বিশ্বব্যাংকের সংস্থার কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ গ্যারান্টির আশা করছে ঢাকা
বিশ্বব্যাংক গ্রুপের একটি সংস্থা- মাল্টিলেটারাল ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি এজেন্সি (বা মিগা) বাংলাদেশকে ডলার সংগ্রহে সহযোগিতা দিতে চায়। একটি নথিসূত্রে জানা গেছে, এ সুবিধা দিতে ৫০ কোটি থেকে ১০০ কোটি ডলারের স্বল্প-মেয়াদি বাণিজ্য অর্থায়নে গ্যারান্টি প্রদানের সম্ভাবনা যাচাই করছে সংস্থাটি।
জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানিতে নগদ ডলার সংগ্রহে সহায়তা দেবে এসব গ্যারান্টি। নথিতে বলা হয়েছে, 'বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঋণদাতারা' এ ধরনের অর্থায়নের সুবিধা দিতে তাদের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আগামী ১০ অক্টোবর মিগার ভাইস প্রেসিডেন্ট জুনায়েদ কামাল আহমেদের সাথে বৈঠকের জন্য নথিটি প্রস্তুত করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের এই সংস্থাটি বিনিয়োগকারী ও ঋণদাতাদের গ্যারান্টি দেওয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে। এপর্যন্ত তারা বাংলাদেশের ১২টি প্রকল্পে সমর্থন দিয়েছে। এরমধ্যে বিদ্যুৎ ও প্রস্তুতকারক খাতের সাতটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত, এসব প্রকল্পের জন্য তাদের মোট গ্যারান্টির পরিমাণ ১০৩ কোটি ডলার।
দেশে চলমান ডলার সংকটের মধ্যে যখন জ্বালানি তেল আমদানির বিল পরিশোধেও বিলম্ব হচ্ছে, তখন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানিতে মিগার এই গ্যারান্টির প্রস্তাবকে একটি বড় স্বস্তির উৎস হিসেবে দেখছেন স্বাধীন অর্থনীতিবিদ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা।
ইআরডির একজন কর্মকর্ত্রা বলেন, মিগা গ্যারান্টর হলে, কম সুদে ঋণ পাওয়া যাবে। ঋণের ঝুঁকিও কমে যাবে। পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানও আস্থা পাবে। এতে আমদানি প্রক্রিয়া দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করা যাবে, আমদানিতে উন্নতি হবে।
'অন্যদিকে ১০০ কোটি ডলারের মতো বড় ঋণের গ্যারান্টর হওয়ার যোগ্য প্রতিষ্ঠান খুব বেশি পাওয়া যাবে না। সুতরাং, এটা আমাদের জন্য বড় একটা সুযোগ'- দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন তিনি।
আগামী ৯ থেকে ১৫ অক্টোবর মরক্কোর মারাকেশ শহরে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের যৌথ বার্ষিক সভা। সভা চলাকালে– আগামী ১০ অক্টোবর মিগার ভাইস প্রেসিডেন্ট জুনায়েদ আহমেদ কামালের সাথে সরকারের প্রতিনিধিদের বৈঠকে এবিষয়ে অগ্রগতি হতে পারে।
বৈঠকে যোগ দেবেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার, ইআরডি সচিব শরিফা খানসহ অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, দেশের আমদানিতে ইতিবাচক প্রভাব রাখবে মিগার গ্যারান্টি।
টিবিএসকে তিনি বলেন, 'মিগা গ্যারান্টর জানলে, বিদেশি ব্যাংকগুলো আমদানি অর্থায়নে গড়িমসি করবে না। এটা একটা ক্যাটালিস্ট বা প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। যারা এই গ্যারন্টির আওতায় কাভারেজ পাবে, তারা ১০০ কোটি ডলারের বেশিও (পণ্য) আমদানির সুযোগ পাবে।'
উদারহরণ দিয়ে বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, তেল আমদানিতে বিপিসি যদি কোনো ব্যাংকে এলসি (ঋণপত্র) খোলে, ব্যাংক তখন ঋণদানকারী বিদেশি ব্যাংকের যোগাযোগ করবে। মিগা গ্যারান্টর হলে, ব্যাংকও এলসি খুলতে দ্বিধায় পড়বে না এবং বিদেশী ব্যাংকও ঋণ দিতে আস্থা পাবে। বিপিসি যদি ঋণ পরিশোধ করতে না পারে, সেক্ষেত্রে মিগা ওই ঋণ পরিশোধ করবে, যা তখন সরকারের ঋণ হয়ে যাবে।
