স্কুল বন্ধাইছে রে! স্কুল বন্ধাইছে!
স্কুল খোলা নিয়ে গান আছে। যেমন—'স্কুল খুইলাছে রে মাওলা স্কুল খুইলাছে/গাউসুল আলম মাইজভান্ডারি স্কুল খুইলাছে'। কিন্তু স্কুল বন্ধ করা নিয়ে তেমন জনপ্রিয় কোনো গান নাই। 'স্কুল খুইলাছে রে' গানটার অনুকরণে বানানো যায়—'স্কুল বন্ধাইছে রে মন্ত্রী স্কুল বন্ধাইছে…'
দুনিয়াটা নাকি খোলা আর বন্ধের খেলা। মানব শরীরও তাই। দম থাকা আর দম বন্ধের খেলা। স্মরণ তাই জিকিরের সাথে, স্মরণ তাই গানে, বিধাতাকে স্মরণ সেই দমে দমে। ধুন্ধুমার জনপ্রিয় তাই এমন গান—'দমাদম মাস্ত কালান্দার/ আলী কা পয়েলা নাম্বার…' মাস্ত কালান্দার নামকরা পীর। লালবাবা শাহবাজ কালান্দার পাকিস্তানের সিন্ধ অঞ্চলের সুফি সাধক। অনেক সুফি সাধক কিংবা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অথবা কাজী নজরুল ইসলামের মতো মানুষেরা স্কুল বা পড়ালেখা নিয়ে তেমন করে ভাবতেন না, বরং স্কুল আসত তাদের কাছে! স্কুলেই তাদের লেখা পাঠ্যপুস্তক থাকে। স্কুল বন্ধাইলেও লেখাপড়া নাকি ছাত্রছাত্রীদের কাছে আসে। সেটা কীভাবে? সরকারি উত্তর হচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমে! পরের প্রশ্ন যদি এমন হয়—অনলাইনে ক্লাস করার মতো মোবাইল কজন কিনতে পারে? কোটি কোটি মানুষ যারা দুবেলা খেতে পায় না ঠিকমতো, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আর করোনা প্রভাবিত সময়ে সেইসব মানুষেরা কি এমন মোবাইল কিনতে সক্ষম? বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ। এখানে ঘুমের মধ্যে বড়লোক হয় মানুষ!
এক্ষেত্রে বড়লোক মানুষরা কী কী করতে পারে? কয়েক কোটি শিক্ষার্থীকে মোবাইল কিনে দিতে পারেন যা দিয়ে অনলাইনে ক্লাস করা যেতে পারে? কোনো কিছু বেশি হয়ে গেলে সেটা রপ্তানি করে দিতে পারেন? যেমন ধরুন ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনী। ১৯৭৯ সালে ইরানী বিপ্লবের পর তিনি একবার বলেছিলেন—'উই উইল এক্সপোর্ট আওয়ার রেভ্যুলেসন'! বাংলাদেশের এক শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন—'আমরা বিদেশে জ্ঞান রপ্তাানি করব'! বাংলাদেশের মানুষের পর্যাপ্ত জ্ঞান আছে। চাইলেই রপ্তানি করা যায়। ধরুন, আপনার জ্বর হয়েছে। দু-একজনকে বলুন। দেখবেন তারা ডাক্তার হয়ে বলবে কী খাবেন আর কী খাবেন না। ধরুন, চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবেন। যখন পরিচিতজনদের বলবেন, দেখবেন তারা বলবে পরিচিত কে কে আছে যাদের বললে চাকরি মিলতে পারে। ধরুন, টাকা লাগবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা কীভাবে পাচার করা যায় কিংবা কীভাবে ব্যাংকের ঋণখেলাপি হওয়া যায়, সেই জ্ঞান দেবার মানুষও আছে। আছে খুনের আসামী হয়ে কীভাবে হাসপাতালের 'ভিআইপি' হয়ে থাকা যায় সেই জ্ঞান দেয়ার লোক। সুতরাং জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশে অচিরেই জ্ঞান মন্ত্রণালয় খোলা উচিত, যদিও স্কুল-কলেজ বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
কতদিন বন্ধ রাখা হয়েছে স্কুল কলেজ? মোটাদাগে ২০২০-এর মার্চ থেকে ২০২২ সালের ২১ ফেব্রয়ারি পর্যন্ত। মাঝে কিছুদিন খুলেছিল এবং এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও হয়েছিল। এটা কি সর্বোচ্চ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার বিশ্ব রেকর্ড?
