নন-ব্র্যান্ডের জুতা যেভাবে গ্রামীণ জীবনযাত্রা বদলে দিয়েছে
জনসাধারণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং স্থানীয় পাদুকা শিল্পের তৈরি সস্তা পণ্যের কল্যাণে বর্তমানে দেশে প্রত্যন্ততম জেলার স্বল্প-আয়ের মানুষও জুতা-স্যান্ডেল পড়তে পারছে।
তবে গ্রাম বাংলায় খালি পায়ে মানুষের চলাফেরার বেশি থাকার ঘটনা খুব আগেরও কথা নয়। এমনকী ৮০'র দশকের শেষদিকেও খালি পায়ে হেঁটে স্কুলে যেত শিশুরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কেবল কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে হয়তো জুতা পরতেন প্রাপ্তবয়স্করা।
সেই পরিস্থিতি পাল্টেছে, বর্তমানে গ্রামীণ কোনো সড়কে কাউকে খালি পায়ে চলতে দেখাই বিরল ঘটনা। মানুষ এখন সাধ্যের মধ্যে জুতা কিনতে পারে। সব সময়ই তা হালফ্যাশনের চামড়ার জুতো হয়তো নয়, কিন্তু অন্তত এক জোড়া রাবার বা প্ল্যাস্টিকের তৈরি স্যান্ডেল বা স্লিপার কিনতে পারছে।
নন-ব্র্যান্ডের স্থানীয় জুতা প্রস্তুতকারীরা গত কয়েক দশক ধরে এই বিপ্লব ঘটিয়েছে, যা পাদুকাকে সকলের জন্য সহজলভ্য করে তুলেছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এখন জুতা ব্যবহার করে কৃমিসহ পায়ে যেকোনো আঘাত লাগা থেকে আরও ভালোভাবে সুরক্ষিত থাকতে পারছে– এক সময় গ্রামাঞ্চলে এসব বিপত্তি-ই ছিল অতি-সাধারণ ঘটনা।
জুতা পরিধান ১৯০০ শতকের গোড়ার দিকে মিসিসিপিসহ আমেরিকার গ্রামীণ রাজ্যগুলিতে কৃমির মহামারি শেষ করতে সাহায্য করে। বাংলাদেশে সে পরিবর্তনটি ঘটেছে তার প্রায় ১০০ বছর পর। চিকিৎসকরাও বলছেন, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে কৃমির কারণে রক্তস্বল্পতা বর্তমানে আর জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি উদ্বেগজনক স্বাস্থ্য ঝুঁকি নয়। অথচ এক সময় কৃমি সৃষ্ট রোগ-বালাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার কমাতো বলে উল্লেখ করেছেন শিক্ষকরা।
জামালপুর জেলার একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নুরুন্নাহার। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ছোট বেলায় আমরা খালি পায়েই স্কুলে গিয়েছি, কিন্ত বিগত ১০-১৫ বছর ধরে সব বাচ্চারাই জুতা পরে স্কুলে আসে। তাদের খালি পায়ে আর টয়লেটে যেতে হচ্ছে না। ফলে বিভিন্ন ধরনের রোগ-বালাই থেকেও নিরাপদ থাকছে।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ইকোনমিক্স- এর অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ জানান, জুতা গ্রামীণ জীবনযাপনকে আরও স্বাস্থ্যসম্মত করে তুলেছে। "আগে শিক্ষার্থীরা জুতা না পড়ার করার কারণে কৃমি আক্রান্ত হয়ে প্রায়ই পেটের পীড়া, বমি ও জ্বরে ভুগতো। জনস্বাস্থ্যের এই সমস্যা দূর করতে জুতার একটি বড় অবদান আছে।"
স্বাস্থ্য অর্থনীতির এ শিক্ষক আরও জানান, এনিয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো গবেষণার তথ্য না থাকলেও, প্রায় নিশ্চিতভাবেই বোঝা যায়, বর্তমানে আমাদের দেশের কর্মজীবী মানুষও নিয়মিত জুতা পরিধান এবং স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ায় অনেক সংক্রামক রোগ-বালাই থেকে বেঁচে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. মো. নাজমূল হাসান বলেন, "জুতা পরা এবং ওষুধ সেবনের কারণে দেশে কৃমিজনিত রোগব্যাধি, বিশেষত শিশুদের মধ্যে ৯০ শতাংশ কমেছে। এতে সার্বিকভাবে দেশের জনস্বাস্থ্য চিত্রের একটি ইতিবাচক উন্নতি হয়েছে।"
