আম্বানির প্রতিপক্ষ বেজোস: লড়াই নাকি অপেক্ষার খেলা?
বিশ্বের ১ নম্বর ধনকুবেরের সঙ্গে প্রস্তুত হচ্ছে ৬ নম্বর ধনীর বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বীতার রণক্ষেত্র। কিন্তু, আইনি টানাপড়েন শুধুই মূল প্রতিযোগিতার খণ্ডচিত্র। প্রকৃতপক্ষে জেফ বেজোস আর মুকেশ আম্বানি লড়ছেন তাদের দুজনের জন্যেই উন্মুক্ত একশ' কোটি জনতার ভোক্তাবাজার; ভারতে ব্যবসায় নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ নিয়ে।
লড়াইয়ের মূল ক্ষেত্র একটি চুক্তি। গত আগস্টেই ভারতীয় ধনকুবের মুকেশের রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লি. দেনা জর্জরিত স্থানীয় রিটেইল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ফিউচার গ্রুপের সম্পত্তি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেয়। অ্যামাজন এ লেনদেন ঠেকাতে চাইছে।
শুনে আশাভঙ্গ হতে পারে অনেকের। শীর্ষ দুই ধনী একযোগে কাজ করবেন এমন প্রত্যাশা করা হচ্ছিল।
গত সেপ্টেম্বরেই ব্লুমবার্গ প্রকাশিত এক সংবাদ মারফত জানা যায়, রিলায়েন্স রিটেইল ভেঞ্চার লিমিটেডের ৪০ শতাংশ শেয়ার অ্যামাজনের কাছে বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছিলেন আম্বানি। চলতি বছরের শুরুতে ফেসবুক এবং গুগলের মালিকানা প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট ইঙ্কের সঙ্গে সফল বিনিয়োগ চুক্তির পর তিনি অ্যামাজনের বিনিয়োগও প্রত্যাশা করেছিলেন।
এ অবস্থায় আম্বানির ফিউচার অধিগ্রহণে বাধা দিয়ে বেজোসের স্পষ্ট ইঙ্গিত; তিনি সহযোগী নন বরং প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে থাকতেই আগ্রহী। অথবা, তাকে বিনিয়োগের যে প্রস্তাব আম্বানি দিয়েছেন, সেটি আরো আকর্ষণীয় করে তোলার কৌশলও হতে পারে।
দুই পক্ষের দাবি-পাল্টা দাবির মাঝখানের কথাগুলো জানলে আসল বিবাদ কিন্তু বেশ মজার ও আকর্ষণীয় মনে হবে পাঠকের কাছে।
ভারতে আধুনিক রিটেইল পদ্ধতির ব্যবসার পথিকৃৎ কিশোর বিয়ানি। তিনি ফিউচার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এবং মুখ্য নির্বাহী। তার ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের ৪৯ শতাংশ মালিকানা গত বছরই কিনে নেয় অ্যামাজন। ওই সূত্রেই পুজিবাজারে লেনদেনকৃত ফিউচার রিটেইল লিমিটেডে থাকা বিয়ানির শেয়ার মালিকানা লাভ করে মার্কিন বাণিজ্যিক জায়ান্টটি। শর্ত অনুসারে অধিগ্রহণের তৃতীয় বছর থেকে এ স্বত্ব অ্যামাজন পাবে।
তবে একইসঙ্গে বেজোসও কিছু শর্ত দেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিল বিয়ানি তার প্রতিষ্ঠানের সম্পদ যেমন; সমগ্র ভারতে থাকা দেড় হাজার বিপণীকেন্দ্র নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতে পারবেন না। ভারতীয় মালিকানার সর্ববৃহৎ রিটেইল চেইন রিলায়েন্সের কথা সেখানে স্পষ্ট করেই উল্লেখ করা হয়।
তাই ফিউচার-রিলায়েন্স চুক্তি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ আনে অ্যামাজন। সিঙ্গাপুর ভিত্তিক একটি বাণিজ্যিক বিরোধী নিষ্পত্তি আদালতের মাধ্যমে তারা এ বিক্রির বিরুদ্ধে একটি মধ্যবর্তী স্থগিতাদেশ জারি করায়। এরপর ভারতীয় পুঁজিবাজার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে এক চিঠিতে লেনদেনটি অনুমোদন না দেওয়ারও অনুরোধ করে।
