পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে পড়ে থাকা ৩৪৪৫ কোটি টাকার মালিক কে?
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2022/10/07/whose-money-2.jpg)
পল্লী এলাকার দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের কম সুদে ঋণ দিয়ে তাদের জীবনমানের উন্নয়নে প্রায় এক যুগ আগে 'একটি বাড়ি একটি খামার' প্রকল্পের আওতায় 'কল্যাণ অনুদান' নামে একটি বিশেষ ফান্ড ঘোষণা করেছিল সরকার।
কথা ছিল, এই প্রকল্পের আওতায় গঠিত গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্যরা বছরে ২ হাজার ৪০০ টাকা জমা করলে সরকার থেকে ওই সদস্যকে সমপরিমাণ অর্থ অনুদান দেওয়া হবে।
ঘোষণা অনুযায়ী দরিদ্রদের জন্য অনুদান দিতে সরকার অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রকল্প থেকে তা সদস্যদের কাছে পৌঁছায়নি। সদস্যদের অনুদান দেওয়ার জন্য সরকার থেকে বরাদ্দ পাওয়া সেই টাকা পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে পড়ে আছে, যার পরিমাণ বর্তমানে ৩ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা।
ওই টাকার মালিকানা সমিতির সদস্যদের নাকি ব্যাংকের, তা স্পষ্ট নয় বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ইন্সপেকশন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ২০০৯ সালে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। পরে তা 'আমার বাড়ি আমার খামার' নামে কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রকল্পটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ২০১৭ সালে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করে। যদিও প্রকল্পটি হস্তান্তর হয় ২০২১ সালের জুনে।
ব্যাংকটির কার্যক্রম শুরুর পর ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে প্রথমবারের মতো বিশদ পরিদর্শন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বছরের স্থিতিভিত্তিক পরিদর্শন প্রতিবেদনটি গত ১৪ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'একটি নির্দিষ্ট সময়ে গ্রাহকদের জমার বিপরীতে প্রকল্প থেকে সমপরিমাণ অর্থ দেওয়ার জন্য সরকার অনুদান দিয়েছে। গ্রাহক এক বছরে ২ হাজার ৪০০ টাকা জমা করলে সরকার থেকেও গ্রাহককে সমপরিমাণ টাকা দেওয়া হবে বলে গ্রাহকদের বলা হয়েছিল। গ্রাহকও সঞ্চয় করেছে, সরকারও ফান্ড দিয়েছে। কিন্তু সরকারের দেওয়া ফান্ডের অর্থ ব্যাংকের হিসাব বিবরণীতে দেখানো হচ্ছে।'
'অর্থাৎ গ্রাহক পর্যায়ে চূড়ান্তভাবে অনুদান দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে গ্রাহকদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে'—বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
উধাও ২৭৪ কোটি টাকা কোথায় গেল জানে না পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন আরও জানতে পেরেছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই হিসাবে জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরে এ হিসাবে জমা অর্থের পরিমাণ ৩ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকায় নেমে আসে। অর্থাৎ এক বছরে এই হিসাব থেকে ২৭৪ কোটি টাকা কমে গেছে। এই টাকা কোথায় গেছে, তা সম্পর্কে কিছুই জানাতে পারেনি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
গ্রাহকদের অনুদান দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে মোট কত টাকা অনুদান পেয়েছিল, তার মধ্যে কতো টাকা ব্যয় হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে প্রকল্প থেকে কত টাকা ব্যাংকে স্থানান্তর করা হয়েছে এবং এক বছরের ব্যবধানে ২৭৪ কোটি টাকা কেন কমে গেল—পরিদর্শনকালে এসব বিষয়ে কোনো তথ্য পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।
সরকারের দেওয়া অনুদানের বিষয়ে প্রকৃত তথ্যসহ দালিলিক প্রমাণাদি চাওয়াসহ এ খাতে অর্থ কমে যাওয়ার বিষয়ে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ প্রকল্পে ব্যাংকাররা এসেছেন পরে
পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার আতাউর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সদস্যদের জন্য অনুদান হিসেবে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ মূলত প্রকল্পের আওতায় সদস্যদের সমিতিগুলোর জন্য বরাদ্দ ছিল।
'প্রকল্পটি ১০ বছর চলেছে। সরকার থেকে পাওয়া অনুদানের অর্থ হয়তো সমিতিগুলোকে দেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো অসংগতি ছিল। তাই ২০২১ সালে প্রকল্পের অবসান ঘটিয়ে ব্যাংকটি পুরোদমে চালুর সময় এ খাতে বরাদ্দ পাওয়া টাকাগুলো ব্যাংকে এসেছে,' জানান তিনি।
খন্দকার আতাউর রহমান আরও বলেন, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প থেকে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের জন্ম হয়েছে। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার সময় এর সঙ্গে কোনো ব্যাংকারের সম্পৃক্ততা ছিল না।