অব্যাহত ডলার সংকটের মধ্যে এই ধরনের গ্যারান্টি কিছুটা স্বস্তির কারণ হবে বলেও মনে করেন জাহিদ হোসেন।
তিনি আরও বলেন, 'বর্তমানে আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা এবং আমদানি যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে, সেভাবে অর্থনীতি সচল রাখা সম্ভব নয়।' বাংলাদেশের মতো ৪৫ হাজার কোটি ডলারের অর্থনীতিতে মাসে সাড়ে চারশ' কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে অর্থনীতির চাকা সচল করা সম্ভব হবে না। 'ফলে আস্থা অর্জন করতে এই ধরণের গ্যারান্টি আমাদের প্রয়োজন। এর জন্য যা করা প্রয়োজন, তা আমাদের করা উচিত।'
ইআরডির কর্মকর্তাদের মতে, ছয় মাস আগে ঢাকা সফরকালে মিগার ভাইস প্রেসিডেন্ট নিত্যপণ্য আমদানিতে ৬ শতাংশ সুদে ১০০ কোটি ডলার ঋণ গ্যারান্টির প্রস্তাব দেন। তবে সুদহার উচ্চ হওয়ায়, সরকার তখন এ প্রস্তাবে আগ্রহী দেখায়নি।
তবে বর্তমানে বেসরকারি খাতের বাজার-ভিত্তিক বিদেশি ঋণের সুদহার খুবই উচ্চ পর্যায়ে বা প্রায় ১০ শতাংশ হয়ে গেছে। সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (সোফর) এর ৫ শতাংশের সাথে আরও ৪ থেকে ৫ শতাংশ স্প্রেডে অতিরিক্ত সুদ দিতে হচ্ছে, বলে জানান তারা।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এপর্যন্ত গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে সহায়তার দেওয়ার ক্ষেত্রেই মিগার প্রকল্প পোর্টফোলিও কেন্দ্রীভূত ছিল। এখন বিদ্যুৎ খাতে নবায়নযোগ্য উৎসের প্রকল্পে আরও বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসাকে সমর্থন দেবে মিগা। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতাও বাড়ছে। তাই বিদ্যুৎ সঞ্চালনের গ্রিড সম্প্রসারণে ও শক্তিশালী করতে সহায়তা দেবে সংস্থাটি। তাছাড়া, দেশের বর্ধিত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আগামীতে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসবে।
এছাড়া নবায়নযোগ্য শক্তির প্রকল্প, বিদ্যুৎ সঞ্চালনের গ্রিড সম্প্রসারণে ও শক্তিশালী করতে, রপ্তানিমুখী শিল্প, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহ, বন্দর ও স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোয় আরও বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে মিগার সমর্থন চান তারা।
অর্থ বিভাগের সূত্রমতে, সরকারের অগ্রাধিকার অনুযায়ী, মিগা অর্থনৈতিকভাবে টেকসই জাতীয় অগ্রাধিকারের প্রকল্পগুলো শনাক্ত ও তাতে সমর্থন দেবে। বিশেষত, বিভিন্ন শিল্প খাতের যেসব প্রকল্প বাংলাদেশের জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রার কৌশল অনুযায়ী প্রণীত হবে।
মিগার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা বেসরকারি খাত ও পুঁজিবাজারের উন্নয়ন এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) প্রকল্পে মিগার গ্যারান্টি পাওয়ার ওপর গুরুত্ব দেবেন।
বাংলাদেশের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়, ২০৪০ সাল নাগাদ দেশের অবকাঠামো খাতে ৬০ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের সুবিশাল বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে প্রাক্কলন রয়েছে। এরমধ্যে ৭৫ শতাংশ বিনিয়োগ বেসরকারি খাত থেকে ধরা হয়েছে। ইআরডির কর্মকর্তারা মনে করেন, উন্নয়ন চাহিদার এই ঘাটতি পূরণে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের গ্যারান্টি প্রদানের মাধ্যমে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে মিগা। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবে।