ডলারের আধিপত্যের পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়ে উত্থান হতে যাচ্ছে আরেকটি মুদ্রা ব্যবস্থার!
এ যাত্রায় বেঁচে গেল রাশিয়া। রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির মাধ্যমে গৃহীত লোনের সুদসহ ফেরত দেওয়ার তারিখ ছিল ৪ এপ্রিল, চুক্তির শর্ত অনুসারে একমাস অতিরিক্ত সময় পাওয়ার কথা সেই হিসাবে। পরিশোধের সময়সীমা ৪ মে পর্যন্ত নির্ধারিত ছিল।
কিন্তু দেশটির ওপর বিভিন্ন বাণিজ্যিক অবরোধ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের সংরক্ষিত ডলার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আটকে দেওয়াতেই রাশিয়ার ঋণ পরিশোধে এ কঠিন অবস্থা তৈরি হয়। ওই সব ডলারে হিসাব থেকেই রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছিল, রাশিয়া ওই সব হিসাব থেকে ঋণ পরিশোধ করার চেষ্টা করেছিল স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক ও অন্যসব প্রতিষ্ঠান যারা এই মুদ্রার লেনদেন করে তা আটকে দেয়। ফলে এক নতুন অবস্থার সৃষ্টি হয় রাশিয়ার জন্য। ফলে, তারা অন্যভাবে এ সংকট মোকাবেলার চেষ্টা করে।
প্রথমে রাশিয়া তার ঋণ পরিশোধ করার চেষ্টা করে সংরক্ষিত ডলারের হিসাব থেকে। কিন্তু ঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলো তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের প্রাথমিক যে পেমেন্ট তাতে ১২৪ মিলিয়ন সুদ। এরপর রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক চুক্তি বর্ধিত করার চেষ্টাও করে, কিন্তু ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সেদিকে আগ্রহ না দেখিয়ে শ্রীলঙ্কার মতন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির দিকে মনোযোগী ছিল। অর্থাৎ রাশিয়াকে একটি ঋণখেলাপি, দেউলিয়া দেশ হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছিল তারা।
এরপর বড় বিপর্যয়ের ব্যাপার হলো, এমন এক পরিস্থিতিতে রাশিয়া কিভাবে ডলার সংগ্রহ করে পরিশেষে এই পেমেন্ট প্রদান করল তাই! যদিও তা স্পষ্ট নয়। রাশিয়া ডলারের মাধ্যমে শর্ত অনুসারে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তার প্রদেয় অর্থ পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে স্বস্তি নেমে এসেছে। ১৯৯২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার অল্প কিছুকাল পরেই রাশিয়া আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সদস্যপদ গ্রহণ করে। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে রাশিয়া রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির মাধ্যমে গৃহীত এই লোন তাদের রেল ব্যবস্থার জন্য ব্যবহার করেছিল।
নতুন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ব্যাংকসমূহ যারা রাশিয়াকে এই ঋণ প্রদান করেছে, তারা চেয়েছিল রাশিয়া ব্যর্থ হোক এবং একটি দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হোক। আপাতত রাশিয়া এই দেউলিয়া রাষ্ট্র হওয়া থেকে ঠিক কিভাবে নিজেকে রক্ষা করল সেটা অস্পষ্ট, এবং বিস্ময়কর।
আগামী বেশ কিছুকাল অর্থাৎ ২০৪২ সাল পর্যন্ত রাশিয়াকে এই ঋণ পরিশোধ করে যেতে হবে । এখন একটি প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে, যদি বিশ্ব বাণিজ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ ও মুদ্রাব্যবস্থায় নতুন কোনোদিক উন্মোচিত না হয় তাহলে কি রাশিয়াকে মার্কিনী মুদ্রাব্যবস্থার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে? আজকের আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকেই এ কথা ভাবাচ্ছে। রাশিয়া কি পারবে এই বাণিজ্যিক অবরোধের মধ্যে তার এই আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধ নিয়মিতভাবে করে যেতে? যদিও বিভিন্ন খাতে যে পরিমাণ মুদ্রা মার্কিনীদের কাছে আটক হয়েছে তা ব্যবহার করা গেলে এই ঋণ পরিশোধ করার ক্ষেত্রে রাশিয়ার কোনো সংকট হওয়ারই কথা নয়।
এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারে ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ তথা মার্কিন অবরোধ থাকা সত্বেও রাশিয়ান মুদ্রা রুবলের দাম ডলারের বিপরীতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, এটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা পরিচালনাকারী ও ব্যবসায়ীদের কাছে এক বিস্ময় সৃষ্টি করছে।
গত ২০ বছর ধরে মার্কিনীরা অব্যাহতভাবে বিভিন্ন দেশের ওপর যেভাবে বিভিন্ন সময় বাণিজ্যিক অবরোধ চাপিয়ে দিয়েছে, তার ফলে বিশ্বের প্রায় সকল দেশকেই উদ্বিগ্ন হতে হচ্ছে। বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, হয় মার্কিনীদের নির্ধারিত রাজনৈতিক পথে চলো অথবা তাদের দ্বারা এমন বাণিজ্যিক অবরোধের মুখে পড়ো।
এই সংকট বিশ্বের বেশ কিছু দেশের জন্য এখন গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে একটি সমঝোতার রাস্তায় হাঁটছে। ভারতের রাশিয়ার সাথে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলোর বিরুদ্ধে মার্কিনীরা তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না। ভারত ছাড়া অন্যান্য ছোট ছোট দেশগুলোকে তারা বাধ্য করছে তাদের অনুসৃত নীতিতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সঙ্গ দিতে। অর্থাৎ দেশগুলোর তাদের অনুকূলে থাকতে হবে বর্তমান আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক মুদ্রাব্যবস্থার কারণে।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বহুদেশের বর্তমান অবস্থান আসলে কী তা বোঝা মুশকিল। এদের অনেকেই বিভিন্নভাবে মার্কিনী এই মুদ্রা ব্যবস্থার ভয়ে নিজেদেরকে মার্কিনীদের সঙ্গে রাখছে বলে মনে করা যেতে পারে। তবে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে বিশ্বে মার্কিন ডলারের সাথে সাথে আরেকটি নতুন মুদ্রা ব্যবস্থা ও প্রত্যক্ষ করতে পারে বলে মনে হচ্ছে। মার্কিন ডলারের একত্ববাদীতার পরিসমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে আগামীতে, তার ইশারা যেন ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে ।