বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণকে নতুন পরিচয় দিতে চাই: অ্যালান ডোনাল্ড
সম্প্রতি বাংলাদেশের পেস বোলিং কোচ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন কিংবদন্তি দক্ষিণ আফ্রিকান পেসার অ্যালান ডোনাল্ড। খেলোয়াড়ি জীবনে প্রোটিয়াদের হয়ে ৭২টি টেস্ট খেলে ৩৩০ উইকেট নিয়েছেন তিনি। ১৬৪ ওয়ানডেতে নিয়েছেন ২৭২ উইকেট। বল হাতে ক্ষিপ্রতার জন্য তাকে বলা হতো 'সাদা বিদ্যুৎ'।
অবসর নেওয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকা দলেও বোলিং কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন ডোনাল্ড। এছাড়া ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া দলে খণ্ডকালীন দায়িত্ব পালন করেছেন।
নতুন দায়িত্বের ব্যাপারে এই সাবেক তারকা ক্রিকেটার বলেছেন, কোচ হিসেবে তার কাজ হবে বাংলাদেশের বোলিং ইউনিটের পরিচয় বা 'আইডেন্টিটি' খুঁজে বের করা। ক্রিকবাজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কোচ হিসেবে তার দর্শন, বাংলাদেশে নতুন চ্যালেঞ্জ এবং আরও নানা বিষয়ে কথা বলেছেন ডোনাল্ড।
সাক্ষাৎকারের ধারণকৃত অংশ তুলে দেওয়া হলো এখানে-
কী দেখে বাংলাদেশের পেস বোলিং কোচের দায়িত্ব নিয়েছেন? নতুন দায়িত্ব নিয়ে কেমন উদ্দীপনা কাজ করছে আপনার মাঝে? বাংলাদেশ ক্রিকেট কি আগে থেকেই ফলো করতেন?
আমার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বেশ সহজ ছিল। আবারও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরতে পারব, এই চিন্তা থেকেই বোলিং কোচের দায়িত্বটি নিয়েছি। অনেকদিন পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিরছি। আমার সর্বশেষ কাজ ছিল অস্ট্রেলিয়ার হয়ে, শ্রীলঙ্কা সফরে। কাজ করে আনন্দ পেলেও তেমন সাফল্য পাইনি আমরা। কারণ, সে সফরে তেমন সুবিধা করতে পারেনি আমাদের দল (অস্ট্রেলিয়া)।
এছাড়া এখানে রাসেল ডমিঙ্গোকেও বেশ ভালোভাবে চিনি আমি। তার সঙ্গে আগামী নয় মাস কাজ করাটা অনেক সহজ হবে।
সামনে বেশ কিছু দারুণ টেস্ট ম্যাচ ও সিরিজ আছে। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজটিও তেমনই। আমি বাংলাদেশ ক্রিকেটকে ফলো করেছি। তবে এত ঘনিষ্ঠভাবে না। এখানে-সেখানে বাংলাদেশের খেলা দেখেছি।
সর্বশেষ নিউজিল্যান্ড সিরিজটি বেশ ভালোভাবে ফলো করেছি। টাইগাররা দেখিয়েছে তারা যেকোনো ভালো দলের সঙ্গেও লড়াই করতে পারে। আর বর্তমান সময়ে নিউজিল্যান্ডের চেয়ে ভালো দল তো হয় না। তাদের বিপক্ষে বাংলাদেশ যা করে দেখিয়েছে, তা সত্যিই দুর্দান্ত। তবে পারফরম্যান্স ভালো হলেও দ্বিতীয় টেস্টের হারটা ঠিক আদর্শ ছিল না। আমি বাংলাদেশের তরুণ ফাস্ট বোলারদের সঙ্গে কাজ করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি।
বাংলাদেশি পেস বোলারদের নিয়ে কোনো হোম ওয়ার্ক করেছেন?
