গ্রাম পর্যায়ে করদাতা সৃষ্টি করছে কেপিআই
দিপালী ত্রিপুরা। খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার বাইল্লাছড়ি মুসলিমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তিনি। সরকারি কর সীমার আওতায় তার বেতন হলেও কখনো রিটার্ন দাখিল করেননি।
খাগড়াছড়ির দূর্গম পাহাড়ি অঞ্চল মাটিরাঙ্গা উপজেলা থেকে চট্টগ্রাম গিয়ে আয়কর রিটার্ন দাখিল করা ব্যয়বহুল এবং কষ্টকর। সময় লাগে দুই থেকে তিন দিন। দুই বছর আগে মাটিরাঙ্গা উপজেলা রিসোর্স সেন্টারে কেপিআই সাার্ভিস বিডির আয়কর বিষয়ক কর্মশালায় অংশ নেন। সেখান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে দিপালী ত্রিপুরা গত দুই বছর নিজ এলাকায় থেকে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন।
আয়কর সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান কেপিআই (Key Performance Indicators) সার্ভিস বিডি গত দুই বছর ধরে চট্টগ্রাম জেলার ১২টি উপজেলা এবং খাগড়াছড়ির দুটি উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আয়কর বিষয়ক পাঁচ শতাধিক কর্মশালার আয়োজন করে। তাদের এই সেমিনারে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিন হাজার নতুন করদাতা কর প্রদানের জন্য নিবন্ধন করেন। যাদের বেশিরভাগই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদরাসা এবং কলেজের শিক্ষক।
তারা আগে কখনো রিটার্ন দাখিল কিংবা আয়কর প্রদান করেননি। এসব শিক্ষকদের কাছ থেকে দুই বছরে চট্টগ্রাম কর অঞ্চল-৪ এর ৭৯ সার্কেল আয়কর পেয়েছে সাড়ে তিন কোটি টাকা। শিক্ষকরা এখন এলাকায় বসে আয়কর রিটার্ন দাখিল, আয়কর পরিশোধ করতে পারেন। এক্ষেত্রে মাধ্যম হিসেবে কাজ করে কেপিআই।
চট্টগ্রাম কর অঞ্চল-৪ এর ডেপুটি কমিশনার সাইফুল ইসলাম জানান, কেপিআই এর মাধ্যমে গত দুই বছরে তিন হাজার নতুন করদাতা সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামের স্কুল থেকে আয়কর আদায়ের হার খুবই কম ছিল। গত দুই বছরে এসব এলাকা থেকে আয়কর রিটার্ন দাখিল এবং কর আদায়ের হার আমাদের প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেছে।
তিনি কেপিআই কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি আমাদের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে। লোকবলের অভাবে তৃনমূলে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। সেখানে আমাদের হয়ে কাজটি করছে কেপিআই। তাদের এই উদ্যোগ নতুন করদাতা সৃষ্টিতে মাইলফলক সৃষ্টি করেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (টেক্স আপিল এন্ড এক্সামশান) মো. মেফতাহ উদ্দিন খান বলেন, সরকারের সঙ্গে তাদের কোনো চুক্তি নেই। নিজ উদ্যোগে তারা সহয়তা করছে। নতুন করদাতা সৃষ্টিতে শিক্ষকদের উদ্বুদ্ধ করতে খাগড়াছড়ির দুর্গম এলাকাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে কেপিআই যে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে তা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। আমরাও চাচ্ছি সব এলাকা আয়করের আওতায় আসুক। এ ধরনের উদ্যোগ আরও বিস্তৃত হলে নিঃসন্দেহে করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
কেপিআই সার্ভিস বিডির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রিয় দে বলেন, করভীতি দূরীকরণ, করনেট সম্প্রসারণ, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো সর্বোপরী জনগনের মাঝে আয়কর সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে কেপিআইয়ের যাত্রা শুরু হয়।
তিনি আরও বলেন, আমরা ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই, সীতাকুণ্ড , সন্দ্বীপ, হাটহাজারী, রাউজান, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়াসহ একাধিক উপজেলায় আয়কর সেবা দিয়েছি।
