কাজী আনোয়ার হোসেন মারা গেছেন, মাসুদ রানার জীবন কোন পথে!
বিদায় রানা, মারা গেছেন মাসুদ রানা। কাজী আনোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর প্রিন্ট মিডিয়া হোক বা সোশ্যাল মিডিয়া, ঝড় চলছে সবখানেই — মাসুদ রানা মারা গেছেন। আসলেই কি তাই!
মাসুদ রানার স্রষ্টা ছিলেন তিনি, তাই বলে তাঁর সঙ্গে বাংলা স্মার্ট সাহিত্যের কালজয়ী হিরো মারা যাবে কেন? দুই পুত্র কাজী শাহনূর হোসেন, কাজী মায়মুর হোসেন রয়েছে কিংবা অনাত্মীয় কোনো নতুন লেখক রানার অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতেও পারেন। তাই স্রষ্টা মারা গেলেই পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশের তারুণ্যকে উদ্দীপ্ত করা, স্মার্ট পাঠক তৈরী করা প্রিয় চরিত্রকে এখনই মেরে ফেলা ঠিক না!
চট্টগ্রামে সবে তখন বালক খোলস ছেড়ে বেরিয়েছি। স্টেশন রোডে 'মাসুদ রানা' নামে এক নতুন বইয়ের দোকান দেখে চমকে উঠলাম। বইয়ের দোকানের নাম হয় পুস্তক বিতান, কিতাবস্তান, জ্ঞানভান্ডার, বইঘর। কিন্তু কে এই মাসুদ রানা? দোকানের মাথায় বিশাল বোর্ডে শুধু একটি নাম : মাসুদ রানা!
এর আগেই স্কুল ফাঁকি দিয়ে আমার জিরো জিরো সেভেন জেমস বন্ডের 'ডক্টর নো' সিনেমা দেখা হয়ে গেছে। নিজেকে জেমস বন্ড ভাবা শুরু করে দিয়েছি। নিজের সাইকেলের চেইন কাভারে জেমস বন্ড জিরো জিরো সেভেন সাইন বোর্ডের দোকানে গিয়ে লিখিয়েছি।
চট্টগ্রামের ব্রিটিশ আমলের পুরানো লাল ইটের রেল স্টেশনের ভেতরে সুদর্শনদা (বড়ুয়া)-র একটি বইয়ের স্টল ছিলো। অভিনেতা বিশ্বজিতের মতো দেখতে ভেতরে বাইরে সুদর্শনদা সুন্দর মানুষ ছিলেন। তিনি জানতেন বই কিনে পড়ার সামর্থ্য আমার নেই। তাই স্টলে বসে পড়তে দিতেন। পরে কাভারের উপর নিউজপেপারের কাভার দিয়ে বাড়িতে বই নিয়ে যেতে দিতেন। তখনই দীপক কুমার রহস্য সিরিজের 'বানরের হিরক রহস্য' থেকে শুরু করে দস্যু বনহুর, দস্যু মোহন পার করে নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরীটিতে ছিলাম।
সিরিজের প্রথম বই 'ধ্বংস পাহাড়' পড়ে শেষ করতেই মাসুদ রানায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। মনে হলো এ তো বাংলার জেমস বন্ড, আমাদের স্পাই হিরো। ছোটবেলা থেকে দেখা স্টেশান রোডে চট্টগ্রামের তখনকার সব চেয়ে উঁচু অট্টালিকা (চারতলা) হোটেল মিসকাতে ভারতীয় সুন্দরী স্পাইয়ের সঙ্গে থাকতে ওঠে রানা। যে হোটেল ছোটবেলা থেকে স্কুলে যেতে আকাশের দিকে মুখ উঁচিয়ে দেখেছি।
প্রথম বই মাসুদ রানার 'ধ্বংস পাহাড়' পড়ছি আর শিহরণে কষ্ট পাচ্ছি, এক-একটি পৃষ্ঠা পড়ে বইটি শেষ হয়ে যাচ্ছে ভেবে। শেষ করে মনে হলো আমার কিছু না কিছু সাপোর্ট করা উচিত। জিরো জিরো সেভেনের মত রানার একটা সংখ্যা কোড থাকা দরকার মনে হলো। নিজেই ডিজাইন করে জিরো নাইন নাইন একটি পিস্তলের সলিড গ্রাফিকে ডাকে সেবা প্রকাশনীর ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।
