অটোমোবাইল শিল্পে নতুন সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ
এক দশকের মাঝে বাংলাদেশে দুই চাকার মোটরসাইকেল বাজারের সম্প্রসারণ ঘটেছে তিনগুণেরও বেশি। একইসঙ্গে কমে গেছে আমদানি নির্ভরতা । বর্তমানে দেশে বার্ষিক মোটরসাইকেল বিক্রির ৯০ শতাংশ সরবরাহ চাহিদা পূরণ করছে স্থানীয় প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো।
সহযোগী রাষ্ট্র, বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং স্থানীর বেসরকারি খাতের সাথে মিলিতভাবে সরকার দেশের অটোমোবাইল খাতেও মোটরসাইকেল বিপ্লবের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা করছে। আগামী বছরগুলোতে দেশের অটোমোবাইল খাতের উন্নয়নের জন্য উন্মোচিত হয়েছে সম্ভাবনার নতুর দ্বার।
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রণোদনার মাধ্যমে স্থানীয় প্রস্তুতকারকদের সন্নিবেশন ব্যবস্থা জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। এছাড়া স্থানীয়ভাবে যন্ত্রাংশ উৎপাদনের দিকেও মনোযোগ দেওয়া হবে। সাধারণভাবে পরিকল্পনাটি উন্নয়নশীল উৎপাদন নীতি হিসেবে পরিচিত।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত 'অটোমোবাইল শিল্পের উন্নয়ন: বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা' শীর্ষক এক ওয়েবিনারে রোববার বক্তারা স্থানীয়ভাবে সমৃদ্ধ অটোমোবাইল এবং অটোমোটিভ খাত গড়ে তোলার লক্ষ্যে সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। পরিকল্পনাটি বহুমুখী রপ্তানি খাত সৃষ্টি এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির পরিপক্কতা অর্জনের সহায়ক হবে বলে মন্তব্য করেন অংশগ্রহণকারীরা।
প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা প্রদানের সময় শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়তে থাকার সাথে স্থানীয়ভাবে গাড়ির চাহিদাও বেড়েছে। এছাড়া তিনি, সরকারের পক্ষ থেকে শিল্পাঞ্চলে গাড়ি ও যন্ত্রাংশ নির্মাণ কারখানা স্থাপনের জন্য বিদেশি ও বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগের আহ্বান জানান।
'মোটরসাইকেল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা ২০১৮' অনুসরণ করে সরকার বর্তমানে 'অটোমোবাইল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা ২০২০' প্রণয়নের পরিকল্পনা করছে। তবে নীতিমালার খসড়ায় পাঁচ বছরের মধ্যে ধীরে ধীরে রিকন্ডিশনড পরিবহন আমদানি বন্ধ করে দেওয়ার উল্লেখ থাকায় তা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের গাড়ির বাজার মূলত জাপানি রিকন্ডিশনড গাড়ির ওপর নির্ভরশীল। জাপানের শীর্ষ গাড়ির ব্র্যান্ডগুলোর বিস্তৃত মডেল এবং দৃশ্যমান নির্ভরযোগ্যতার কারণে দেশের বাজারে গাড়িগুলো জনপ্রিয়।
তবে নীতিমালা চূড়ান্ত হওয়ার আগেই উত্তরা মোটরস, ইফাদ, রানার, জিপিএইচসহ স্থানীয় শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিদেশি প্রযুক্তি বিষয়ক অংশীদারদের সাথে মিলিতভাবে চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরীতে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাবনা পেশ করেছে। উদীয়মান শিল্পাঞ্চলটিও অটোমোবাইল বিনিয়োগকারীদের জন্য উপযোগী পরিকল্পনা প্রস্তাব রেখেছে।
বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ফেয়ার টেকনোলজিস স্থানীয়ভাবে হুন্দাই গাড়ির সংযোজন ও প্রস্তুতকারক কারখানা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছয় দশকের পুরনো প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ পরিবহন সংযোজন কারখানার মতো নতুন কারখানা স্থাপনে শিল্প মন্ত্রণালয় জাপানিজ মিতসুবিশি মোটরসের সাথে যৌথ উদ্যোগের বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছে। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অটোমোবাইল বিনিয়োগের আরও ডজনখানেক পরিকল্পনার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