ক্যাম্পেইন ফর এডুকেশন- এর ডেপুটি ডিরেক্টর কেএম এনামুল হক ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে স্কুলগামী শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, "২০০৩ সালের পর থেকে স্কুলগামী শিশুদের মধ্যে জুতা ব্যবহারের হার বাড়তে থাকে। বর্তমানে পার্বত্য বা চর অঞ্চলের শিক্ষার্থীরাও অন্তত স্যান্ডেল বা স্লিপার পরে আসে। এতে তাদের শারীরিক-মানিসিক উন্নতি হয়েছে, সুস্থ-সবল থাকায় শিক্ষার্থীদের স্কুলে উপস্থিতর হারও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
এনামুল হক আরও জানান, গত বছর থেকে সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জুতা, শার্ট ও প্যান্ট (স্কুল ইউনিফর্ম) কেনার খরচ বাবদ ১,০০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে আরো বেশি সুস্থ, পরিচ্ছন্ন ও সম-মানসিকতা সম্পন্ন হিসেবে গড়ে ওঠে।
একটি বিশাল অর্জন:
দেশের আনাচে-কানাচে প্রায় ২০-২২ হাজার জুতার কারখানা গড়ে উঠেছে এবং ১২ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে নন-ব্র্যান্ডের পাদুকা শিল্প গত কয়েক দশক ধরে স্বতঃস্ফূর্ত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
ক্রমবর্ধমান এই শিল্পই গ্রামীণ জনপদের মানুষ যেন ন্যায্য মূল্যে অন্তত এক জোড়া জুতো বা স্লিপার কিনতে পারেন তা নিশ্চিত করেছে। এভাবে বিশেষত শিশু স্বাস্থ্যের উন্নতিতে বড় অবদান রেখেছে খাতটি।
বাংলাদেশ রেক্সিন অ্যান্ড সু-ম্যাটেরিয়াল মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন- অর- রশিদ মনে করেন, মানুষের জীবনযাত্রার এই পরিবর্তন দেশের পাদুকা শিল্পের জন্য একটি বিশাল অর্জন।
তিনি বলেন, "এখন মাত্র ৫০০-৬০০ টাকায় গ্রামের সাধারণ মানুষ এক জোড়া নন-ব্র্যান্ডের ক্যানভাসের তৈরি জুতা হলেও কিনতে পারছে, অথচ ১০-১৫ বছর আগেও তা ছিল অকল্পনীয়।"
শিল্প সংশ্লিষ্টরা আশাপ্রকাশ করেন, বর্তমানে দেশের ১৭ হাজার কোটি টাকার জুতার বাজারের প্রায় ৩০ শতাংশের প্রতিনিধিত্বকারী পাদুকা শিল্প- ভবিষ্যতে আরও উন্নত মানের পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে।
নিজ চেষ্টায় সফল উদ্যোক্তা:
১৯৯৮ সালে ঢাকার মিরপুরে একটি জুতার কারখানায় শ্রমিক ছিলেন মোহাম্মদ আকাশ আহমেদ। ২০০৪ সালে তিনি তার বেতন থেকে সঞ্চয় করা এক লাখ টাকা দিয়ে একটি কারখানা শুরু করেন। শুরুতে আকাশের কারখানায় কর্মচারী ছিল মাত্র তিনজন।
বর্তমানে তার কারখানায় ২৫ জন কাজ করেন, বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৩ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, "আমি বছরে প্রায় আড়াই লাখ জোড়া জুতা উৎপাদন করি, যা ঢাকা ও জেলা শহরে বিক্রি হয়।"
এসএমই ফাউন্ডেশনের ২০১৬ সালের তথ্যমতে, পুরান ঢাকাতে গড়ে উঠা জুতা কারখানার বর্তমান সংখ্যা সবমিলিয়ে প্রায় ৫-৬ হাজার, ঢাকার মিরপুর পল্লবীতে রয়েছে ২০০, কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ১০ হাজারের বেশি, চট্টগ্রামের মাদারবাড়িতে ৬০০-৭০০, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ৩০০ এবং রাজশাহীতে প্রায় ১০০ কারখানা রয়েছে।
এছাড়াও কুমিল্লা, গাজীপুর, নরসিংদী আর নারায়ণগঞ্জেও অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে।
রাজশাহীর চারঘাট ইউনিয়নের কালুহাটি গ্রামের মনজুর রহমান ২০ হাজার টাকা জমানো পুঁজি আর ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ২০১৪ সালে তার পারিবারিক ওয়ার্কশপে একটি ছোট জুতা প্রস্তুতের ইউনিট স্থাপন করেন। এর আগে তিনিও একটি জুতা কারখানায় কাজ করতেন।
ছয় বছরের ব্যবধানে মঞ্জুর এখন প্রায় দেড় কোটি টাকার মালিক। ইতোমধ্যে রাজশাহীতে পাঁচ বিঘা জমি কিনেছেন তিনি।
