ভারতীয় খাবার যেভাবে ইহুদি খাদ্যতালিকায় যোগ হলো
ভারতবর্ষে বসবাস করে আসা ইহুদি সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ভৌগলিক ও ভাষাগত পার্থক্য থাকলেও যে ব্যাপারটি সকলের ক্ষেত্রে মেলে তা হলো- হিব্রু ভাষায় প্রার্থনা করা ও খাবার-দাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে একই বিধি মেনে চলা। বনি ইসরায়েল ইহুদি সম্প্রদায়ের লেখক এস্টার ডেভিড ইহুদিদের ঐতিহ্যবাহী রান্নার ওপর কয়েকটি বই লিখেছেন। তার 'Book Of Rachel' বইটির প্রতিটি অধ্যায় শুরু হয়েছিলো ইহুদিদের একটি করে রান্নার কৌশল দিয়ে। পুরস্কারজয়ী এই লেখক নিজেই স্বীকার করেছিলেন, ইহুদি খাবারের প্রতি সর্বদা তার বিশেষ আগ্রহ কাজ করে।
ভারতবর্ষের ইহুদি সম্প্রদায়ের বিলুপ্তির ঘটনাও কিছুটা পাওয়া যায় ভারতীয়-ইহুদি বংশোদ্ভূত এই লেখকের 'Bene Appetite: The Cuisine of Indian Jews' বইটিতে। বইটি ইহুদি সম্প্রদায়ের রন্ধনপ্রণালীর নানা কৌশল ভবিষ্যতে সংরক্ষণের মাধ্যমে এই জাতির ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করবে বলে লেখকের আশা।
ধারণা করা হয়, প্রায় ২০০০ হাজার বছর পূর্বে ভারতে প্রথমবারের মতো ইহুদি জাতির আবির্ভাব ঘটে। এদের মধ্যে সংখ্যায় বেশি ছিল বনি ইসরাঈল সম্প্রদায়ের ইহুদি; যারা দেশটির মহারাষ্ট্র-মুম্বাই, পুনে ও গুজরাটের কিছু অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। মালাবার বা কোচিন ইহুদি সম্প্রদায়কে কেরালায় দেখা যায়। বাগদাদি ইহুদি সম্প্রদায় কলকাতায় বসতি স্থাপন করে বসবাস করা শুরু করেছিলো। বনি ইব্রাহিম ইহুদিরা অন্ধ্র প্রদেশের কাছে এবং বনি মেনাশে ইহুদিরা ভারতের মনিপুর ও মিজোরাম অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। ধারণা মতে, ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষে ৫০ হাজার ইহুদির বসবাস ছিলো। কিন্তু '৫০ এর দশকে ইহুদিরা ইসরায়েলে স্থানান্তরিত হতে শুরু করলে ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে ইহুদিদের সংখ্যা হ্রাস পায়। অনুমান করা হয় মাত্র ৫ হাজারেরও কম ইহুদি তখন দেশটিতে রয়ে গিয়েছিলো।
ভারতে ইহুদি সম্প্রদায়
হুগলী নদীর পূর্ব ধারে কলকাতা নগরীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার (যা বড়বাজার নামে পরিচিত) বসে। ১৮ শতকের ইতিহাসের সাথে বিশাল এই পাইকারি বাজারের নাম জড়িয়ে রয়েছে। মসলা, পোশাক ও ইলেক্ট্রনিক পণ্য থেকে শুরু করে জাহাজ থেকে উদ্ধারকৃত পুরনো নানা মালামাল এই বাজারে বিক্রি হয়। বড়বাজারের প্রায় প্রতিটি রাস্তায় মানুষের উপচেপড়া ভিড় থাকে। এ বাজারেরই এককোণে ব্রাবোর্ন রোড ও ক্যানিং স্ট্রিট জুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইহুদি সম্প্রদায়ের মনোমুগ্ধকর উপাসানালয় 'ম্যাগেন ডেভিড সিনাগগ'; আবার এর ঠিক পাশেই শহরের সবচেয়ে প্রাচীন 'নেভেহ শালোম সিনাগগ'।
দেড়শো বছরের পুরোনো এই সিনাগগটি ১৯ শতকের শেষের দিকে ইতালীয় স্থাপত্য শৈলী অনুসরণ করে নির্মাণ করা হয়েছে। বাইরের দিকটায় উজ্জ্বল ইটের গাঁথুনি, বিরাট আকারের দরজাগুলোতে হলদে-বাদামি রঙের পর্দা ও বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা ঘড়ির টাওয়ার সিনাগগটিকে অনন্য করে তুলেছে। সিনাগগটির ভেতরে সাদা-কালো ছকে আঁকা মেঝে, স্তম্ভগুলোতে মোজাইক করা ফুলের নকশা, মাথার ওপর বিশাল আকারের ঝাড়বাতি ও রঙিন কাঁচ দিয়ে জানালাগুলো সাজানো হয়েছে। কিন্তু বছরের বেশিরভাগ দিন সিনাগগটি জনশূন্য থাকে এবং খুব কম সময়ই এখানে প্রার্থনা বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন হতে দেখা যায়।