সেই শিশু সুলভ ডিজাইনটি পাঠিয়ে যা আশা করিনি তাই হয়ে ছিলো। তিনি ধন্যবাদ জানিয়ে পোস্টকার্ড পাঠালেন। সিরিয়াসলি আমি রানার জন্যে সংখ্যা কোড ভেবে ডিজাইটি করে তাকে পাঠিয়েছি বলে।
এরপর দিন, মাস, বছরের পর বছর পেরুলো। চারুকলায় পাঠের ইচ্ছায় বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে একাই ঢাকায় চলে এলাম। নিজকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব নিজেই নিলাম। বিটপী এডভার্টাইজিং কোম্পানীতে ছোটখাটো আর্টিস্ট হিসেবে চাকরিও হলো। মগবাজার নয়াটোলার শেষ মাথায় এক রুমের বাসা নিলাম। আশেপাশের স্বচ্ছল পরিবারের আমার সমবয়সের আবু সাঈদ জুবেরী, বশীর, কাজী হাবীব, সারওয়ার লেখক বন্ধুও হলো।
লেখক সাংবাদিক রাহাত খান হয়ে উঠলেন আমার গুরুদেব। তখন তিনি সিদ্ধেশরী থাকতেন। ওনার চার সন্তানের অপু, নিপু একটু মাথা তুললেও শুভ্র আর কান্তা বেশ ছোট। আমি তাদের বাসায় গেলেই দৌঁড়ে এসে কোলে ঝাঁপিয়ে উঠে বলত ভূতের ছবি, গাছের ছবি, ফুলের ছবি কিংবা মানুষের ছবি এঁকে দিতে। রাহাত ভাই ইত্তেফাকে কাজ করতেন ঘরে তাই নিউজ প্রিন্ট কাগজের প্যাড আর বলপেনের ছড়াছড়ি।
বিটপীর বেতনে ঘর ভাড়া দিয়ে চলা মুশকিল। শ্রদ্ধেয় শিল্পী হাশেম খান যেমন চারুকলায় ভর্তির জন্যে নানাভাবে সাহায্য করতেন তেমনি পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জে পুঁথিঘর ও মুক্তধারা প্রকাশনীর কর্ণধার চিত্তদার (চিত্তরঞ্জন সাহা) কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন করে বাড়তি কিছু টাকা যাতে পাই।
চিত্তদা বল্লেন, 'ঠিক আছে, তবে করতে পারে কিনা দেখতে হবে। আরেক বিজ্ঞানী ইকবালের (জাফর ইকবাল) সায়েন্স ফিকশন বই মুক্তধারা থেকে বেরুচ্ছে। সেটির মাত্র একরঙে ডিজাইন করে যদি লেখক ও আমাকে পছন্দ করাতে পারো তাহলে কাজ পাবে।' ভাগ্যক্রমে দুইজনেরই বেশ ভালো লেগে ছিলো একটি মাত্র ডার্ক নীলে স্প্রে গান দিয়ে করা প্রচ্ছদ ডিজাইনটি।
পেটে একটু দানা পানি পড়তে আর্থিক চাহিদাও বাড়ে। তার উপর ছবি আঁকার রঙ ক্যানভাস অল্পস্বল্প হলেও কিনতে হয়। আর্থিক টান তাই পিছু ছাড়ে না। একদিন রাহাত ভাই জানতে চাইলেন রঙিন ইংরেজী ম্যাগাজিন ছিড়ে কোলাজ করে বইয়ের প্রচ্ছদ করতে পারবো কি না।
- পারব না কেন! আমার জন্যে তা আঁকার চেয়ে সহজ আর খরচও কম।
- ঠিক আছে তাহলে তোমাকে সেবা প্রকাশনীতে কাজী আনোয়ার হোসেনের কাছে নিয়ে যাবো।
- আপনি চেনেন ওনাকে? আমি আনন্দে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ছিলাম।
তিনি মুচকি হেসে গোঁফে আঙুল বুলিয়ে বললেন,
- মাসুদ রানা পড়েছো?