মঞ্জুর এখন কালুহাটি পাদুকা সমিতির সভাপতি, তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তার কারখানায় এখন ৭০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। শুরু করেছিলেন মাত্র তিনজন শ্রমিক নিয়ে।
বিহারী থেকে বাঙালিরা যেভাবে মালিক হয়ে উঠলেন:
ব্রিটিশ আমলে পূর্ব বাংলায় বড় পরিসরে পাদুকা তৈরির কারখানা ছিল না। মূলত কলকাতা থেকে বিভিন্ন ধরনের পাদুকা আমদানি করা হতো।
১৯৫২ সালের দিকে সর্বপ্রথম পুরান ঢাকার মিডফোর্ড এলাকায় কয়েকজন চীনা নাগরিক এসে এদেশে জুতা-স্যান্ডেল বানাতে শুরু করে। পরবর্তীতে ভারত থেকে আসা বিহারীরা তাদের কাছ থেকে জুতা তৈরির কাজ আয়ত্ত করে।
১৯৬০ এর দশকে বিহারীরা ভারতের বিভিন্ন স্থানে জুতা কারখানায় কাজ করতো, এরাও এক সময় দক্ষ কারিগর হিসাবে বাংলাদেশে এসে পুরাতন ঢাকায় নিজেরাই কারখানা গড়ে তুলে।
দেশ স্বাধীনের পরে বিহারীরা চলে গেলে বাঙালি শ্রমিকরা এসব কারখানা চালু রাখে এবং নিজেরাই কারখানার মালিক হন।
বিহারীদের কাছ থেকে এসব কাজ শিখে দেশীয় কারিগররা বংশাল, সিদ্দিক বাজার, আলুবাজার, মালিটোলা লেন, সুরিটোলা লেন, লুত্ফর রহমান লেন, আব্দুল হালিম লেন, ওসমানগণি লেন, টিকাটুলী, আগা সাদেক রোডসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় জুতার ব্যবসা গড়ে তুলেন।
পরবর্তীতে পুরান ঢাকার এই নন-ব্র্যান্ড জুতা কারখানাগুলো থেকেই সারা দেশে জুতা কারখানা ছড়িয়ে পড়ে। তবে এ শিল্পের সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি ঘটে ৮০'র দশকে।
১৯৬২ সালে বৈশ্বিক ফুটওয়্যার ব্র্যান্ড বাটা সুজ টঙ্গীতে কারখানা স্থাপন করে।
কুমিল্লার লালমাই উপজেলার জুতা কারখানা মালিক জালাল উদ্দিন বলেন, "আগে প্রতি উপজেলার বড় বড় বাজার বা ইউনিয়নের দুই-একটি বাজারে জুতা কিনতে পাওয়া যেত, বর্তমানে গ্রামগঞ্জের বাজারেই তিন-চারটি দোকানে জুতা বিক্রি হচ্ছে।"
বাংলাদেশ রেক্সিন অ্যান্ড সু-মেটারিয়াল মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন-অর-রশিদ বলেন, দুই ঈদের মৌসুমের বিক্রিবাট্টাই নন-ব্র্যান্ড জুতা শিল্পের চালিকাশক্তি।
কারখানা মালিকদের মতে, স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা কাঁচা চামড়া এ শিল্প ব্যবহার করে। এছাড়া, কৃত্রিম চামড়া, রাবার, আঠা ও অন্যান্য কেমিক্যালের বেশিরভাগটাই চীন থেকে আমদানি করা হয়।
প্রয়োজন সরকারি সহায়তার
ঢাকা ক্ষুদ্র পাদুকা শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ বাপ্পি সরকার বলেন, চীন ও ভারত থেকে স্বল্প শুল্কে আমদানি করা মেশিনে উৎপাদিত জুতা আমাদের স্থানীয় পাদুকা শিল্পের ক্ষতি করছে।
"টিকে থাকতে হলে আমাদের নীতি-সহায়তা, স্বল্প-সুদে ব্যাংক ঋণ, প্রশিক্ষণ ও আধুনিক যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। এছাড়া, আমদানি করা জুতায় আরও শুল্কারোপ করেও স্থানীয় প্রস্তুতকারকদের সুরক্ষা দিতে হবে।"
বাপ্পি মনে করেন, সরকারি সহায়তা পেলে দেশে আগামী ১০-১২ বছরের মধ্যে জুতা কারখানার সংখ্যা ৩০-৩৫ হাজার হয়ে যাবে। তখন এই খাত রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "এটা ঠিক যে এসব জুতার কারখনারগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছে, তবে বর্তমানে আমরা ফাউন্ডেশনের সামর্থ্য অনুযায়ী সম্ভাবনাময় এ শিল্পকে কারিগরি প্রশিক্ষণ, আর্থিক সহায়তা এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহের চেষ্টা করছি।"
মফিজুর বলেন, ফাউন্ডেশন ইতিমধ্যে ভৈরবের কয়েকটি জুতা কারখানাকে প্রযুক্তি সহায়তা দিয়েছে। ফাউন্ডেশন সারা দেশে তাদের কার্যক্রম প্রসারিত করবে।