স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার ঘোষণা দেবার পর আমাদের শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনির একটি নতুন 'রেকর্ড'-এর কথা জানা গেছে। পুরোনো রেকর্ডও সবার জানা। ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। এ সময়ে তিনি যতবার বিদেশ সফর করেছেন সেটাও নাকি একধরনের রেকর্ড হয়ে আছে। বলা হয় তিনি যত পথ বা মাইল অতিক্রম করেছেন তাতে তিনি প্রায় বিশবার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে পারতেন! এক হিসেবে এ সময়ে তিনি ১৪৯ বার বিদেশ সফরে গেছেন এবং দেশের বাইরে ছিলেন ৪৫২ দিন। ১৪৯ বার বিদেশ সফরে তিনি ৬৩টি দেশে গেছেন, তবে সবচেয়ে বেশিবার, অর্থাৎ দশবার গিয়েছিলেন নাকি ইংল্যান্ডে।
এবার নতুন রেকর্ডের কথা বয়ান করি: শিক্ষামন্ত্রীর 'বাণী'র জন্য নাকি প্রায় তিন হাজার দরখাস্ত জমা পড়েছে! মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যরাও তার বাণী পাচ্ছেন না। সাধারণত সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক অনুষ্ঠান, প্রকাশনা, সমাবর্তন কিংবা কোনো উৎসব আয়োজনে ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। নির্মাণ করা হয় ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। এসবসহ বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজনের জন্যও শিক্ষামন্ত্রীর বাণী নেয়ার রেওয়াজ রয়েছে। খবর প্রকাশিত হয়েছে, দুই-তিন মাস ধরে শিক্ষামন্ত্রীর কোনো বাণী পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বাণী পাওয়ার আবেদন জমেছে তিন হাজারের মতো।
কিন্তু স্কুল বা কলেজ কবে খুলবে? করোনার তৃতীয় ঢেউ বা ওমিক্রন সংক্রমণের কারণে বন্ধ করা হলেও বলা হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সংক্রমণের হার কমে এলে আবারো ক্লাসে ফিরতে পারবেন শিক্ষার্থীরা।
এদিকে কবে নাগাদ শিক্ষার্থীদের 'ডোজ' বা টিকা দেয়া সম্পন্ন হতে পারে, তা-ও স্পষ্ট নয়। শিক্ষার্থীদের জন্য অন্তত ত্রিশ কোটি ডোজের দরকার হবে। সরকার যেভাবে এবং যে গতিতে মানুষকে টিকা দিচ্ছে সেই হারে যদি সময়মতো টিকা পাওয়া যায়, তাহলে তিন বছর লাগতে পারে সবাইকে টিকার আওতায় আনতে।
২০২২-এর ফেব্রুয়ারির শেষে আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া হতে পারে বলা হয়েছে।
ক্লাস এখন পর্যন্ত বন্ধ, হয়তো এই ফেব্রুয়ারিতে শুরু হবে। খুবই আশার কথা। শিক্ষার কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ল, একসময়ে পাঠ্যসূচিতে 'এসো নিজে করি' নামে একটা ব্যাপার ছিল যেটা পরিণত হয়েছিল চূড়ান্ত 'হাস্যকর' ব্যাপারে। অনলাইন পাঠদান পদ্ধতি এ দেশের প্রেক্ষিতে কোনো ভালো বিকল্প না। বিকল্প অনেকসময় ভালো কিছু আনে না। এই দেখুন, একটা রাজনৈতিক দলের কথা মনে পড়ে গেল! এই প্লাটফর্মের নাম ছিল 'বিকল্প ধারা'। সেটার খবর কী? যাহোক, আমরা বিকল্প কিছু না ভেবে একটা বিকল্প বিষয়ক গল্প শুনে বিদায় নিই।
এক লোক নতুন একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে জয়েন করেছে। কিছুক্ষণ পরে এক তরুণী এসে জানতে চাইল কোমল ও মোলায়েম ত্বকের জন্য যে সাবানটা বাজারে এসেছে সেটা কি আছে? লোকটা খুঁজে পেল না সাবান। সে এসে তরুণীকে জানাল—স্যরি, ওটা নেই। তরুণী চলে গেলে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক এসে নতুন জয়েন করা লোকটিকে বলল—ওই সাবান খুঁজে পাওনি তাতে কী! তুমি যা আছে, তার কথাই বলতা। এই যে কেমে, ডাভ, ডেটল, কেয়া ছাড়াও আরো কত ব্র্যান্ডের সাবান আছে। বলতে, আপনি বিকল্প হিসেবে কোনো একটা ব্যবহার করে দেখতে পারেন। নতুন আসা লোকটা বললো—ঠিক আছে, স্যার। এমন ভুল আর হবে না।
এরপর এক লোক এসে টয়লেটে ব্যবহারের জন্য টিস্যু পেপার চাইল। নতুন লোকটা অনেকক্ষণ খুঁজেও টিস্যু পেপার পেল না। সে শিরিষ কাগজের প্যাকেট দেখিয়ে বললো মোলায়েম টিস্যু নেই তো কী হয়েছে? আমাদের এখানে উন্নত মানের শিরিষ কাগজ আছে। আপনি বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে দেখতে পারেন!
বিকল্প মেনে নেয়া কঠিন নাকি সব বিকল্প মানুষের উপযোগী নয়?
- আহসান কবির: রম্য লেখক