- আমি তো মহা ভক্ত।
- তাহলে তুমি মাসুদ রানার বসের নাম জানো না, এ কি কথা!
- ওহ মাই গড – রাহাত খান! মানে আপনি!
- আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবার তোমার ভাবীর আত্মীয়। মজা করার জন্যে লাগিয়েছে কাজী।
প্রিয় কাজী আনোয়ার হোসেনে সামনে সেবা প্রকাশনীতে রাহাত ভাই প্রথম আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন।
মুক্তধারার অর্ধেক পারশ্রমিক প্রতি কাভারে দিলেও মাসে কাজের সংখ্যা বেশি। বিটপীর ৩৫নং তোপখানা রোড থেকে পুরানা পল্টন পুরানো বই ম্যাগাজিনের দোকান হাঁটা পথ। গিয়ে গাদায় গাদায় পুরোনো টাইম নিউজউইক কিনি আর আমেরিকান সিগারেট 'মালব্রো'র ওয়েস্টার্ন রঙিন বিজ্ঞাপন ছিড়ে-জোড়া তালির কোলাজ করি। সেবার বিশেষ করে কাউবয় ওয়েস্টার্ন বইগুলোর অগুণতি প্রচ্ছদ ডিজাইন নিজের তাগিদেই করেছি।
কাজী আনোয়ার হোসেনের বাবা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জাতীয় অধ্যাপক সাহিত্যিক শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু কাজী মোতাহার হোসেন, মা সাজেদা খাতুন ১১ সন্তানের জনক। অকালে দুই-তিনজন মারা গিয়ে বাকি যারা ছিলেন সবাই শিক্ষা দীক্ষায় অনেক উপরে গেছেন। বালক বয়সে ভাই কাজী সুলতান হোসেনের সঙ্গে বিরাট পুকুরের গভীর জলে ডুব দিয়ে কে কতক্ষণ থাকতে পারে কম্পিটিশনে দুইজন ডুবে গিয়ে ছিলেন। অন্যরা জলে ঝাঁপিয়ে টেনে তুলতে সুলতান মৃত্য আর কাজী আনোয়ার পেলেন দ্বিতীয় জীবন।
বড় হয়েও কাউকে না জানিয়ে তিন-চার দিনের জন্যে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যেতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরিয়ে কোনো চাকরি-বাকরি করতেন না। ঘরে নিজের রুমে বসে বই পড়ে দিন-মাস-বছর পার করতে একদিন সবার চাপে নিচে রাস্তার সঙ্গে লাগোয়া খালি পড়ে থাকা একটি রুমে খুলে বসলেন চা বিস্কুটের দোকান 'বৈশাখী'। কাস্টমারের শ্রেণী ভেদাভেদ নেই, রিক্সা ড্রাইভারও আসছেন আবার পাশের সরকারী হিসাব রক্ষক অফিসের বাবুরা ও চা পানে আসছেন। তবু বেচা কেনার চেয়ে আড্ডাই বেশি।
