কর্ণফুলী টানেলকে ঘিরে বাড়ছে বিনিয়োগ
কর্ণফুলী টানেল নির্মাণকে কেন্দ্র করে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে গড়ে উঠছে বড় বড় বিনিয়োগ। বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর ওপারে আংশিক চালু রয়েছে কোরিয়ান ইপিজেড। এর পাশাপাশি বিচ্ছিন্নভাবে কিছু শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম টানেল এ নির্মাণের সঙ্গে সমন্বয় রেখে আনোয়ারার একটি ইকোনমিক জোন স্থাপন করছে সরকার।
কর্ণফুলী দক্ষিণপাড়ে আনোয়ারা উপজেলায় ৭৮১ একর জায়গার উপর গড়ে তোলা হচ্ছে চায়নিজ ইকোনোমিক এন্ড ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল জোন। এখানে কর্মসংস্থান হবে প্রায় দুই লাখের। এছাড়া গড়ে উঠবে 'ওয়ান টাউন টু সিটি'। কর্ণফুলী টানেলকে ঘিরে গড়ে তোলা হচ্ছে কানেকটিভিটিও।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সদস্যভূক্ত অনেকে বিনিয়োগ করছে আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলায়। এর মধ্যে রয়েছে কর্ণফুলীর খোয়াজনগরে বেলামি টেক্সটাইল, এটিপি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, হ্যারডস গার্মেন্টস, জিএসএল এক্সপোর্ট, বেঞ্চমার্ক অ্যাপারেল। এ ছাড়াও আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আনোয়ারায় কারখানা স্থাপনের জন্য কাজ করছে।
চায়না স্পেসালাইজড ইকোনোমিক জোনের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ইকোনোমিক জোনের রাস্তাঘাট এবং ইউলিটির জন্য ২৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে। তাছাড়া ১৫টি বিদেশি কোম্পানি ইতোমধ্যে এখানে বিনিয়োগের জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে।
একই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াসিন বলেন, কর্ণফুলী টানেলের কারণে মিরসরাই থেকে কক্সবাজারে নতুন কানেকটিভিটি তৈরি হবে। তাছাড়া কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলা থেকে চট্টগ্রাম বন্দর ও এয়ারপোর্ট কাছে হওয়ার কারণেও ইকোনোমিক জোনের বাইরে বিনিয়োগ হতে পারে। তাছাড়া আমরা বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগকারীদের চায়না এবং মিরসরাই ইকোনোমিক জোনে বিনিয়োগ জন্য বলে থাকি।
বিজিএমইএ সহ-সভাপতি এএম চৌধুরী সেলিম বলেন, কর্ণফুলী টানেলের কাজ শুরু হওয়ার আগে থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ছিল আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলায়। কিন্তু এখন টানেলকে ঘিরে আরও বাড়বে বিনিয়োগ। টানেলের কারণে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত যে নতুন কানেকটিভিটি তৈরি হয়েছে তাতে অন্য স্থানগুলোর চেয়ে এখানে বিনিয়োগ আকর্ষণ বাড়বে। তাছাড়া এর মাধ্যমে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে শহরের সংযোগ সহজতর হওয়ার কারণে শহরের ওপর চাপ কমবে।
অন্যদিকে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) নির্মাণাধীন কর্ণফুলী টানেলের সংযোগ সড়ককে চার লেনে উন্নীত করার একটি প্রকল্পও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। 'আনোয়ারা উপজেলা সংযোগ সড়কসহ কর্ণফুলী টানেল সংযোগ সড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণ (শিকলবাহা-আনোয়ারা সড়ক)' প্রকল্পটির জন্য একনেক সভায় ৪০৭ কোটি ৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।
কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলা। উত্তরে চট্টগ্রাম শহর। শহরের পতেঙ্গা গেলেই চোখে পড়বে বিশাল কর্মযজ্ঞ। নদীর তলদেশে চলছে তিন দশমিক চার কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলের কাজ। যা শহর এবং গ্রামের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করবে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পতেঙ্গায় অবস্থিত টানেল নির্মাণের প্রধান অফিস থেকে আধাকিলোমিটার সড়ক পাড়ি দিলেই দেখা যায় টানেলের উদ্বোধনী ফলক। ফলকের আশেপাশে দেখা যায় অনেকগুলো ক্রেন। নদীর যে পয়েন্টে টালেন হচ্ছে তার প্রবেশমুখে আছে বোরিং পাইপ। মেশিন দিয়ে মাটি তুলে লাগানো হচ্ছে কনক্রিটের সেগমেন্ট।
টানেল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ বলেন, ''টানেলের সর্বশেষ ৫১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।''
চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ''এ টানেলের মাধ্যমে মিরসরাই থেকে টেকনাফ পর্যন্ত একটা নতুন কানেকটিভিটি তৈরি হবে। এর মাধ্যমে বাড়বে শিল্পায়ন, হবে কর্মসংস্থানও। চট্টগ্রামকে ঘিরে যে বাণিজ্যিক হাব করার পরিকল্পনা তা বাস্তবায়ন হবে এ টানেলের মাধ্যমে।''
কর্ণফুলী উপজেলার বাসিন্দা আবদুল হান্নান বলেন, টানেলের কারণে এখানে বিভিন্ন ধরণের শিল্পায়ন হচ্ছে। ফলে আগে জমির দাম গণ্ডাপ্রতি (০.০২ একরে একগণ্ডা) আট লাখ হলেও তা এখন গিয়ে ঠেকছে ২০ লাখে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের কাজটি হাতে নেওয়া হয়েছে। মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। এরই মধ্যে সাগরিকা থেকে টানেল পর্যন্ত সাগরপাড়ে ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ রিং রোড নির্মাণ করা হয়েছে। ওই সড়ক যাবে টানেলের ভেতর দিয়ে। সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কর্ণফুলী টানেল চালুর প্রথম বছর ৬৩ লাখ গাড়ি টানেলের ভেতর দিয়ে চলাচল করবে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা-হালিশহরে বাস্তবায়ধীন আউটার রিং রোড কাজ করবে টানেলের অ্যাপ্রোচ সড়ক হিসেবে। নগরী থেকে টানেল অতিক্রম করে মেরিন ড্রাইভ কক্সবাজার যাবে আনোয়ারা উপজেলা হয়ে। সেই আনোয়ারাতেই বাস্তবায়িত হবে চীনা ইকোনমিক জোন। উত্তর দিকে এই মেরিন ড্রাইভ চলে যাবে দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর পর্যন্ত।
চট্টগ্রামকে ঘিরে গ্রহণ করা হয়েছে উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা। কর্ণফুলী টানেল হয়ে যে সড়ক কক্সবাজার যাবে তা কোনো একসময় মিয়ানমার হয়ে প্রসারিত হবে চীনের কুনমিং সিটি পর্যন্ত। মহাপরিকল্পনার আওতায় চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে বিদ্যুৎ হাব। মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে হচ্ছে এলএনজি টার্মিনাল। এই কর্মযজ্ঞ পৃথকভাবে চলমান থাকলেও মূলত সরকারের মেগা উন্নয়ন পরিকল্পনারই অংশ। কারণ এই চট্টগ্রাম হয়ে খুলে যাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বার।
যেভাবে হবে টানেল
নকশা অনুযায়ী দৈর্ঘ্য হবে তিন কিলোমিটারের চেয়ে সামান্য বেশি। চট্টগ্রাম নগরীর নেভাল একাডেমি পয়েন্ট দিয়ে তলদেশে ঢুকে তা বেরুবে কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো) এবং চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) মাঝামাঝি স্থান দিয়ে। নদীর তলদেশে এর গভীরতা থাকবে ১৮ থেকে ৩১ মিটার। মোট দুটি টিউব নির্মিত হবে। একটি দিয়ে গাড়ি শহরপ্রান্ত থেকে প্রবেশ করবে, আরেকটি টিউব দিয়ে ওপার থেকে শহরের দিকে আসবে।