চীনের লকডাউনে থমকে আছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্পের কাজ
চীনের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র সাংহাইয়ে চলমান লকডাউনের প্রভাব পড়েছে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রদত্ত দোহাজারী- কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পে। লকডাউনের কারণে বন্ধ আছে প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম আমদানি। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা আগামী দুই মাসের মধ্যে যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তাহলে ২০২৪ সালের আগে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ চালু সম্ভব হবে না।
সম্প্রতি রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন ঘোষণা দেন ২০২৩ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন চালু হবে। অথচ প্রকল্পটির কাজ বাকি অন্তত ৩০ ভাগ। দুটি লটের একটিতে কাজ পিছিয়ে থাকায় ২০২৩ সাল তো দূরে থাক, ২০২৪ সালেও রেল চালু করা যাবে কিনা সে নিয়েই রয়েছে শঙ্কা। ইতোমধ্যে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের সময় বাড়ানোর আবেদন করেছেন প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মফিজুর রহমান।
চীনের বাণিজ্যিক নগরী সাংহাই সেমিকন্ডাক্টর, ইলেকট্রনিকস ও গাড়ি উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। বিশ্বের ব্যস্ততম সমুদ্রবন্দরগুলোর মধ্যে সাংহাই অন্যতম। অমিক্রনের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য আরোপিত হয় লকডাউন।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ মফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মাটি-বালি-রড-সিমেন্ট এ চারটি জিনিস শুধু দেশে পাওয়া যায়। দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাদবাকি ম্যাটেরিয়ালের জন্য আমরা চায়না ও ভারতের উপর নির্ভরশীল। এ অবস্থায় নতুন শঙ্কা হিসেবে দেখা দিয়েছে সাংহাই লকডাউন। প্রায় ২৫ শতাংশ মালামাল সাংহাইতে আটকে আছে। এই লকডাউন যদি শীঘ্রই কেটে না যায়, তাহলে সমস্যা হবে।"
সাংহাইতে আটকে পড়া মালামালের মধ্যে রয়েছে- রেললাইনের ট্রাক, লুপ, অ্যাঙ্গেল, রেলস্টেশনের গ্লাস ও কক্সবাজারের আইকনিক রেলস্টেশনের ঝিনুক আকৃতির কাঠামো।
দোহাজারী- চকরিয়া অংশে ৪৫ শতাংশ কাজই বাকি
দুই ভাগে দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্পের কাজটি সম্পন্ন হচ্ছে। একটি অংশ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। আরেকটি অংশ করছে চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। তবে প্রকল্পের মেয়াদ আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি থাকলেও ৪৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়নি দোহাজারী থেকে চকরিয়া অংশের ৫২ কিলোমিটার অংশে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রথম লটের ১৯টি সেতুর মধ্যে ১৫টির নির্মাণকাজ এখনো চলমান আছে। অনেক জায়গায় এখনো শুরুই হয়নি ভূমি উন্নয়নের কাজ। কিছু অংশে চলছে মাটি ভরাট ও রেল ট্র্যাক বসানোর কাজ।
প্রথম লটের কাজের দায়িত্বে থাকা তমা কন্সট্রাকশনের প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী বিমল সাহা জানিয়েছেন, সঠিক সময়ে কাজ শেষ না হওয়ার প্রধান কারণ সঠিক সময়ে জমি বুঝে না পাওয়া। ২০১৮ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও প্রায় দুই বছর পর ২০২০ সালে তমা কন্সট্রাকশন জমি বুঝে পেয়েছে।
তবে প্রকল্পের দ্বিতীয় লটে চকরিয়া থেকে কক্সবাজারের রামু পর্যন্ত অনেকটাই এগিয়েছে রেলপথ নির্মাণের কাজ। এই লটের ৫২ কিলোমিটার অংশের ৩৫ কিলোমিটারে রেল ট্র্যাক বসে গেছে। অর্ধেকেরও বেশি কাজ শেষ হয়েছে ঝিনুক আকৃতির আইকনিক রেল স্টেশনের। তবে সেখানেও বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাংহাই লকডাউন।
আইকনিক রেল স্টেশন তৈরীর দায়িত্বে থাকা ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী ফরহাদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'রেল ট্র্যাক বসানোর কাজ প্রায় ৭০ শতাংশ শেষ করে এনেছি। ভূমি উন্নয়নের কাজ বাকি আছে ২ শতাংশের মতো। এছাড়া চারটি রেল স্টেশনের কাজও শেষ দিকে। তবে সাংহাই লকডাউনের কারণে আইকনিক রেল স্টেশনের কিছু সরঞ্জামাদি আসছেনা। আশঙ্কা করছি এ জন্য হয়তো প্রকল্পের কাজ দুই থেকে আড়াই মাস পিছিয়ে যাবে।'
তবে প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ মফিজুর রহমানের দাবি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হলেও ২০২৩ সালের জুনে রেল পরিচালনা নিয়ে তিনি এখনো আশাবাদী। তিনি বলেন, "রেল পরিচালনার জন্য ট্র্যাকটাই ওকে হলে চলে। আনুষঙ্গিক বাকি কাজের জন্য একবছর সময় বাড়িয়ে চাওয়া হয়েছে। বর্ষার কারণে কাজ কিছুটা ধীরগতির হলেও, আশা করছি বর্ষার শেষে পুরোদমে কাজ করা যাবে।'
চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. রাশিদুল হাসান উদয় বলেন, "প্রকল্পটি ১১ বছর আগে নেওয়া। অনেক আগেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। সময়মতো বাস্তবায়ন হলে সুফল আরও আগেই পাওয়া যেত, ব্যয়ও কমত।"
স্বপ্ন আটকে যেতে পারে মেয়াদোত্তীর্ণ কালুরঘাট সেতুতে
কর্ণফুলী নদীতে নতুন রেলসেতু নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত কালুরঘাট সেতু দিয়েই ঢাকা-কক্সবাজার ট্রেন চালাতে চায় বাংলাদেশ রেলওয়ে। এজন্য রেলওয়ের আমন্ত্রণে ৯০ বছরের পুরোনো সেতুটি পরিদর্শন করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের পর্যবেক্ষক দল। পর্যবেক্ষণে তারা কালুরঘাট সেতুর জানালিহাট অংশে আবৃত প্রাচীর এবং সুরক্ষা দেয়ালে ফাটল খুঁজে পেয়েছে। এছাড়া আরও বড় ধরনের ছয়টি ত্রুটি চিহ্নিত করেছে। এর আগে ২০১১ সালে সেতুটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়।
২০২১ সালের ৯ অক্টোবর বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পর্যবেক্ষক দলের প্রধান ড. এ এফ এম সাইফুল আমিন, অধ্যাপক ড. খান মাহমুদ আমানত ও ড. আব্দুল জব্বার খান কালুরঘাট সেতু পরিদর্শন করেন।
বুয়েটের পর্যবেক্ষক দলের চিহ্নিত করা বড় ধরনের ত্রুটিগুলোর একটি হলো সেতুর ১ ও ১৫ নম্বর পিয়ার (একধরনের কাঠামো, যা মাটির নিচে বা পানির মধ্যে প্রসারিত থাকে) ইটের গাঁথুনিতে তৈরি। এতে জাহাজ চলাচলের সময় সংঘর্ষ হলে পিয়ারগুলো ভেঙে যেতে পারে। এছাড়া সেতুর গার্ডার, ডেক, অ্যাঙ্গেল, গ্যাসেট প্লেট, রিভেট ও অন্যান্য অংশ প্রচুর পরিমাণে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। তাই সেতুটির ভারবহনের ক্ষমতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে বলে জানিয়েছে পর্যবেক্ষক দল।
পরে রেলওয়ের আহ্বানে কক্সবাজারগামী ট্রেন চলাচল উপযোগী করে তোলার জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে বুয়েট রেলওয়ের কাছে ১২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা প্রস্তাব দিয়েছে। সর্বশেষ ১২ মে সমীক্ষা ফি নির্ধারণ নিয়ে রেলওয়ে এবং বুয়েট বৈঠক হলেও এখনো কোন সমঝোতা হয়নি।
বুয়েট পর্যবেক্ষক দল তাদের প্রতিবেদনে, মেয়াদোত্তীর্ণ কালুরঘাট সেতুর ওপর দিয়ে আদতে নতুন ট্রেন চালানো যাবে কি না সে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ব্রিজের ফাউন্ডেশন ঠিক আছে কি না তার জন্য নদীর তলদেশ পরীক্ষা, সেতুর বর্তমান অবস্থা মূল্যায়ন করার জন্য একটি ডিজিটাল টপোগ্রাফিক জরিপ পরিচালনা, সেতুর অবকাঠামো শক্তিশালীকরণের বিষয়টি পরীক্ষা করাসহ ১৯টি কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করেছে।
রেলপথ বসলো ডুয়েলগেজ, চলবে মিটারগেজেই
২০১০ সালের ৬ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) যখন প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়, তখন দোহাজারী থেকে কক্সবাজার ১০০ কিলোমিটারে সিঙ্গেল লাইন মিটারগেজের পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। তবে ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বরের একনেক সভায় সিঙ্গেল লাইন মিটারগেজের পরিবর্তে ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী ডুয়েলগেজ ট্র্যাকের পাশাপাশি ভবিষ্যতে ডাবল লাইন নির্মাণের প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণের নির্দেশ দেন।
তবে প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মফিজুর রহমান জানিয়েছেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথ মিটারগেজে হওয়ায় কক্সবাজার রুটে ডুয়েলগেজ রেল ইঞ্জিন চালানো সম্ভব নয়। এ লক্ষ্যে চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী অংশটির রেলপথ ডুয়েলগেজে রূপান্তরের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য ভূমি অধিগ্রহণসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করতে আরও সা-আট বছর লেগে যাবে।
"যেহেতু ঢাকা থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথ মিটারগেজ। তাই ডুয়েলগেজ রেল ইঞ্জিনগুলো এখনই চালু করা যাবে না। তবে মিটারগেজ ইঞ্জিন দিয়ে আপাতত রেল চালু করা যাবে," বলেন প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মফিজুর রহমান।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারে রেললাইন নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা শত বছরের পুরোনো। ৯০ বছর আগে রেললাইন নির্মাণ করা হলেও তা দোহাজারীতে গিয়ে থেমে যায়। বর্তমান দোহাজারী-কক্সবাজার ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য, পর্যটননগরী কক্সবাজারে যাতায়াত সহজ করা। পাশাপাশি মিয়ানমারসহ ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করা। তবে বিদ্যমান রোহিঙ্গা সংকটে অর্থনৈতিক জটিলতার কথা বিবেচনা করে দোহাজারী-কক্সবাজার রেল সংযোগের রামু-গুনদুম অংশের কাজ স্থগিত রেখেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।