সিঙ্গাপুর এশিয়ার অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এবং সেখানে এশিয়ার আন্তঃসীমান্ত ব্যবসায়ীক বিরোধ নিষ্পত্তির চল রয়েছে।
তবে সিঙ্গাপুরের দেওয়া রায়টি ভারতে আইনত ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে ফিউচার রিটেইল। প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, বিয়ানির সঙ্গে অ্যামাজনের করা মূল চুক্তিতে অংশগ্রহণ না থাকায়, এই স্থগিতাদেশ কোনোভাবেই তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, চলমান মহামারির মধ্যে ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কারণে; সব সম্পদ রিলায়েন্সের কাছে বিক্রি করাকেই সঠিক পদক্ষেপ মনে করছেন তাদের সমস্ত অংশীদার। এজন্য অ্যামাজন ১৯ কোটি ডলারের যে ক্ষতিপূরণ ও সুদ দাবি করেছে, তা যদি মধ্যস্ততাকারী আদালত মঞ্জুরও করেন- তাহলে সেটা পরিশোধের ভার বিয়ানির ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকা কোম্পানির। ফিউচার রিটেইল এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী পক্ষ নয়।
আসল ঘটনা হচ্ছে অনেক বড় শক্তির খেলায় দাবার গুটি হয়ে গেছেন বিয়ানি। ফিউচারও হঠাৎ করেই অর্থ সংকটে পড়েনি। দীর্ঘ সময় ধরেই তারা একটা মন্দার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। তখনই রিটেইল চেইনটির সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারতো অ্যামাজন। কিন্তু, সেটা তারা করেনি।
নিজেদের পছন্দনীয় মূল্য পেলে এখনও হয়তো আম্বানির সহযোগী হতে আগ্রহী হবে অ্যামাজন। কারণ, সিলভার লেক পার্টনার্স, কেকেকে অ্যান্ড কোং- এর মতো বিনিয়োগকারীরা ইতোমধ্যেই পাঁচশ' কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে আম্বানির ব্যবসায়।
ভারতের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খুচরা পণ্য বিক্রির উদ্যোগে তারা বিনিয়োগের সুযোগ হারাতে চায়নি। রিলায়েন্স রিটেইলে ক্রেতারা বিপণন কেন্দ্রে সরাসরি গিয়ে বা ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে ঘরে বসেই পণ্য ক্রয় করতে পারবেন। পাশাপাশি, রিলায়েন্স টেলিকমের ৪জি নেটওয়ার্কের আওতায় আছেন ৪০ কোটি ব্যবহারকারী। শুরু থেকেই তাদের খুচরা পণ্য ব্যবসার ভোক্তা হিসেবে টার্গেট করা হয়েছে।
অ্যামাজনের কাছে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তার আওতায় ৪০ শতাংশ মালিকানা লাভের জন্য রিলায়েন্সে দুই হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু, বাধা পেয়ে আম্বানি কীভাবে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন- তা দেখার জন্যই হয়তো অপেক্ষা করছেন বেজোস। সেই সামর্থ্য তার আছে। হয়তো এই নিয়েই বাড়তি কিছু সুবিধা নিয়ে নেবেন চূড়ান্ত দর কষাকষির সময়ে।
