তার উজ্জ্বল অর্জনের মুহূর্ত, আমাদের গর্বের মুহূর্ত
পদ্মা বহুমুখী সেতু উদ্বোধনের বক্তৃতায় ক্ষণিকের জন্য আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অবরুদ্ধ, আবেগঘন কন্ঠে তিনি বলেন, "আমার ছোট বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা, রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকি, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং সাবেক যোগাযোগ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ করা হয়েছিল।"
এই আবেগ বোধগম্য। কারণ বাংলাদেশের জনগণ ও অর্থনীতির কল্যাণে এ সেতুর গুরুত্ব উপলদ্ধি করে- আন্তর্জাতিক অর্থায়ন নিশ্চিত করতে নিজের সর্বোচ্চটা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এমনকী মোশাররফ হোসেনকে বরখাস্ত এবং আবুল হোসেনকে অন্য মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর করেন তিনি।
কিন্তু, বিদেশি দাতারা তাতেও সন্তুষ্ট হয়নি। অবশেষে, দেশ ও তার নিজের ওপর ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা থাকার পরও তিনি জাতীয় সংসদে অত্যন্ত সাহসীকতার সাথে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণের ঘোষণা দেন।
পার্বত্য শান্তিচুক্তি সই, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়দান, এলডিসি গ্রাজুয়েশন, মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের ভারত ও পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাওয়া, কন্যাশিশুদের শতভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার—১৯ বছর ক্ষমতায় থাকার সময়ে—বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের প্রধানমন্ত্রীর মুকুটে সাফল্যের এমন পালকের সংখ্যা অনেক। কিন্তু, তার কম্পিত কন্ঠই যার সাক্ষ্য দেয়—এ সেতুর নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া—খুবই ব্যক্তিগত এক অর্জন।
পাঁচ দশক আগে যিনি পরিবারের প্রায় সকল সদস্য হারিয়েছেন এবং দেশের বাইরে থাকায় যার প্রাণ কোনোমতে রক্ষা পায়- নিশ্চয় তার কাছে পরিবারই সব হওয়ার কথা। তবুও তিনি তার পরিবারের ওপর আসা অপমান-গঞ্জনাকে অসীম বীরত্বের সাথে সামলেছেন। আর সকল অভিযোগের জবাব কথায় নয় বরং ব্যক্তিগতভাবে দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম এই অবকাঠামো নির্মাণ কাজের তদারকির মাধ্যমে দিয়েছেন।
তবে ব্যক্তিগত অর্জনকে তুলে ধরার মানুষ তিনি নন। একারণেই অনেক অনুরোধ আসা সত্ত্বেও তিনি এ সেতুর নামকরণ নিজ নামে করতে অস্বীকার করেন। তার বিপরীতে, যেমন তিনি সব সময়ই করেন, সেভাবেই এ সেতুর কৃতিত্ব দিয়েছেন দেশের জনগণকে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ভাষণে তিনি বলেন, "বাঙালি বীরের জাতি। বাংলার ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায় আত্মত্যাগ ও রক্তে লেখা। তবে বাঙালি আজ আবার গর্বিত।"
কাব্যিক পংক্তিতে তিনি বলেন: "যতবারই হত্যা কর, জন্মাব আবার; দারুণ সূর্য হব, লিখব নতুন ইতিহাস।"
তার এ বিনম্র উচ্চারণের অন্তঃসার- সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে উপস্থিত হাজার হাজার জনতার কাছে ঠিকই পৌঁছে যায়। বিশাল এই সেতু উপহার পাওয়ার জন্য তার কাছে ঋণী তো তারাই।
সেতুর উদ্বোধন উদযাপনে চট্টগ্রাম থেকে শিবচরে আসা জনৈক রফিক বলেন, "দুইশ বছরেও এমনটা হবে আমরা কল্পনা করিনি। কিন্তু আল্লাহ শেখ হাসিনাকে বুদ্ধি দিয়েছেন। ওরা বলেছিল, তিনি পারবেন না। কিন্তু, তিনিও তার বাপের বেটি। তিনি কী করতে পারেন তা পুরো দুনিয়াকে দেখিয়ে দিয়েছেন।"
