নতুন সুবিধা তুলে ফেলার তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০,১৬৭ কোটি টাকা
কোভিড পরবর্তীতে দেশের ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়াতে ঋণ পরিশোধে নানা ছাড় দেওয়া হলেও গ্রাহকদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ছে। তিন মাসের ব্যবধানে চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০,১৬৭ কোটি টাকা।
গত ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। তিন মাস পর জানুয়ারি প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্লাসিফায়েড লোন এন্ড প্রভিশনিং রিপোর্ট অনুযায়ী এমন তথ্য জানা গেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, বড় বড় গ্রাহকদের ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো অবস্থানে থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে যথার্থ পদক্ষেপের অভাবে তারা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি হচ্ছে। একইসঙ্গে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে ঋণ পরিশোধের সুবিধা তুলে নেওয়া ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অডিটে ব্যাংকগুলোতে নতুন খেলাপি গ্রাহক বৃদ্ধি পাওয়ায় মার্চ প্রান্তিকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায়, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩,০১,৭৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭.৯৩%। চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩,২৯,৭৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮.৫৩%।
এছাড়া গত ২০২১ সালের মার্চে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৪,২৬৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৯,১৭৫ কোটি টাকা, যা শতাংশ হিসেবে বেড়েছে ২০.৩৪ শতাংশ।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়া গ্রাহকদের পুরোনো অভ্যাস। বারবার যদি ঋণ খেলাপিদের সুবিধা দেওয়া হয় আর ঋণের মেয়াদ বাড়ানো হয় এবং এককালীন ইনস্টলমেন্ট দেওয়া হয়, তাহলে খেলাপিদের তালিকা বাড়বে। আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুযায়ী, যদি ঋণ খেলাপি করা হতো তাহলে ঋণ খেলাপির মাত্রা আরও বেড়ে যেতো।
তিনি আরও বলেন, 'ঋণ খেলাপি থেকে মুক্তি পেতে হলে, তাড়াতাড়ি কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। এটা করতে না পারলে গ্রাহকদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে অথবা অন্য কারণে তারা সুবিধা নিয়ে যাবে। যার ফলে অন্য গ্রাহকদেরও ঋণ পরিশোধে আগ্রহ থাকবে না।'
'একজন গ্রাহক যদি ঋণ খেলাপি হয়ে কোন শাস্তি না পায়, তাহলে তার মধ্যে ঋণ পরিশোধের কোন উদ্যোগ থাকবে না।'
মির্জা আজিজ আরও বলেন, 'ব্যবসায়ীদের মরিটোরিয়াম সুবিধা দেওয়া, শূন্য হারে কর সুবিধা দেয়া এ ধরণের নানা দাবি থাকেই। খেলাপি গ্রাহকদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও শক্ত ভূমিকা থাকা উচিত। ঋণ খেলাপিদের মামলা অর্থঋণ আদালতে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। অর্থ মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবরা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে কিভাবে এই মামলাগুলো তাড়াতাড়ি ডিসক্লোজড করা যায় এবং আইনানুগ শাস্তি পাওয়া যায় সে বিষয়ে চেষ্টা করা উচিত।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট বলছে, খেলাপি ঋণের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ছয়টি ব্যাংকে। এই ছয়টি ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ হলো- ২৪৩৫৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হলো- ৪৮৭৩৭ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ২০%। এছাড়া বিশেষায়িত তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ হলো- ৪০১৫ কোটি টাকা যা তাদের মোট ঋণের ১২.০১ শতাংশ।
একইসঙ্গে বেসরকারি খাতের ৪২টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ হলো- ৫৭৮০৩ কোটি টাকা যা তাদের মোট ঋণের ৫.৮৪%। বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ হলো- ২৮৪৮ কোটি টাকা, এতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ালো ৪.৫৩%।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আরএফ হোসেন টিবিএসকে বলেন, কোভিড পরবর্তীতে দেশের ব্যবসা পুনরুদ্ধার হতে শুরু করেছে। তাই এ খেলাপি ঋণ কমে আসতে আরও পাঁচ-ছয় মাস সময় লাগবে। তবে এটা সব ব্যাংকে নয়, কিছু কিছু ব্যাংক খারাপ করছে। অনেক ব্যাংকে এ সমস্যাটা নেই।
তিনি আরও বলেন, 'কিছু বড় বড় গ্রাহক এ অবস্থায় সুযোগ নিচ্ছে তবে অনেক ছোট ছোট গ্রাহক সময়মতো ঋণ পরিশোধ করে যাচ্ছেন। এবং বিশেষ করে ব্রাক ব্যাংক এসএমই খাতে ব্যাপক পরিমাণে কাজ করে। এ খাতের ঋণ পরিশোধ খুবই ভালো বরং আমাদের খেলাপি ঋণ আরও কমে গেছে।'
তিনি বলেন, 'এখন চারদিক থেকে যেভাবে এক্সটারনাল চাপ আসছে মূল্যস্ফীতিতে, কমোডিটি প্রাইসে, সাপ্লাই চেইন ডিসরাপশন- আমাদের সার্বিক অর্থনীতিতে চাপ পড়েছে। ফলে সামনের সময়ে হয়তো কিছুটা কষ্ট হবে।'
করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার কারণে ২০২০ সালে কেউ ঋণের কিস্তি না দিলেও খেলাপি করেনি ব্যাংকগুলো। পরের বছর সকল ধরনের ঋণের ১৫ শতাংশ পরিশোধ করলে খেলাপি না হওয়ার সুযোগ ছিল, যার মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, 'নতুন বছরের শুরু থেকে ঋণ পরিশোধের বিশেষ সুবিধা না থাকায় অনেক গ্রাহক খেলাপি হয়ে গিয়েছে। এছাড়া অনেক ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের নিয়মিত দেখিয়েছেন কিন্তু আদতে তারা খেলাপি গ্রাহক ছিল, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক অডিটে উঠে এসেছে যার ফলে অনেক নতুন খেলাপি ঋণ বেড়েছে।'
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'মার্চ প্রান্তিকে নতুন ব্যাংকিং খাতের ঋণের পরিমাণ অনেকটা বেড়েছে তাই খেলাপি ঋণও বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া ঋণ পরিশোধের নতুন সুবিধা তুলে ফেলায় খেলাপি ঋণ কিছুটা বেড়েছে। তবে এবার জুনে আশা করি কমে আসবে।'