হ্যাঁ, পেসারদের নিয়ে কিছু গবেষণা করেছি আমি। দূর থেকে তাসকিন, এবাদতের মতো বোলারদের দেখুন। আমার মতে শরিফুল ইসলামও একটি দারুণ প্রতিভা। লম্বা, বাঁহাতি, ভালো পেস আছে বলে। দূর থেকে দেখে মনে হয়েছে তার মানসিকতাও দুর্দান্ত। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, তার বয়স মাত্র ২২। দক্ষিণ আফ্রিকায় হওয়া অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও নজর কেড়েছিল ছেলেটি। কোচ (ডমিঙ্গো) বলেছে, শরিফুল আর খালেদ আহমেদ সম্ভবত ব্যাক-আপ হিসেবে থাকবে। ফিজ আর টেস্ট খেলে না, এটা খুবই দুঃখজনক। কারণ, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো জায়গায় বেশ কাজে আসত সে।
এই পেসারদের গ্রুপটা বেশ প্রতিশ্রুতিশীল। একে একে সবার সঙ্গে পরিচিত হব আমি। আমার কাছে মনে হয়, বাংলাদেশ দলটাও চমৎকার। এই দলকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই দক্ষিণ আফ্রিকার। মনে হচ্ছে, দেখার মতো একটি সিরিজ হতে চলেছে এবং এই সিরিজে ইতিহাস গড়ার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের।
রাসেল ডমিঙ্গোর সঙ্গে কথা বলেছেন? তার সঙ্গে আগেও কাজ করেছেন আপনি। ড্রেসিংরুমে এরকম পরিচিত মুখ দেখতে পাওয়াটা নিশ্চয়ই বেশ স্বস্তির?
ডমিঙ্গোর সঙ্গে চার বছর কাজ করেছি আমি, প্রোটিয়াদের হয়ে। আর জেমি সিডন্সের সঙ্গে খেলেছি। বিভিন্ন সফরে তার বিপক্ষে খেলেছি আমি। অনেকদিন পর তার সাথে কথা হলো। জেমি বেশ ভালো একজন ব্যাটিং কোচ। এই কোচিং দলটা সুন্দর, আর বাকি লোকজনও।
গত কয়েকদিনে রাসেলের সঙ্গে অনেক কথা হয়েছে আমার। সে এখন পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাচ্ছে। তাই বেশি ঘাঁটাইনি। তবে দলের ব্যাপারে কিছু তথ্য দিয়েছে সে। এই দল থেকে কেমন প্রত্যাশা রাখতে হবে জানিয়েছে।
আপনার উপর অনেক প্রত্যাশা থাকবে। এটা কীভাবে দেখছেন? ওয়ালশ যখন বাংলাদেশের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল, তখনও একই রকম প্রত্যাশা ছিল। কারণ আপনারা দুজনই কিংবদন্তি ক্রিকেটার…
হ্যাঁ, সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলা এবং সফল হওয়া সাবেক ক্রিকেটার যখন কোনো দায়িত্বে আসে, তখন প্রত্যাশা বেশিই থাকে। কিন্তু কোচের বেলায় নামে আসলে কিছু যায় আসে না।
আমি এই বোলিং গ্রুপের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করব। গ্রুপ হিসেবে তাদের পরিচয় কী এবং বিভিন্ন ফরম্যাটে তারা নিজেদের কীভাবে দেখে, তা জানার জন্য উদগ্রীব আমি।
দক্ষিণ আফ্রিকায় তারা তিনটি ওয়ানডে ও দুটি টেস্ট খেলবে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে আমার দর্শন হচ্ছে, প্রথমে বুঝতে হবে দলের বোলিং আক্রমণটা কেমন। আমি তাদের স্পিন কোচকেও চিনি। কিন্তু পেসারদের পক্ষ থেকে বলছি, আমি জানতে চাই তাদের স্বতন্ত্র পরিচিতিটা কেমন এবং সীমিত ওভারের ক্রিকেটে নিজেদের কেমন পরিচিতি চায় তারা।