একদিন পিতা কাজী মোতাহার হোসেন হাতে দশ হাজার টাকা ভরে একটি খাম হাতে নিয়ে নিচে নেমে বৈশাখীতে এলেন। টাকা কাজী আনোয়ার হোসেনের হাতে তুলে দিয়ে বললেন – 'আই এ পাশ করে দুইটি রহস্য উপন্যাস কুয়াশা ও ধ্বংস পাহাড় মাসুদ রানা লিখে পড়তে দিয়েছিলে আমাকে। তখন কিছু বলিনি তবে এখন বলছি আমার ভালোই লেগেছিলো এই টাকা নাও, একটা ছোট প্রেস মেশিন কিনে প্রকাশনী খুলে নিজের রহস্য লেখা নিজেই ছাপো।' সেই গোড়াপত্তন হলো সেগুনবাগিচা প্রেস ও প্রকাশনী। পরে ডানা কেটে সেবা প্রকাশনী।
কুয়াশা ও মাসুদ রানার প্রথম বই 'ধ্বংস পাহাড়' প্রকাশের ক'বছর পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু এবং দেশ স্বাধীন হয়। নতুন বাংলাদেশে বই দুইটি ভীষণভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মাসে সিরিজের দুইটি করে বই বেরুলেও চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। তখনই বুদ্ধি করে কম সময়ে বইয়ের পাঠক ডিমান্ড পূরণে বিদেশী স্পাই থিলার দুই কিংবা তিনটি বই থেকে অংশবিশেষ নিয়ে একটি কাহিনি করে দ্রুত সময়ে বই প্রকাশ করার আইডিয়া মাথায় আসে। কয়েকটি করে বই তিনিই বেছে যতটুকু অংশ নিতে চান ছিড়ে নিয়ে বইয়ের নির্বাচিত অংশের সাথে রাবারব্যান্ড দিয়ে তাঁর ঘোষ্ট রাইটারদের হাতে তুলে দিতেন অনুবাদ করতে। অনুবাদ ও কাহিনি এক লাইনে এনে রেডি হলে আবার তিনি সম্পূর্ণ দেখে ক্লাইমেক্স সঙ্গে শেষ করে প্রেসে পাঠাতেন ফাইনাল কপি ছাপতে।
তিনিই শুরু করে ছিলেন দ্রুত পাঠযোগ্য স্মার্ট এক বাংলা, যা আজ প্রিন্ট মিডিয়া ডিজিটাল মিডিয়া সব ক্ষেত্রেই সাদরে জায়গা করে নিয়েছে। সঙ্গে তৈরী করেছে তরুণ পাঠক। পরে হুমায়ুন আহমেদ ভিন্ন ধারায় নিজস্ব ভঙ্গিতে লিখলেও দেশভর্তি তৈরি পাঠককূল পেয়েছেন।
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর যে কোনো দেশে বড় শহরে এখনো এমন বাঙালি পাঠক আছেন। বিশাল এক শ্রেণী বাংলা বইয়ের মধ্যে একমাত্র মাসুদ রানা ও সেবা প্রকাশনীর বই ভাড়ায় নিয়ে পড়েন। পাঠ শেষে ভাড়া দিয়ে বই ফেরত দেন। আবার নতুন বই পড়তে ভাড়া নেয়। এই আকর্ষণ আর কোনো বাংলা বইয়ের প্রতি কেউ দেখেনি। এই টরন্টো শহরেই ডেনফোর্থ বাংলা টাউনে অন্যমেলা বাংলা বইয়ের দোকানে গেলে দেখবেন বুক সেলফে এই মাথা থেকে ঐ মাথা সাজানো রয়েছে মাসুদ রানা ও কুয়াশার সেবার বই। তরুণরা আট দশ ঘন্টা হাড়ভাঙা কাজ শেষ করে বাসায় যাওয়ার পথে মাসুদ রানা ভাড়া করে সঙ্গে নিয়ে যায়। এমন নেশা বাংলা আর কোন বইয়ে পাবেন পাঠক?