কেপিআই'র এই কার্যক্রম সম্পর্কে প্রিয় দে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকদের সমন্বয় সভায় আমরা আয়কর কর্মশালার আয়োজন করি। সেখানে আয়কর বিষয়ক নিয়মনীতি, কর পরিকল্পনা, টিআইএন রেজিষ্ট্রেশন, রিটার্ণ দাখিল, অর্থ আইনসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সেশন পরিচালনা করা হয়। সকল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, কলেজে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে গিয়ে আয়কর কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এর মাধ্যমে আয়কর বিষয়ে শিক্ষকদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কৃষ্ণ লাল দেব নাথ বলেন, দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে যারা বসবাস করে তাদের পক্ষে শহরে গিয়ে আয়কর রিটার্ণ দাখিল করা কষ্টকর এবং সময়সাপেক্ষ। সেই বাস্তবতায় কেপিআই মাটিরাঙ্গা উপজেলায় এসে কর্মশালা আয়োজনের পাশাপাশি টিআইএন সার্টিফিকেট, আয়কর রিটার্ন দাখিলের যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।
কেপিআই সবচেয়ে বেশি আয়করদাতা সৃষ্টি করেছে মিরসরাই উপজেলায়। এই উপজেলায় ৮০০ জন ব্যক্তিশ্রেণির করদাতা সৃষ্টি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। যাদের বেশিরভাগই শিক্ষক।
বোয়ালখালী উপজেলার কদুরখীল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিশ^জিৎ বড়–য়া জানান, আয়কর সম্পর্কিত কেপিআইয়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক আয়কর কর্মসূচি করদাতাদের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাদের কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের স্কুলের ১৩ জন শিক্ষক এ বছর আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ।
আইসিবি (ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড একাউটেন্টস অব বাংলাদেশ) চট্টগ্রাম শাখার সাবেক সভাপতি ও কেডিএস গ্রুপের চিফ ফিন্যানসিয়াল অফিসার কামরুল হাসান জানান, বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীদের মূল বেতন ১৬ হাজার টাকার উর্ধ্বে হলে টিআইএন ও আয়কর রিটার্ণ দাখিল বাধ্যতামুলক করা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে কেপিআইয়ের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আয়কর ওয়ার্কশপের মাধ্যমে শিক্ষকরা আয়কর বিষয়ে সচেতন হচ্ছে।
কেপিআই'র অগ্রযাত্রা
কেপিআই'র প্রতিষ্ঠাতা প্রিয় দে স্বপ্ন দেখতেন- দেশের উন্নয়নে অবদান রাখা যায় এমন কিছু করবেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেমে এমবিএতে অধ্যয়নকালীন সময়ে নিজ এলাকা মিরসরাইতে চালু করেন ইংলিশ কাউন্সিল নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে চট্টগ্রাম শহরে যোগ দিয়েছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। চাকরিতে থেকে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখা সম্ভব নয় এই চিন্তা থেকে সিন্ধান্ত নিলেন এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়বেন যেটি গ্রামের মানুষদের আয়কর সেবা দেবে। আয়কর ভীতি দূর করে তাদের আয়কর প্রদানে উদ্বুদ্ধ করবেন। শিক্ষক শ্রেণিকে টার্গেট করে যাত্রা শুরু করলেন কেপিআইয়ের।
বর্তমানে প্রিয় দে সিএ প্রফেশনাল লেভেলে অধ্যয়নরত, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে আয়কর পেশাজীবী সনদপ্রাপ্ত ও ঢাকা টেক্সেস বারের নিয়মিত সদস্য। চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই থেকে পরিচালনা করেন কেপিআইয়ে মূল কার্যক্রম। এছাড়া চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় দুটি আয়কর সেবা কেন্দ্র রয়েছে।
প্রিয় দে বলেন, কেপিআইতে বর্তমানে ছয় জন কনসালটেন্ট কাজ করেন। যারা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষকদের আয়কর বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করেন। নিয়মিত ফলোআপ করেন।