আমি জানি, কোনোরকম অগ্রগতি প্রত্যাশা করার আগে আমাকে তাদের কথা শুনতে হবে। এই গ্রুপটা কেমন তা বুঝতে হবে, তাদের দর্শন বুঝতে হবে।
গত চার-পাঁচ দিনে সাংবাদিকদের সঙ্গে অনেক কথাবার্তা হয়েছে আমার। তারা সবাই বলেছে, দেশের বাইরের সিরিজগুলোয় বেশ ধুঁকতে হয় বাংলাদেশের। চাপে পড়ে গেলে ভালো খেলতে পারে না দলটি। সত্যিই ব্যাপারটা এমন কি না, তা খুঁজে বের করতে হবে আমার।
আমার কাছে, কোচিং ব্যাপারটা অনেকাংশেই মানসিক।
মানসিক বোলিং হচ্ছে, চাপের মধ্যে সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পারা। এবং এক্ষেত্রে কোনো ঝামেলা থাকলে, সেই ঝামেলাগুলো খুঁজে বের করা। এরপর ঝামেলাগুলো ছেঁটে ফেলে একটি সিস্টেম তৈরি করা।
আমি মাইক্রো-ম্যানেজমেন্টে সবচেয়ে বেশি নজর দেব। মাইক্রো-ম্যানেজমেন্টের উদাহরণ হতে পারে এমন- ধরুন, ওভারের প্রথম বল ও শেষ বলের উপর জোর দিতে বললাম আমি। ওভারের প্রথম বল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে। এছাড়া স্কোর বোর্ডের প্রয়োজন বুঝে খেলার ধরন বদলানোসহ এ ধরনের খুঁটিনাটি দিকগুলোর উপর নজর রাখব আমি। এটাই আমার পদ্ধতি।
ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট, জাতীয় দল এবং প্রথম-শ্রেণির ক্রিকেট; এর মধ্যে কোনটা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং?
প্রথম-শ্রেণির ক্রিকেট।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে খেলোয়াড়দের প্রতিদিনকার মানসিক চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে সাহায্য করা। আমি নিয়মিত খোঁজ নিয়ে জানার চেষ্টা করি দলের ক্রিকেটাররা মানসিকভাবে কেমন আছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের অনেকেই জানে তাদের কী দরকার, কখন দরকার। এবং এসব নিয়ে তারা আপনার সঙ্গে সরাসরি কথা বলবে। কারণ তারা জানে সামনে কিসের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে তারা।
কিন্তু যখন আমি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটারদের ট্রেনিং সেশনে কিছু করে দেখাতে বলি, দেখা যায় এই বাচ্চাদের অনেকে জানেই না তারা কী করবে।
তাই আমি সাধারণত তরুণদের সরাসরি জিজ্ঞেস করি, এই ট্রেনিং থেকে কী কী অর্জন করতে চাও খুঁজে বের কর।
আমার মতে, একজন ক্রিকেটারের উন্নতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে ট্রেনিং গ্রাউন্ড। কারণ এখানেই নিজেকে গড়ে তুলবে সে। একজন যদি ভালোভাবে ট্রেনিং করে এবং জানে ট্রেনিং সেশনে তার ঠিক কী কী করতে হবে, তাহলে সে অবশ্যই ভালো করবে।
বাংলাদেশের পেস বোলাররা নিউজিল্যান্ডে ভালো করেছে। তাই তাদের উপর প্রত্যাশা থাকবে দক্ষিণ আফ্রিকাতেও ভালো করার। এই দিকটি কীভাবে দেখছেন?