চট্টগ্রামে পিএইচপি অটোমোবাইল কয়েক বছর ধরেই মালেশিয়ার প্রোটন ব্র্যান্ডের গাড়িগুলো সন্নিবেশনের কাজ করে যাচ্ছে। দেশে বিদ্যমান অস্বাভাবিক শুল্কের মাঝে কিছুটা সাশ্রয়ী সুবিধা দিতেই এগিয়ে এসেছে পিএইচপি।
এছাড়া স্থানীয় কিছু প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক পরিবহন সন্নিবেশনের কাজও করে চলেছে।
বাজার পর্যালোচনা
আয়োজিত ওয়েবিনারে ইফাদ গ্রুপের সহ নির্বাহী পরিচালক তাসকিন আহমেদ বলেন, 'কোভিড-১৯ আসার আগে বাংলাদেশের অটোমোবাইল বাজার গড়ে বার্ষিক ১৫-২০ শতাংশ হারে সম্প্রসারিত হচ্ছিল। অন্যদিকে, অটো পার্টসের বাজার সম্প্রসারণের হার ছিল গড়ে ১২ শতাংশ। বৈশ্বিক গড় হারের তুলনায় উভয় ক্ষেত্রেই সম্প্রসারণ হার ছিল উচ্চ।'
'দেশে রাস্তা, মহাসড়ক, ব্রিজ ও টানেল এবং আঞ্চলিক সংযোজন উদ্যোগের দৃশ্যমান অবকাঠামোর পাশাপাশি বাংলাদেশ দুই চাকা, যাত্রীবাহী গাড়ি, হালকা ও ভারি বাণিজ্যিক পরিবহন কিংবা তিন চাকার বাহনের মতো অটোমোবাইলের উচ্চ চাহিদার মুখোমুখি দাঁড়াতে চলেছে,' বলেন তাসকিন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) মতে, দেশে রেজিস্ট্রিকৃত মোটরচালিত যানের সংখ্যা ৪৬ লাখের বেশি। তবে এ ধরনের মোটরচালিত যানের অধিকাংশই দুই বা তিন চাকার, যেগুলোর রেজিস্ট্রেশন নেই।
মোট রেজিস্ট্রিকৃত পরিবহনের প্রায় ৮০ শতাংশ দুই-চাকা বিশিষ্ট। বাকি ৫ শতাংশ যাত্রীবাহী গাড়ি। এর বাইরে বাস, ট্রাক, পিকআপ, অটো রিকশা, ভ্যান এবং মাইক্রোবাস মিলে আছে বাকি অংশ।
সম্ভাবনা ও প্রতিকূলতা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্থানীয় প্রস্তুতকারকদের কারণে মোটরসাইকেল সুলভ হওয়ায় বাৎসরিক বিক্রির পরিমাণ প্রায় পাঁচ লাখে গিয়ে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, দশ লাখের মাইলফলকে পৌঁছালে স্থানীয় শিল্পকারখানাগুলো যন্ত্রাংশ উৎপাদনেও সচেষ্ট হবে। শক্তিশালী শিল্প কাঠামো গড়ে তোলার জন্য যন্ত্রাংশ উৎপাদন জরুরি।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সির (জিকা) একটি গবেষণার উল্লেখ করে বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি আবদুল হক বলেন, সম্ভাব্য গাড়ি শিল্পখাতের জন্য গাড়ির বাজার বার্ষিক এক লাখ ইউনিট পর্যন্ত পৌঁছানো জরুরি। চাহিদার পরিমাণ কম হলে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পরিচালনা কঠিন হবে।
বর্তমানে দেশে প্রতি বছর ১২ হাজার থেকে ২৯ হাজার গাড়ি বিক্রি হয়।
দেশের প্রায় ৯০০ রিকন্ডিশনড গাড়ি আমদানিকারক ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বদানকারী আবদুল হক আরও বলেন, সরকার যুক্তিসংগত কর এবং শুল্ক আরোপের মাধ্যমে গাড়িকে সুলভ পণ্যে পরিণত করলে বাংলাদেশে গাড়ির বাজার বৃদ্ধি পাওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ বিরল একটি দেশ যেখানে আমদানিকৃত গাড়িগুলোকে অস্বাভাবিক উচ্চ কর ও শুল্ক প্রদান করতে হয়। দেশে ইঞ্জিন সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে গাড়ির শুল্ক ১২৮ শতাংশ থেকে শুরু করে ৭০০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
আঞ্চলিক বাজার প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হওয়ায় গাড়ি রপ্তানি করা সহজ হবে না বলে জানান জিকা বাংলাদেশের শীর্ষ প্রতিনিধি হায়াকাওয়া ইউহো।
তিনি সরকারে ধাপে ধাপে আগানোর পরামর্শ দেন। প্রথমে প্রণোদনার মাধ্যমে সন্নিবেশ কারখানাগুলোকে জোরদার করতে হবে। পরবর্তীকালে ধাপে ধাপে যন্ত্রাংশ উৎপাদন থেকে বাজার সম্প্রসারণের দিকে আগাতে হবে।
