সংস্কৃত, উর্দু, ফারসিতে স্নাতক, কিন্তু এ ভাষা পড়তে পারেন না
২০২১ সালের ৭ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ পেতে চাকরিপ্রত্যাশী ১১ জন মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন। ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে প্রার্থীরা সংস্কৃত পড়তে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খান। অথচ নিয়োগ পেলে শিক্ষার্থীদের এই ভাষাই শেখানোর কথা।
ভাইভা শুরু হলে প্রার্থীরা একের পর এক বোর্ডের সামনে নিজেদের প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন। যোগ্য প্রার্থী না পেয়ে শেষ পর্যন্ত কাউকেই সুপারিশ করতে পারেনি বোর্ড।
ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক ড. অসীম কুমার। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "পাঠ্যসূচিতে আমরা পরিবর্তন আনার কথা ভাবছি। শিক্ষার্থীরা যেন সংস্কৃত ভাষা নিয়ে যথাযথ জ্ঞান ধারণ করতে সেজন্য বর্তমান কারিকুলাম উন্নত করার পরিকল্পনা রয়েছে।"
তিনি বলেন, "কেউ সংস্কৃত পড়তে পারেনি এটা সত্যি নয়। অনেকেই ভালো করেছে। তবে আমরা আবার সার্কুলার জারি করব এবং যোগ্য প্রার্থী পাব বলে আশা করি।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে এরকম আরেকটি উদাহরণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগ তিন দফায় চেষ্টা করেও বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের জন্য যোগ্য প্রার্থী পায়নি। বিভাগটি ২০১৬ সাল থেকে তিনটি সার্কুলার জারি করলেও উর্দু ভাষায় পর্যাপ্ত জ্ঞানসহ শিক্ষক খুঁজে পেতে ব্যর্থ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে এই বিষয়ে যোগাযোগ করলেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে এই সমস্যা শুধু সংস্কৃত এবং উর্দু বিভাগের স্নাতকদের নিয়েই নয়। ঢাকা, রাজশাহী এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য এবং পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজের মতো বিভাগগুলো থেকে স্নাতক করা বহু শিক্ষার্থীই ভাষাগুলো ঠিকমতো পড়তে বা লিখতে জানেন না।
এই তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত, উর্দু, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য, পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগে সব মিলিয়ে তিন হাজার ৭১০ জন শিক্ষার্থী এবং ১২৮ জন শিক্ষক রয়েছেন।
প্রত্যেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাবাবদ প্রতি বছর গড়ে দেড় লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। এর অর্থ সরকার এই বিভাগগুলো পরিচালনা করতে ৫৬ কোটি টাকা ব্যয় করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সালে ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে স্নাতক অর্জনকারী শিক্ষার্থী সামিউল জানান, তার সহপাঠীদের ৬০ শতাংশই ঠিকমতো ফারসি ভাষায় লিখতে জানেন না। তাদের ফারসি পড়ার অবস্থা আরও খারাপ।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. ইমতিয়াজ আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "উদ্বেগের বিষয় এই যে উর্দু, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য, পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ এবং সংস্কৃত বিভাগের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পরীক্ষার সময় বাংলায় উত্তর লেখেন।"
"আমি মনে করি আলাদা বিভাগ না চালিয়ে বিষয়গুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজ নিজ ভাষা ইনস্টিটিউটের অধীনে নিয়ে আসা উচিত," বলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহ-উপাচার্য (অ্যাকাডেমিক) অধ্যাপক নাসরিন আহমেদ বলেন, "যোগ্য শিক্ষক না থাকায় এই বিভাগগুলো অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স পরিচালনা করার মতো অবস্থায় নেই।"
"ভাষার গভীর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য আছে এমন ব্যক্তিরা একসময় বিভাগগুলোর সাথে জড়িত ছিলেন। এখন এই বিভাগগুলো বিলুপ্ত করার সময় এসেছে, তাদের আর প্রয়োজন নেই," বলেন তিনি।
নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে অধ্যাপক নাসরিন বলেন, সংস্কৃত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের একজন শিক্ষার্থী তার সঙ্গে দেখা করতে অফিসে এসেছিলেন।
"আমি সংস্কৃত নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেই শিক্ষার্থীর সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক," বলেন তিনি।
তিনি বলেন, "উর্দু বিভাগের জন্য শিক্ষক নিয়োগ দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমি যোগ্য কাউকে পাইনি।"