বহুকাল আগে থেকেই কলকাতা বাগদাদি ইহুদি সম্প্রদায়ের আবাসস্থল। ধীরে ধীরে ইহুদি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এই অঞ্চলে হ্রাস পেতে থাকলে সিনাগগগুলোও বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। কেননা ইহুদি ধর্মীয় আচার অনুযায়ী সিনাগগে ১০ জনের কম পুরুষ উপস্থিত থাকলে প্রার্থনা (হিব্রুতে মিনইয়ান বলা হয়) করা যায় না। সিনাগগগুলোর মধ্যে 'মাঘেন ডেভিড ও ছোট বেথ এল' কে পরর্বতীতে স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বর্তমানে এগুলোকে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
ভারতীয় আঞ্চলিক খাবার ইহুদিদের পাতে
অঞ্চলভেদে ইহুদি সম্প্রদায় স্থানীয় ভাষা ও রন্ধনপ্রণালীর কিছুটা আয়ত্ত করে তা নিজ সংস্কৃতির সাথে সমন্বয় করলেও, ইহুদি সব গোষ্ঠীই তাদের ধর্মীয় আইন মেনে প্রার্থনা ও খাদ্য গ্রহণ করে। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের ধর্মীয় শাস্ত্রে কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে যেমন-দুধের সাথে মাংস মেশানো যাবে না, শূকরের মাংস খাওয়া যাবে না, শেলফিশ খাওয়া যাবে না এবং অন্য মাছগুলো চামড়াসহ খেতে হবে ইত্যাদি।
ডেভিড তার বইতে ভারতীয় ইহুদিদের খাবারে আঞ্চলিক প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। অন্য দেশে ইহুদিদের প্রধান খাদ্য মাংস হলেও ভারতীয় অঞ্চলের বেশিরভাগের প্রধান খাদ্য হচ্ছে চামড়াসহ মাছ ও ভাত। আর ভারতীয় ইহুদিদের খাদ্য তালিকায় খাবারের পর নারিকেলের তৈরি বা ফলের তৈরি মিষ্টি থাকতেই হবে। ভারতে বসবাস করা ইহুদিদের অনেকেই নিরামিষভোজী। কিন্তু কিছু কিছু বিশেষ দিন ও আচার-অনুষ্ঠানে তারা মাংসের তৈরি খাবার খেয়ে থাকে।
১৮০০ শতকে ইরাকী ইহুদিরা কলকাতায় আসার আগে মরিচ ও রসুনের ব্যবহার ছাড়া অন্য কোন মসলা সম্পর্কে জানতো না। ভারতে এসে বাকি মসলাগুলো সম্পর্কে জানার পর তারা এগুলো তাদের রান্নায় ব্যবহার করতে শুরু করলে ইহুদি রন্ধনপ্রণালীতে বিরাট পরিবর্তন আসতে শুরু করে, যা সম্পূর্ণ নতুন হাইব্রিড ইহুদি খাবারের জন্ম দেয়।
ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত মালাবার ইহুদিরা কেরালায় এসে নিজেদের ব্যবসা সমৃদ্ধ করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি। কেরালার মসলা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর ঐ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী মসলা সহযোগে নারিকেলের দুধ রান্না তাদের খাবারের অংশ হয়ে দাঁড়ালো। ধর্মীয় আইনের সাথে বিরোধ না থাকায় এ খাবারটি সহজেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলো তাদের খাদ্য তালিকায়।
পশ্চিম ভারতে বনি ইসরায়েল ইহুদিরা বসবাস করে এবং তাদের মধ্যে আঞ্চলিক খাবারের প্রভাব সুস্পষ্ট। মহারাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান খাবার 'পোহা', যা স্থানীয় লোকেরা সকালের নাস্তা হিসেবে খেয়ে থাকে, ঐ একই খাবার সেখানে বসবাসরত ইহুদি সম্প্রদায়ের লোকেরাও খায়। এমনকি এই পোহা ইহুদিদের 'Thanks giving' (আঞ্চলিক ভাষায় যাকে মালিদা বলে) অনুষ্ঠান আয়োজনের অংশ।
ডেভিড তার বইতে উল্লেখ করেছেন, বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণকালে তিনি দেখেছেন আঞ্চলিক খাবারের পাশাপাশি ইহুদিরা ঐ অঞ্চলে পালিত বিভিন্ন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন। এভাবেই ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার ইহুদিদের বিভিন্ন আইটেমের সাথে মিশে গেছে।
- সূত্র- বিবিসি