সাংবাদিকতা ছেড়ে কেন মেকওভার আর্টিস্ট হলেন ইশরাত?
"ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স করে এখন পার্লার খুলেছ! তোমার কী মনে হয় না তুমি এতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সিট নষ্ট করলে?"
বিয়ের মেকআপ করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক শিক্ষকের কাছ থেকে এমন কটূক্তি শুনতে হয়েছিল 'গ্ল্যাম আপ বাই ইশরাত'-এর স্বত্ত্বাধিকারী ইশরাতুল জাহান শোভাকে।
দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে যে শুধুই সরকারি-বেসরকারি চাকরির পেছনে ছুটতে হবে, তা বিশ্বাস করেন না ইশরাত। তাই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারের পাট চুকিয়ে নিজের উদ্যমে মেকওভার আর্টিস্টের কাজ শুরু করেন তিনি।
ঢাকায় এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যালে অবস্থিত পার্লার ও সেলোন 'গ্ল্যাম আপ বাই ইশরাত'। অনলাইনে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে নিজের বাসার একরুম থেকে শুরু করে রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে ২১০০ বর্গফুটের জনপ্রিয় পার্লারে পরিণত হওয়ার পেছনে আছে ইশরাতের অদম্য ইচ্ছা।
সাংবাদিক থেকে ইশরাতের বিউটিশিয়ান হয়ে ওঠার গল্পের শুরুটা হয় ২০১৮ সালের শেষের দিকে। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে মাস্টার্সের শেষের দিকে ছিলেন তখন। উচ্চ মাধ্যমিকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পছন্দের বাইরেই ভর্তি হতে হয়েছিল এই বিভাগে। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় থেকেই একটি জাতীয় দৈনিকে বিজনেস রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু নারী সাংবাদিক হিসেবে পেশাগত নানা চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে হতো ইশরাতকে।
নিজের কাজ নিয়ে একদমই সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না তিনি। "হাউজ থেকে আমাকে কোনো চ্যালেঞ্জিং কাজ দেয়া হতো না। মেয়ে বলে সবসময় সহজ সব অ্যাসাইনমেন্টে পাঠানো হত। অথচ একই পোস্টে থাকা আমার ছেলে সহকর্মীদের সব ভালো ভালো অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হতো। এক পর্যায়ে এই কাজ থেকে আমার মন উঠে গিয়েছিল," বলেন ইশরাত।
মাস্টার্সে আশেপাশের বন্ধুরা সবাই যখন ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তিত তখন ইশরাত ভাবছিলেন কীভাবে নিজের পছন্দের কোনো বিষয় নিয়ে আগানো যায়। সাজতে ও সাজাতে সবসময় ভালোবাসতেন ইশরাত। একদিন বিকেলে সেই শখের বসেই বন্ধু জেনিফার কামালকে সাজিয়ে তার ছবি ফেসবুকে আপলোড করেছিলেন তিনি। সেখানে শখানেক কমেন্ট আসে প্রশংসা জানিয়ে। ইশরাত বলেন, 'সেদিন ছবি পোস্ট করার পর বিভাগের শিক্ষক শাওন্তী (হায়দার) ম্যাম ও সাবরিনা (সুলতানা চৌধুরী) ম্যাম আমাকে ইনবক্স করে অনেক উৎসাহ দিয়েছিলেন। তাদের সাপোর্ট আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।"
সবার কাছ থেকে প্রশংসা পেয়ে প্রফেশনাল মেকওভার আর্টিস্ট হিসেবে নিজেকে গড়ার সাহস পেয়েছিলেন ইশরাত। বন্ধু সিথির কাছ থেকে দশ হাজার টাকা ধার নিয়ে সাজানোর জন্য প্রয়োজনীয় কিছু মৌলিক জিনিস কিনেন তিনি। এরপর ২০১৮ সালে অক্টোবরের শুরুতে ফেসবুকে পেজ খোলেন 'গ্ল্যাম আপ বাই ইশরাত' নামে।
শুরুতে গ্রাহক হিসেবে পরিচিতজনেরাই ছিল বেশি। অল্প সময়ের মধ্যেই ইশরাতের 'ন্যাচারাল লুক' নির্ভর সাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তখন অপরিচিত অনেকেই সাজতে আসে তার কাছে।
"সাজের ক্ষেত্রে আমি সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য দেই ক্লায়েন্টের ইচ্ছাকে। ক্লায়েন্ট যা চাচ্ছে শুরুতেই তা ভালো করে বুঝতে চাই। তারপর আমার কাজের মাধ্যমে তার ইচ্ছাকে ফুটিয়ে তুলি," বলেন ইশরাত।
