চট্টগ্রামে জহুর আহমদ চৌধুরীর অফিস ছিল ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্র
১৯৪৮ সাল। জহুর আহমদ চৌধুরী বিরোধী দলীয় যে কোন আন্দোলনে সামনের সারিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছিলেন। চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন নিয়ে সংগঠন হিসেবে তমদ্দুন মজলিশের সক্রিয়তা ছিল বেশি। আদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তমদ্দুন মজলিশকে সহযোগিতা করতে দ্বিধা করেননি জহুর আহমদ চৌধুরী।
১৯৪৮ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠির উদ্দেশ্যে ইশতেহার প্রচার করেন তমদ্দুন মজলিশ কর্মীরা। এ অপরাধে চট্টগ্রাম কলেজের তমদ্দুন মজলিশ কর্মী মোহাম্মদ এজাহারুল হক ও ফরমান উল্লাহ খানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জহুর আহমদ চৌধুরী খবর পেয়ে তাদেরকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনেন।
সেই ঘটনা স্মরণ করে ভাষা সৈনিক এজাহারুল হক লিখেছেন, "১৯৪৮ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের প্রথম স্বাধীনতা দিবস। ...স্থির করলাম যে স্বাধীনতা দিবসে দেশের সমস্যার উপর তমদ্দুন মজলিশের পর্যালোচনা ভিত্তিক একটা বক্তব্য থাকা উচিত। .... আমরা তিনজনে মিলেই ইশতেহারটি লিখলাম। ১৪ আগস্ট পলোগ্রাউন্ডের মিটিংয়ে তা বিলি করার সময় পুলিশ আমাকে ও ফরমান ভাইকে গ্রেপ্তার করে। ....সারাদিন আমাদের অনেক কষ্ট হলো। খবর পেয়েও কোতোয়ালী থানায় কেউ আমাদের দেখতে আসেনি। সন্ধ্যার দিকে জহুর আহমদ চৌধুরী খবর পেয়ে কালবিলম্ব না করে কোতোয়ালী থানায় এসে নিজেই জামিন হয়ে আমাদের ছাড়িয়ে নিয়ে যান।"
১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ গঠন হয়। জহুর আহমদ চৌধুরী এই কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর থেকে জহুর আহমদ চৌধুরীর শ্রমিক সংগঠনের আন্দরকিল্লার অফিসটি ভাষা সংগ্রাম পরিষদের দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। এই অফিস থেকেই আওয়ামী মুসলিম লীগ, তমদ্দুন মজলিশ ও বাম নেতা-কর্মীরা ভাষা আন্দোলন পরিচালনা করেন।
২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে চট্টগ্রামে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়।
ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের খবর বিকেলে চট্টগ্রাম এসে পৌঁছায়। এরপর সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহের আগুন। মিছিলের পর মিছিল আসতে থাকে পুরনো ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউট চত্বরে। সেই মিছিলের একটি ছিল জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে।
সন্ধ্যায় আন্দরকিল্লা জহুর আহমদ চৌধুরীর শ্রমিক সংগঠনের অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। কমিটির আহ্বায়ক মাহবুব উল আলম চৌধুরী অসুস্থ থাকায় জহুর আহমদ চৌধুরী সভায় সভাপতিত্ব করেন। বক্তব্য রাখেন এমএ আজিজ, ডা. আনোয়ার হোসেন ও ছালামত আলী খান। সভায় ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি হরতাল এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি লালদিঘি ময়দানে জনসভা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
২৪ ফেব্রুয়ারি লালদিখি ময়দানে মুসলিম লীগ নেতা রফিউদ্দিন সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে জনসভায় জহুর আহমদ চৌধুরী, একে খান, এম এ আজিজ, শেখ মোজাফফর আহমদ চৌধুরী হারুনুর রশিদ, আজিজুর রহমান বক্তব্য রাখেন।
১৯৫২ সালে জহুর আহমদ চৌধুরী পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।। চট্টগ্রাম বন্দর, দোকান কর্মচারী ও ডক শ্রমিকদের মাঝে একচ্ছত্র প্রভাব ছিল তার। তার নেতৃত্বে চট্টগ্রামের শ্রমিকরা ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সে বছরই জহুর আহমদ চৌধুরী চট্টগ্রাম পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন। শ্রমিক কর্মচারীরাই তার এ বিজয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
পহেলা মার্চ অনুষ্ঠিত এক জনসভায় জহুর আহমদ চৌধুরী অবিলম্বে সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন।
তিনি বলেন, "উর্দুর সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। আমরা শুধু চাই, উর্দুর সাথে বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হোক। পাকিস্তানের শতকরা ৫৫ শতাংশ অধিবাসী বাংলাভাষী, তাই কেউ আমাদের ন্যায্য দাবিকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না।"
এসময় তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার দাবি জানান।
চট্টগ্রামে প্রথম শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের উদ্যোগের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন জহুর আহমদ চৌধুরী। এ প্রসঙ্গে প্রফেসর মোহাম্মদ আলী চৌধুরী লিখেছেন, "উদ্যোক্তাদের ভেতর প্রবীণদের মধ্যে ছিলেন সাহিত্যিক আবুল ফজল, জহুর আহমদ চৌধুরী, এম এ আজিজ সহ আরো কয়েকজন"। (ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস)
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলীগ লীগের প্রার্থী ও শীর্ষ ধনী শেখ রফিউদ্দিন সিদ্দিকীকে পরাজিত করেন। এই ঘটনা নিয়ে কলকাতার বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক স্টেটসম্যান তাদের সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করে, 'জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে রফিউদ্দিন সিদ্দিকীর এই পরাজয়, মক্ষিকার কাছে হস্তীর পরাজয়ের সমতুল্য'।
জহুর আহমদ চৌধুরী ১৯১৬ সালে চট্টগ্রামের উত্তর কাট্টলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবদুল আজিজ চৌধুরী ও মাতার নাম জরিনা বেগম। তার প্রথম সন্তান সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন এবং তার দ্বিতীয় সন্তান মাহাতাব উদ্দিন চৌধুরী বর্তমানে মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৩৭ সালে জহুর আহমদ চৌধুরী কলকাতার খিজিরপুরে ডক শ্রমিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪০ সালে যুক্ত হন মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে। ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রাম ডক শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন। এ বছর সর্বপ্রথম শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ১৯৪৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন। ১৯৪৭ সালে সিলেট গণভোটে অংশ নেন।
দেশভাগের পর জহুর আহমদ চৌধুরী কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে এসে ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি চালক ও দোকান কর্মচারীদের নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চট্টগ্রামে দলকে সুদৃঢ় ভিত্তি দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। যুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে দেশ পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন এই সংগ্রামী।
- টিবিএস ও নগদ-এর যৌথ উদ্যোগ