নিউজিল্যান্ড সিরিজ থেকে যদি আত্মবিশ্বাস নিয়ে ফিরে থাকে বাংলাদেশ, তাহলে সেই আত্মবিশ্বাস দক্ষিণ আফ্রিকাতেও দেখা যাবে।
মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টটি আমি দেখেছি। খুবই দুর্দান্ত একটি টেস্ট ম্যাচ ছিল। বাংলাদেশ স্কোরবোর্ডে অনেক রান তুলেছিল। প্রথম ইনিংসে বড়সড় একটা স্কোর করলে আপনি তখন ২০ উইকেট নেওয়ার আশা করতে পারেন।
স্কোরবোর্ডে ৫৫০ রান তুললে আপনি প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলে দিতে পারবেন। তখন বোলাররা বাড়তি আত্মবিশ্বাস পায়। সেখানেও তাই ঘটেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকাতেও ঠিক তাই ঘটা দরকার।
ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন ফরম্যাট হচ্ছে টেস্ট। একজন ক্রিকেটারের জন্য এরচেয়ে বড় মানসিক চ্যালেঞ্জ আর নেই। আপনার যা কিছু আছে সবকিছুরই পরীক্ষা নিবে এই ফরম্যাট।
চাপ-ধৈর্য-অধ্যবসায়-মানসিকতা, সবকিছুর দিকেই খেয়াল রাখি আমি। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ফ্ল্যাট পিচে আপনার সৃজনশীলতা। বড় পার্টনারশিপগুলোকে ভাঙতে আপনাকে অবশ্যই সৃজনশীল হতে হবে।
টেস্টে বর্তমানে পেস আক্রমণের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবাদত, সাথে আছেন তাসকিন আহমেদ ও শরিফুল ইসলাম। মুস্তাফিজ না থাকায় লম্বা ফরম্যাটে এই তিনজন মিলে কি একটি শক্তিশালী পেস আক্রমণ গড়ে তুলতে পারবে?
শরিফুল, তাসকিন এবং এবাদত আছে আমাদের। আর হ্যাঁ, মুস্তাফিজ আর টেস্ট স্কোয়াডের অংশ না। আগেই বলেছি, মুস্তাফিজের টেস্ট ক্রিকেট না খেলাটা সত্যিই দুঃখজনক।
আজকাল এটা খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত ইচ্ছার বিষয় হয়ে গেছে। তারা একটি ফরম্যাটে বেশি পারদর্শী হতে পারে, কিন্তু আমি কাছে মনে হয় টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতায় খেলার ও এখান থেকে টাকা উপার্জন করার জন্য খেলোয়াড়রা বেশি মুখিয়ে থাকে।
আমি মুস্তাফিজুরের বিশাল ভক্ত। ২০১৬ সালে বহুবার বলেছি, সাদা বলের ক্রিকেটে যেকোনো ব্যাটিং লাইন-আপকে সমস্যায় ফেলে দেওয়ার সামর্থ্য রয়েছে তার। হাতে সব ধরনের অস্ত্র থাকে তার। সে বেশ আনপ্রেডিক্টেবল। ফিজের সাথে কাজ করার জন্য মুখিয়ে আছি আমি।
তাদের (বাংলাদেশি বোলারদের) সাথে কথা বললে বোঝা যাবে বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণের পরিচয় কী হবে। ড্রেসিংরুমে এ নিয়ে কখনো আলোচনা হয়েছে কি না জানি না।
দলের প্রতিটি বোলারের আলাদা আলাদা দক্ষতা রয়েছে। দলে একেকজনের ভূমিকাও একেকরকম। আমরা সবাইকে মিলিয়ে একটি জায়গায় এসে দাঁড়াব, যেখান থেকে আপনি বলতে পারবেন- সীমিত ওভারের ক্রিকেটে আমাদের পরিচয়টা তাহলে এরকম, টেস্ট ক্রিকেটে আমাদের পরিচয় এরকম। এটি বুঝতে পারলে এবং একটি সিস্টেম তৈরি করতে পারলে ভালো ইউনিটে পরিণত হবে বাংলাদেশি বোলাররা।
সূত্র: ক্রিকবাজ।
অনুবাদ: কিরো আদনান আহমেদ।