"কাজের শুরুর দিকের একজন ক্লায়েন্টের কথা আমার এখনও মনে আছে। তখন আমার কাজ নিয়ে খুব বেশী মানুষ জানতো না। একজন তার গায়ে হলুদের জন্য আমার কাছে সাজতে এসেছিলেন। পরদিন বিয়েতে অন্য পার্লারে তার বুকিং ছিল। কিন্তু গায়ে হলুদের সাজ তার এতটাই পছন্দ হয়েছিল যে ৭ হাজার টাকার বুকিং ক্যান্সেল করে বিয়েতেও আমার কাছ থেকেই সাজতে এসেছিলেন। শুরুর দিকেই এমন একটা ঘটনা আমার কাজের ইচ্ছা আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল।"
নিজের ঘরে একা একা সাজানোর সব দায়িত্ব শুরু করলেও কিছুদিন পর গ্রাহক বেড়ে যাওয়ায় সব সামলাতে হিমশিম খেতে থাকেন ইশরাত। কাজের চাপে মেয়েকে অসুস্থ হয়ে যেতে দেখে ইশরাতের মা আনোয়ারা সেতু তখন এগিয়ে আসেন সাহায্য করতে। ২০১৯ সাল থেকেই ইশরাতের সাথে সহকর্মী হিসেবে কাজ করছেন তার মা।
'গ্ল্যাম আপ বাই ইশরাত' শুরু করার সময় কিন্তু ইশরাতের মা-বাবার খুব একটা সায় ছিল না। ক্যারিয়ার হিসেবে 'মেকওভার আর্টিস্ট' কোনো সিরিয়াস পেশা হিসেবে মানতে পারেননি তারা। তবে কাজের প্রতি মেয়ের উৎসাহ আর অগ্রগতি দেখে তারাও নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন।
এখন 'গ্ল্যাম আপ বাই ইশরাত' এর ম্যানেজমেন্ট এর সব দিক দেখাশোনা করেন ইশরাতের মা। ইশরাত বলেন, "আমি পার্লারে না আসলেও মা সব সামলে নেয়। এখানে সাজতে আসা প্রত্যেকটা ক্লায়েন্টের চুল সাজিয়ে দেন মা নিজেই। ৪৪ বছর বয়স্ক একজন এখনও নতুন জেনারেশনের পছন্দ বুঝে তাদের মনমতো সাজাতে পারেন এটা আমার কাছে সত্যিই বিস্ময়।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষে নিজের প্যাশনকে অনুসরণ করে মেকওভার আর্টিস্ট হিসেবে ক্যারিয়ার গড়া সহজ ছিল না ইশরাতের জন্য। পদে পদে সমাজের তথাকথিত স্ট্যান্ডার্ডের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়েছে তাকে।
বাসায় কাজ শুরু করার কিছুদিন পরই ইশরাতের বিল্ডিং কমিটির সদস্যরা নোটিশ দেয় বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার। সেসময় পরিবারসহ বেশ হেনস্তা হতে হয় তাকে। সাংবাদিকতা ছেড়ে পার্লারের কাজ স্থায়ীভাবে শুরু করার পর নিজের বিভাগের শিক্ষকের কাছ থেকেও শুনতে হয় নানা কটু কথা। কিন্তু এসব কিছুই দমাতে পারেনি তাকে।
ইশরাতের ভাষায়, "আমি তো খারাপ কিছু করছি না। আমার প্যাশন ফলো করছি। আর খারাপ কথার বিপরীতে অসংখ্য ভালো মন্তব্যও তো আমি পাচ্ছি। যেগুলো আমাকে ইন্সপায়ার করে সবসময়। আমার বাবা আর জীবনসঙ্গী দুজনেই আমার কাজ নিয়ে অনেক গর্ব বোধ করেন। জুনিয়ররা যখন বলে তারা আমাকে দেখে কাজ করার সাহস পায় সেটা আমার জন্য খুবই স্পেশাল।
"আসলে সাংবাদিক হিসেবে আমি হয়তো এমন কাজ করতে পারতাম না যে মানুষ এর মাধ্যমে আমাকে চিনবে। কিন্তু 'গ্ল্যাম আপ বাই ইশরাত'-এর কারণে এই কয়েক বছরে লাখ-লাখ মানুষ না হলেও হাজার খানেক মানুষ তো আমাকে চিনেছে," বলেন ইশরাত।
করোনা মহামারির লকডাউনে বেশ কঠিন সময় পার করতে হয়েছে ইশরাতকে। লকডাউনের কিছুদিন আগেই গ্রাহকদের চাহিদায় পার্লারের পাশাপাশি সেলোন সার্ভিস শুরু করেছিলেন। সবকিছু হুট করে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভাড়া দেওয়া, কর্মীদের বেতন দেওয়া কষ্টকর হয়ে উঠেছিল তার জন্য। স্বামীর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন সে সময়। পরিবারের সদস্যরা বলেছিলেন একবারে বন্ধ করে দিতে পার্লার। কিন্তু তিনি ভরসা হারাননি। করোনার বন্ধে ঘরে বসে অনলাইনে কোর্স করে বাড়িয়ে নিয়েছেন নিজের দক্ষতা।
ইশরাত মনে করেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার শিক্ষা তার এই ক্যারিয়ারেও সহায়ক হচ্ছে অনেক। ছবি তোলা, ভিডিও করা থেকে শুরু করে গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগে দক্ষতায়ও শোভা কাজে লাগাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানকে।
দশ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করা 'গ্ল্যাম আপ বাই ইশরাত'-এ এখন মাসিক আয় ৬-৭ লাখ টাকা। ইশরাতের পার্লারে মাধ্যমে তার অধীনে কাজ করা আরো পাঁচ জন কর্মীর পরিবার চলে। ভবিষ্যতে দেশের বাইরে থেকে মেকওভার বিষয়ে কোর্স করে নিজেকে আরো দক্ষ করে গড়ে তোলার ইচ্ছা ইশরাতের। স্বপ্ন দেখেন তার মাধ্যমে আরো অনেক নারীর কর্মসংস্থান তৈরি হবে।