২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগে ৪৩ জন শিক্ষার্থী ছিলেন। ২০১৮ সালে তারা মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাদের মধ্যে অনেকেই বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী এখনও বেকার।
দুঃখজনকভাবে কেউই উর্দু সাহিত্যে দক্ষ নন। অনেক শিক্ষার্থী উর্দু ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে যথাযথ ধারণা ছাড়াই অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেছেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে বিভাগের ২৫০ জন সাবেক শিক্ষার্থীর তালিকাও এসেছে যাদের মধ্যে কেবলমাত্র একজন সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় উর্দু প্রভাষক হিসেবে কাজ করছেন। বাকিদের কেউ এই বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। এমনকি কেউ কোনো গবেষণাও করছেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের সাবেক শিক্ষার্থী শাহীন আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "শিক্ষার্থীরা জানে যে ঠিকমতো উর্দু ভাষা শিখে তারা কোনো চাকরি পাবে না। আর তাই তারা দ্বিতীয় বর্ষের পর সবাই চাকরির পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়।"
"কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী উর্দু সাহিত্য সম্পর্কে কিছুটা জানেন এবং ঠিকমতো লিখতে পারেন। তবে অধিকাংশের জ্ঞানই প্রাথমিক পর্যায়ের। পরীক্ষায় খাতায় আমাদের বাংলা কিংবা ইংরেজি লেখার বিকল্প আছে। আর তাই উর্দুতে উচুঁমানের দক্ষতার দরকার হতো না," বলেন তিনি।
আসন কমানোর কথা ভাবছে ডিনস কমিটি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনস কমিটি সম্প্রতি সংস্কৃত, উর্দু, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য এবং পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগে অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের আসন সংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আরবি, ইসলামিক স্টাডিজ এবং ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতির মতো অন্যান্য অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগেও আসন কমানোর সুপারিশ করেছে ডিনস কমিটি ।
১৯৭০ সালে সংস্কৃত ও পালি বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ অবধি সংস্কৃত বাংলা বিভাগের একটি অংশ ছিল। ২০০৭ সালে সংস্কৃতকে পুরোপুরি আলাদা করা হয়।
ফারসি ভাষা বিভাগও উর্দু বিভাগের অংশ ছিল। ২০০৬ সালে ফার্সি ও উর্দু ভাষা দুটি পৃথক বিভাগে বিভক্ত হয় এবং ফারসি বিভাগের নাম হয় ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. মুমিত আল রশিদ টিবিএসকে বলেন, প্রতি বছর বিভাগটিতে ৮০-৯০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। তবে স্নাতক শেষ করার পর ফারসি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী কাউকে পাওয়া যায় না।
"আসলে একসাথে ৮০ থেকে ৯০ জন শিক্ষার্থীকে ভাষা শেখানো অসম্ভব। বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমানোর জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এখনও আমাদের দাবি পূরণ করতে পারেনি," বলেন তিনি।
বিভাগের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী বলেন, কোনো শিক্ষার্থী স্বেচ্ছায় ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হয় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী বলেন, "সংস্কৃত তো নয়ই, অন্য কোনো বিষয়েও শিক্ষার্থীরা পারদর্শী হতে পারেনি। তারা শুধু বিভাগে সময় নষ্ট করেছে।"
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আতাউর রহমান টিবিএসকে বলেন, বিভাগটি উর্দু ভাষায় গবেষণায় আগ্রহী গবেষক তৈরি করার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, উর্দু শুধু পাকিস্তানের ভাষা নয়, এর উৎপত্তি ভারতে। সুতরাং, গবেষণার মাধ্যমে স্নাতকদের ভাষার বিকাশে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়টি দেখবে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবে।"
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, "এই বিভাগগুলোর উচিত সীমিত সংখ্যক শিক্ষার্থীকে ভর্তির অনুমোদন দেওয়া, যারা গবেষণায় অবদান রাখবে।"
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অবশ্যই চিন্তা ও জ্ঞান উদ্ভাবনে মনোনিবেশ করতে হবে। একই সঙ্গে চাকরির ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জগুলোর কথা মাথায় রেখে শিক্ষার্থীদের পড়াতে হবে।
"কিন্তু অনেক বিভাগই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে ভর্তি করে, যারা স্নাতক শেষ করার পর ভাল চাকরি পেতে হিমশিম খাচ্ছে," বলেন তিনি।