ভারতে অ্যামাজনের ব্যবসাও নেহাৎ মন্দ নয়। উৎসবের মওসুম কেন্দ্র করে গত মাসের প্রথম কয়েকদিনেই পণ্য বিক্রির নতুন রেকর্ড করে অ্যামাজন। কম যায়নি রিলায়েন্স রিটেইল। সেপ্টেম্বরে সমাপ্ত প্রান্তিকে তাদের আয় বাড়ে ৩০ শতাংশ।
ভারতজুড়ে লকডাউন শেষ হয়েছে, কিন্তু তারপরও খোলেনি অধিকাংশ দোকানপাট। অনেক ব্যবসা আর্থিক ক্ষতির ধাক্কা কাটিয়ে সচল হতেই হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে, শপিং মলে যাপিত-জীবনের নানা পণ্য এবং ফ্যাশন সামগ্রী বিক্রেতারাই হয়েছে বেশি ক্ষতির শিকার।
তবে পুঁজিবাজারে আর্থিক সেবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ম্যাককোয়ারির অনুমান, আগামী বছর রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ারপ্রতি আয় বাজার পুর্বাভাসের চাইতে ২৩ শতাংশ কমতে পারে।
তীব্র বাজার প্রতিযোগীতা, সেই তুলনায় বেশি বিনিয়োগ এবং খুচরা পণ্য বিক্রিতে লভ্যাংশ কম থাকার কারণেই এমনটি হওয়ার আভাস দেয় ব্রোকারেজ হাউজটি। এরপরই গত সোমবার রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার মুম্বাই বাজারে ৮.৬% পতনের শিকার হয়।
এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, এই মুহূর্তে অ্যামাজনের বড় অংকের বিনিয়োগ আম্বানির দরকার।
অ্যামাজনও যথেষ্ট কৌশলী পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারতের সিক্যিউরিটি ও এক্সচেঞ্জ বোর্ডের কাছে পাঠানো চিঠিতে তারা দেশটিতে সহজে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে বিদেশি মালিকানার প্রতিষ্ঠান যে প্রতিকূলতার শিকার হয়, তা উল্লেখ করে। ভোডাফোন পিএলসি থেকে ক্রেইন এনার্জি পিএলসি'র মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এর আগেও বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সম্পর্কে উত্তেজনা দেখা দেয়।
অ্যামাজনের চিঠিতে এসব প্রসঙ্গ উল্লেখ করে স্থানীয় বাজারে নিবন্ধিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্থাটির নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন, বলে চিঠিতে উল্লেখ করে অ্যামাজন। বার্তা সংস্থা রয়টার্স চিঠিটির অনুলিপি দেখেই বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিশ্চিত করেছে।
মহামারিতে ভারতীয় অর্থনীতি বিপুল চাপের মুখে। এঅবস্থায় নতুন করে দুর্নাম কুড়াতে চাইবে না ভারত। তাও আবার অ্যামাজনের মতো বিশ্বের বৃহত্তম কোম্পানির বিপক্ষে গিয়ে। তাছাড়া, সত্যি কথাটা হলো; ভারতে ই-কমার্স ব্যবসা চাইলেও ইচ্ছেমতো ব্যবসা করতে পারছে না সিয়াটল ভিত্তিক জায়ান্টটি। নিজস্ব পণ্য মজুদ যেমন করতে পারে না, তেমনি নেই বিক্রি করা পণ্যে বড় অংকের বাট্টা দেওয়ার সুযোগ।
তাছাড়া, স্থানীয়ভাবে বাণিজ্যিক তথ্য এবং অ্যালগরিদম সংরক্ষণ করার নিয়ম-কানুনও অচিরেই চালু করছে ভারত সরকার। নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাই অ্যামাজনকে বাণিজ্যিক বিরোধ তৈরির সুযোগ দিতে চাইবে না। কারণ এমনটা হলে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের চোখে ভারতের আরেক দফা মানহানি হবে।
তাই হাবেভাবে মনে হচ্ছে, অপেক্ষার খেলাই বেছে নিয়েছেন বেজোস। আর কৌশলটি নেহাত মন্দও নয়।