তু আমি মনে করি ইউনাইটেডে এরকম মানুষ অনেক আছে।"
এদিকে হোইগস্টাইন বলছেন, "তিন বছরের চুক্তিতে আসা একজনের মতো কর্তৃত্ব নিশ্চয়ই থাকবে না তার। তবে যেহেতু আপনি জানেন মেয়াদ শেষই হয়ে যাবে আপনার, সেহেতু চাইলে যেকোনো কিছুই করতে পারেন আপনি। সুতরাং, আরও কড়া হতে পারেন তিনি," বলেন ।
ভবিষ্যৎ: 'পরামর্শকের দায়িত্ব সহজেই দুই বছর থেকে দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে'
২০১২ সাল থেকে বেশ কয়েকটি ক্লাবে স্পোর্টিং ডিরেক্টরের ভূমিকায় কাজ করেছেন রাংনিক। দুই রেডবুল ক্লাব, বিশেষ করে লাইপজিগে তার ভূমিকা প্রশংসা কুড়িয়েছে অনেক।
তিনি দায়িত্ব নেওয়ার সময় জার্মানির চতুর্থ ডিভিশনে থাকা লাইপজিগ কয়েক বছরের মাঝেই বুন্দেসলিগার শিরোপার জন্য লড়াই শুরু করে। বর্তমানে রাশিয়ান ক্লাব লোকোমোটিভ মস্কোর ক্রীড়া ও উন্নয়ন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
ছয়মাস অন্তর্বর্তীকালীন কোচের দায়িত্ব পালন করলেও ইউনাইটেডকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারেন তিনি স্পোর্টিং ডিরেক্টর বা এরকম কোনো ভূমিকাতেই। আপাতত খবর হচ্ছে, কোচের দায়িত্ব পালন শেষে পরামর্শকের ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হবেন এই জার্মান।
ফানেনস্টিয়েল বলেন, "আমরা জার্মানিতে তাকে ডাকি ফুটবলের অধ্যাপক বলে। তিনি যা করেন তা খুব চিন্তা-ভাবনা করেই করেন। প্রতিটি ক্লাবে তিনি যেভাবে কাঠামো স্থাপন করেন, তা সত্যিই আশ্চর্যজনক।
"রালফ, তার ক্যারিয়ার ও তার ফুটবলকে যতটা জানি, সে জ্ঞান থেকে বলছি, তিনি যদি এখানে এসে অবিশ্বাস্য উন্নতি করেন এবং সবাই খুশি হয়, তাহলে এই পরামর্শকের দায়িত্ব সহজেই দুই বছর থেকে দীর্ঘমেয়াদী হবে।"
সূত্র: বিবিসি।
অনুবাদ: কিরো আদনান আহমেদ।