কাজী আনোয়ার হোসেন এবং স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন দুজনই নামী কন্ঠশিল্পী ছিলেন, পাকিস্তান রেডিওর তালিকাভুক্ত, চলচ্চিত্রেও প্লেব্যাক করেছেন। সুভাষ দত্তের 'সুতরাং' সিনেমায় কাজী আনোয়ার হোসেনের কন্ঠে গান রয়েছে। বাংলা গানে দুই পক্ষের আত্মজাদের আকাশছোঁয়া খ্যাতি। বোন সানজীদা খাতুন রবীন্দ্রনাথের গানের মহীরুহ, রবীন্দ্র গবেষক, লেখক, অধ্যাপক; বাংলাদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীতে নতুন প্রাণের জোয়ার আনা 'ছায়ানট' এর প্রধান প্রতিষ্ঠাতা। শ্যালিকা সাবিনা ইয়াসমিন সম্পর্কে আর কী বা বলার আছে। তিনি তো বাংলা গানের আকাশের নক্ষত্র।
আজ আমার এই লেখা মূলত প্রিয় কাজী আনোয়ার হোসেনের মৃত্যতে শ্রদ্ধা জানানো। তাঁর মা সাজেদা খাতুনের মৃত্যু বিষয়ে এক ঘটনা বলেই লেখা শেষ করি। বেশ কিছুদিন পিজি হাসপাতালের আইসিইউ-তে তাঁর মা মৃত্যুশয্যায় পড়ে আছেন। সে রাতে আইসিইউ-র ঠিক বাইরে একটি খালি রুমে কাজী আনোয়ার হোসেন জেগে থাকবেন। রাহাত খান রাত নয়টায় আমাকে নিয়ে সেখানে পৌঁছালেন। রুমে মাত্র তিনটি চেয়ার; একটিতে বই-খাতা-পেন আর গরম চায়ের ফ্লাক্স।
রাহাত ভাই বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, 'ইকবালকে তোমার সঙ্গে রাতে থাকতে রেখে গেলাম।' আমি হকচকিয়ে উঠলাম তবে না করার সাহস কিংবা সুযোগ কোনটাই হলো না। কাজী আনোয়ার হোসেন না করতে পারতেন। অথচ তিনি হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না। আমি রাহাত ভাই যাওয়ার পর খালি চেয়ার টেনে কাঁচে বড় জানালার পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বসে বাইরের আলো বারডেম হাসপাতাল ঘোলাটে আকাশ দেখতে লাগলাম। সারারাত তিনি একটি কথাও বললেন না, মাঝে মধ্যে বই খুলে ধরলেন। কখনো কিছু লিখলেন। বেশিক্ষণই চুপচাপ বসে রইলেন।
ভোরের আলো ফুটলো ধীরে ধীরে, রোদ ভরে উঠলো চারদিকে। কাজী আনোয়ার হোসেন প্যান্টের পকেটে হাতপুরে ২০ টাকার নোট বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে বললেন, 'নিচে রেস্টুরেন্ট থেকে নাস্তা করে নিও। আজই যেকোনো সময় আমার মা মারা যাবেন। আমি জেনে গিয়েছি তাই সারা রাত কথা বলিনি, ছোটবেলা থেকে বড়বেলা মায়ের সব কথা ভেবেছি।'
আমি আর কী বলবো! চুপ থেকেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। নিচে নেমে শাহবাগ মার্কেটের জমজমাট রেস্টুরেন্টে সুজির হালুয়া দিয়ে গরম লুচি আর চা খেয়েও টাকা বাঁচল। ছুটির দিন বিটপী অফিসে যাওয়ার তাগাদা নেই। তাই হেঁটে বাংলামোটর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লাইব্রেরিতে গিয়ে দুপুর পর্যন্ত বই পড়লাম। বেঁচে যাওয়া টাকার সঙ্গে কিছু আরো টাকা মিলিয়ে কেন্দ্রের ভেতরেই মুরগী বিরিয়ানি খেয়ে মনে হলো খবর নেয়া হয়নি কাজী আনোয়ার হোসেনের মা কেমন আছেন। তখন সেলফোনের চল ছিল না। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের রিসেপশনে বলে-কয়ে একটা ফোন করলাম সেবা প্রকাশনীতে। ম্যানেজার সাহেব ইসরাইল নাকি ইসমাইল নাম ছিল, তিনি ফোন ধরলেন। কন্ঠে তাড়াহুড়ো, 'স্যারের মা আজ মারা গেছেন, লাশ এখনো বাাড়ি আসেনি।' অবাক হয়েছিলাম তিনি রাতেই কীভাবে জানলেন তাঁর মা মারা যাবেন!
আজ আমি ঢাকা থেকে অনেক দূরে, এই টরন্টোতে বসে ভাবছি — কাজী আনোয়ার হোসেনও কি আগেই জেনে গিয়েছিলেন, আজ তিনি মারা যাবেন?