অনেক দিক থেকেই এ সেতুর অর্থনৈতিক গুরুত্ব স্পষ্ট- আগামী দিন, মাস ও বছরগুলোয় যা আরও দৃশ্যমান হতে থাকবে। তবে সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়া- এটি যে অর্থনৈতিক মূল্য যোগ করবে শুধু সে কারণে নয় বরং এটি যে প্রতীকী মূল্যের প্রতিনিধিত্ব করছে – সেকারণেও তাৎপর্যপূর্ণ।
স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েক দশক আন্তর্জাতিক ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল থাকায় যে দেশকে একসময় আন্তর্জাতিকভাবে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে অবজ্ঞা করা হয়েছিল, সেই দেশের পক্ষে বৈশ্বিক দাতাদের অমান্য করে এত বড় অবকাঠামো প্রকল্প হাতে নেওয়া ও তা বাস্তবায়ন- রীতিমতো বিস্ময়ের চেয়ে কম কিছু নয়।
আমরা শুধু অর্থায়নের ভার নেইনি, একইসাথে বিশ্বের অন্যতম প্রমত্তা নদী পদ্মার বুকে নির্মাণের চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তা ও সমর্থনে বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা অনেক সংগ্রাম করে সেতু নির্মাণের পথে আসা বড় বড় প্রকৌশলবিদ্যার চ্যালেঞ্জগুলিকে মোকাবিলায় সফল হয়েছেন।
তারই সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, "এই সেতু শুধু ইট, সিমেন্ট, ইস্পাত আর কংক্রিটের কাঠামো নয়। এটি আমাদের অহংকার। সক্ষমতা ও মর্যাদার প্রতীক। এই সেতু বাংলাদেশের জনগণের। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আবেগ, সাহসিকতা, সহনশীলতা, জেদ ও প্রত্যয়। এই প্রত্যয় থেকেই আমদা পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পেরেছি...এর প্রতিটি পিলার বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।"
নিজের সবচেয়ে গৌরবের এই মুহূর্তে, তিনি কারো প্রতি বিদ্বেষ ধরে রাখেননি।
"কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ, অনুযোগ নেই। তবে যারা বলেছিলেন নিজেদের অর্থায়নে সম্ভব নয়, নিছক স্বপ্নমাত্র, তাদের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি আছে। আমি আশা করি এই সেতু তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াবে"- প্রকল্প কর্তৃপক্ষসহ, পরামর্শক, ঠিকাদার, শ্রমিক, সেনা সদস্য এবং পদ্মা সেতু নির্মাণে জড়িত অন্যান্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পর বলেন তিনি।
তবে সর্বাগ্রে তিনি জনতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান আর এই সেতুর কৃতিত্ব তাদেরই দেন।
"আমি আমার বাবা ও ভাইদের হারিয়েছে। আপনাদের থেকেই পেয়েছি বাবার স্নেহ, মায়ের মমতা, ভাইয়ের ভালোবাসা। আমি আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পাশেই আছি। আপনাদের ভাগ্য পরিবর্তনে আমি যেকোনো আত্মত্যাগ স্বীকার করতে তৈরি আছি। আমি আমার প্রতিজ্ঞা পূরণ করেছি"- সেতুর জাজিরা প্রান্তে এক সমাবেশে বলেন তিনি।
শনিবার তিনি যখন গাড়ি থেকে নেমে প্রমত্তা পদ্মা ও তার উপর নির্মিত সেতুর দিকে তাকিয়েছিলেন- নিশ্চয় গর্ব আর বিষাদ দুয়েই ভরে উঠছিল তার মন। তিনি ও তার জনগণ চাইলে কী অর্জন করতে পারেন- গর্ব সে উপলদ্ধি থেকে। আর বিষাদ এ অর্জনের জন্য তাকে যে মূল্য দিতে হয়েছে- হয়তো সেকথা ভেবেই।
তবুও তিনি বলেছেন, "আজকের শুভদিনে- কারো প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ নেই। আমি শুধু দেশবাসীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। তারা পাশে থাকার কারণেই এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছি। আমি বিশ্বাস করি, পরপার থেকে আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আমাকে সাহস জুগিয়েছেন, আশীর্বাদ করেছেন।"