ফলে ব্যাংক পরিচালনায় অনেক ক্ষেত্রেই নানা রকম অসংগতি রয়েছে, যা এখন পর্যায়ক্রমে দূর করার চেষ্টা চলছে। 'আমাদের নেওয়া পরিকল্পনাগুলো ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে আগামী দু-তিন বছরের মধ্যেই অসংগতিগুলো দূর হবে এবং ব্যাংকটি সফলভাবে পরিচালিত হবে,' বলেন তিনি।
ঋণ বিতরণ করতে পারছে না
পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ফান্ড ব্যবস্থাপনা পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখেছে, ফান্ডের ঘাটতির জন্য শাখাগুলো ঋণ বিতরণ করতে পারছে না। অথচ ব্যাংকটি ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত হিসেবে জমা রেখেছে।
'ব্যাংকের যথেষ্ট ফান্ড থাকা সত্ত্বেও দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ঋণ বিতরণ না করে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ জমা রাখা ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যের পরিপন্থি' বলে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কম সুদ পাওয়া যায় এমন হিসাবে রাখা হয়েছে আমানত
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, বিভিন্ন ব্যাংকে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের বিনিয়োগ করা অর্থের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি আমানত হিসেবে রাখা অর্থের পরিমাণ ১ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা এবং মেয়াদি আমানত রয়েছে ১ হাজার ৬০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ কম সুদ পাওয়া যায় এমন হিসাবে অর্থ বেশি জমা রেখেছে, যা গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংকটির মেয়াদি আমানতেও অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত বছরের ৩০ জুনের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক এফডিআর করেছে ৩০৪ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২৫৯ কোটি টাকা।
প্রতি বছর কমার্স ব্যাংকে এফডিআর বাড়াচ্ছে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক। অথচ কমার্স ব্যাংকে রাখা এফডিআর মেয়াদান্তে নগদায়নের জন্য পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক অনুরোধ করলেও তা পরিশোধ করেনি কমার্স ব্যাংক। তা সত্ত্বেও ব্যাংকটিতে বারবার নতুন করে মেয়াদি আমানত করা হচ্ছে।
কমার্স ব্যাংকে রাখা আমানত আদায় 'অনিশ্চিত'
কমার্স ব্যাংকে রাখা বিপুল পরিমাণ এই অর্থ আদায়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে।
পরিদর্শনকালে সদস্যদের নামে ভুয়া ঋণ সৃষ্টি এবং ঋণের কিস্তি আদায় করে ব্যাংকে জমা না দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করার প্রমাণ পেয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টাঙ্গাইলের মির্জাপুর শাখার মাঠ সহকারী জোবায়ের হোসেন ও মো. সজিব মিয়া সমিতির বিভিন্ন সদস্যের নামে ভুয়া ঋণ সৃষ্টি, সদস্যদের সঞ্চয়ের অর্থ ও ঋণের কিস্তির টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, 'বিভিন্ন গুরুতর অনিয়মের মাধ্যমে শাখার মাঠ সহকারী মো. সজিব মিয়া, জোবায়ের হোসেন, বিল্লাল হোসেন এবং শাখা ব্যবস্থাপক ও অফিসার মো. কামরুজ্জামান মোট ১.৮৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া সমিতির ম্যানেজার/সভাপতির হাতে থাকা অর্থের পরিমাণ ১৮.৯৬ লাখ টাকা।
'এমনকি শাখার ক্যাশ সহকারী মো. লাভলু মিয়া, মাঠ সহকারী মিঠুন চন্দ্র, জোবায়ের হোসেন ও মো. সজিব মিয়া দু-বছর যাবত অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত হয়ে ব্যাংকের অর্থ তছরুপ করেছেন।'
পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, সদস্যদের কাছ থেকে সঞ্চয় বা কিস্তির টাকা তুলে সেটি যে ব্যাংকে জমা দিতে হবে, তা মাঠ পর্যায়ের অনেক কর্মীরই ধারণা ছিল না। এখন এগুলোকে আস্তে আস্তে ব্যাংকিং রীতিনীতির আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকটির নিট মুনাফা ৩৫৭ কোটি টাকা, আগের অর্থবছরে এটি ছিল ২৩৫ কোটি টাকা।
নিয়মানুযায়ী, নিট মুনাফা থেকে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেওয়ার কথা থাকলেও এই দুই অর্থবছর কোনো লভ্যাংশ দেওয়া হয়নি।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি ৫ শতাংশ এবং পরের অর্থবছরে ৭.৫০ শতাংশ লভ্যাংশ বিতরণ করা হয়েছে বলে ব্যাংক কর্মকর্তারা পরিদর্শন দলকে জানালেও কোনো দালিলিক প্রমাণাদি সরবরাহ করতে পারেননি।
আইন অনুযায়ী, ব্যাংকটির ৫১ শতাংশ মালিকানা সরকারের এবং ৪৯ শতাংশের মালিকানা সমিতির সদস্যদের থাকার কথা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে সরকারের মালিকানা ৭২.৩৬ শতাংশ এবং সমিতি ২৭.৬৪ শতাংশ শেয়ার ধারণ করছে বলে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।