দৃঢ় বাজার গঠনের জন্য রিকন্ডিশনড গাড়ি ছাড়াও বাজারে পুরোপুরি নতুন গাড়ির বাস্তবভিত্তিক সমন্বয় সাধনের পরামর্শ দেন ইউহো।
সাবধানতার সাথে পর্যায়ক্রমিক পরিকল্পনা গঠনের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা কম খরচে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারবেন। বাংলাদেশের শিল্পখাতের পট পরিবর্তনে এই পরিকল্পনা ভূমিকা রাখবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
যন্ত্রাংশ উৎপাদনের আছে বিশাল সম্ভাবনা
সরকারি অগ্রাধিকার প্রাপ্ত সরল প্রকৌশল খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল অটোমোটিভ যন্ত্রাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয় বাজার সমৃদ্ধ করার আকাঙ্ক্ষা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানি খাত বৃদ্ধিতেও যন্ত্রাংশ উৎপাদনের আছে উজ্জ্বল সম্ভাবনা।
তাসকিন তার বক্তৃতায় জানান, যন্ত্রাংশের বর্তমান বার্ষিক বাজার দর ১৪০০ কোটি টাকার সমমূল্য। এছাড়াও এর বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ১২ শতাংশ। প্রায় ২০০ আমদানিকারক বর্তমানে এই চাহিদা পূরণে নিয়োজিত রয়েছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, বৈশ্বিকভাবে তৈরি পোশাক শিল্পের বাজারের তুলনায় যন্ত্রাংশের বাজার বেশি বড়।
ডেট্রয়েট অটোমোটিভ টেকনোলজির কনসালটেন্ট প্রবাসী বাংলাদেশি প্রকৌশলী সৈয়দ ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বিশ্ব বাজারে অটোমোটিভ ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশে অবদান রাখার মতো পূর্ণ সম্ভাবনা বাংলাদেশের আছে।
'উদাহরণস্বরূপ, আধুনিক যানবাহনে ডজনখানেক করে ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক কনট্রোল ইউনিট (ইসিইউ) হার্ডওয়্যারের প্রতিটির মূল্য প্রায় ৩০ ডলার। কিন্তু ইউনিটে ইন্সটল করা সফটওয়্যারের পেছনে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো লাখ লাখ ডলার ব্যয় করে থাকে।'
সরকারের উচিত স্থানীয় হাজার হাজার কম্পিউটার সায়েন্স স্নাতকদের নতুন উদ্যোগে যুক্ত করা। উন্নত দেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে বিষয়টি বিশেষভাবে সাহায্য করবে।
বর্তমানে যা প্রয়োজন
সুজুকির স্থানীয় সন্নিবেশন কারখানায় প্রায় ২৮৫ কোটি বিনিয়োগ করতে চলেছে উত্তরা গ্রুপ অব কোম্পানিজ। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান মতিউর রহমান বলেন, 'আমরা এই খাতে এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। এই খাতকে এগিয়ে নিতে দীর্ঘমেয়াদী নীতিমালা ও প্রণোদনা প্রণয়ন ভূমিকা রাখবে।'
প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুজ্জামান জানান, সামনের দিনগুলোতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটি আরও অধিক কর্মতৎপর হতে চলেছে।
ওয়েবিনারে সভাপতিত্ব করেন ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রহমান। তিনি জানান, সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সহায়ক কর কাঠামো এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাব, স্থানীয়ভাবে পর্যাপ্ত কাঁচামালের যোগান না থাকা, দক্ষ মানবসম্পদ ও অপর্যাপ্ত ব্যাককওয়ার্ড লিংকেজ ইত্যাদি কারণে আমাদের অটোমোবাইল শিল্পে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হচ্ছে না।
এছাড়া তিনি পরিবহন সন্নিবেশন ও উৎপাদনে সহায়তার জন্য দীর্ঘমেয়াদী নীতিমালা এবং অন্তত ৫-১০ বছরের টেকসই শুল্ক নীতি প্রণয়নে জোর দেন।
স্থানীয়ভাবে রপ্তানিকারকদের গড়ে তুলতে তিনি পৃথক অটোমোবাইল শিল্প এলাকা স্থাপন এবং যন্ত্রাংশ উৎপাদনে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণে অনুমতি প্রদানের আহ্বান জানান।