বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা এয়ার শিপমেন্টের জন্য দিল্লি বিমানবন্দরের ব্যবহার বাড়িয়েছেন কেন
গত চার মাস ধরে বাংলাদেশি রপ্তানিকারক ও তাদের ক্রেতারা পরিবহন খরচ (এয়ারফ্রেইট) কমাতে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যবহার বাড়িয়েছে।
শিল্পসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি কার্গোর পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে হিমশিম খাচ্ছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সেইসঙ্গে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের ফলে উদ্ভূত চলমান লোহিত সাগর সংকটের কারণে সমুদ্রপথে লিড টাইম (ক্রয়াদেশপ্রাপ্তি থেকে শুরু করে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত সময়) বেড়ে গেছে। এতে কিছু ফ্যাশন ব্র্যান্ড তাদের পণ্য সময়মতো ডেলিভারি দিতে এয়ারফ্রেইটের আশ্রয় নিয়েছে।
এছাড়া প্রতিবেশী দেশটি থেকে এয়ারলাইনগুলো বিভিন্ন গন্তব্যে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করায় খরচ বাঁচানোর সুবিধা পাওয়া যায়। এতে শিপিংয়ের সার্বিক ব্যয় কমে।
৩ মে ভারতীয় ব্যবসায়িক ম্যাগাজিন 'কনস্ট্রাকশন ওয়ার্ল্ড'-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, লজিস্টিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ডেডিকেটেড এয়ার কার্গো স্পেস নিয়েছে বাংলাদেশ।
এই ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা দিল্লির বিস্তৃত আকাশ সংযোগ নেটওয়ার্কে সরাসরি প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে। এতে পণ্য দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে শিপমেন্ট করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) পরিচালক ও টিএডি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'চলতি মৌসুমে প্রথমে অল্পসংখ্যক অর্ডার বুকিং হয়েছিল। গত বছরের বিক্রির পারফরম্যান্স দেখে ক্রেতারা সতর্কভাবে অর্ডার দিয়েছিল। তবে ভোক্তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়ে পোশাক ক্রেতারা কম লিড টাইম দিয়ে অর্ডার বাড়াতে শুরু করেছে। তাই লিড টাইম ধরার জন্য বাড়তি খরচ করে এসব পণ্য এয়ারফ্রেইটের মাধ্যমে রপ্তানি করতে হয়েছে।'
কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের বিলম্বের কারণেও পোশাক প্রস্তুতকারকরা বিমানযোগে পণ্যের চালান পাঠাচ্ছে। তা সত্ত্বেও ঢাকায় ইইউ রুটের জন্য এয়ারফ্রেইটের হার কেজিতে ২.৪ ডলার থেকে বেড়ে ৫–৫.৫ ডলার হয়েছে বলে জানান তুহিন।
স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলামও অনেকটা তুহিনের সুরেই বলেন, দিল্লি বিমানবন্দর বর্তমানে এয়ার কার্গো ও যাত্রী, উভয় ধরনের ফ্লাইটের জন্য ঢাকা বিমানবন্দরের চেয়ে বেশি সাশ্রয়ী।
তিনি বলেন, 'ঢাকা থেকে নিউ জার্সি পর্যন্ত এয়ারফ্রেইটের খরচ দাঁড়ায় কেজিতে ৬ ডলার, যেখানে দিল্লি বিমানবন্দর থেকে মাত্র ৪ ডলার। একইভাবে ঢাকা থেকে নিউইয়র্ক পর্যন্ত এয়ারফ্রেইটের খরচ কেজিতে ৮ ডলার, যেখানে দিল্লি বিমানবন্দর থেকে এটি মাত্র ৫ ডলার। এছাড়া ঢাকা থেকে মাদ্রিদ বা লন্ডনে এয়ারফ্রেইট খরচ কেজিতে ৫.৫ ডলার, যা দিল্লি বিমানবন্দর থেকে মাত্র ৪ ডলার।'
শোভন জানান, বেশি সাশ্রয়ী রুট হওয়ায় তার আমেরিকান ক্রেতা ম্যাঙ্গো সম্প্রতি তাদের কিছু ফ্যাশন পণ্য পরিবহনের জন্য দিল্লি বিমানবন্দরকে বেছে নিয়েছে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন রুটে অসংখ্য সরাসরি ফ্লাইট ও চার্টার্ড কার্গো পরিষেবা থাকায় দিল্লি বিমানবন্দর সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক খরচে সেবা দিতে পারে।
ঢাকা বিমানবন্দরে বেড়েছে এয়ার কার্গো
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফএ) তথ্য অনুসারে, ঢাকা বিমানবন্দরের দৈনিক কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা গড়ে ৬০০ টনে উন্নীত হয়েছে, চার মাস আগে যা ১৫০ থেকে ২৫০ টন ছিল।
বিএফএফএ আরও জানিয়েছে, দেশে দৈনিক এয়ার কার্গোর চাহিদা ১,০০০–১,২০০ টন, কিন্তু বর্তমান সক্ষমতা এই চাহিদার অর্ধেকেরও কম।
বিএফএফএর সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, পোশাক প্রস্তুতকারকরা ডিসেম্বরের শেষদিক থেকে সময়মতো পণ্য ডেলিভারি নিশ্চিত করার জন্য ব্যাপক চাপে পড়েছে। এতে ঢাকা বিমানবন্দরে রপ্তানি-কার্গো লোড উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
এছাড়া কিছু এয়ারফ্রেইট পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কার্গো পরিবহন কার্যক্রম কমিয়ে দেওয়ায় ঢাকা বিমানবন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা চাপে পড়ে গেছে। কবির বলেন, 'ডেডিকেটেড কার্গো ফ্লাইটের অভাবে আমরা প্রায়ই প্যাসেঞ্জার ফ্লাইটের ওপর নির্ভর করি।
'এই পরিস্থিতিতে অনেক রপ্তানিকারক শিপমেন্টের জন্য ভারতীয় বিমানবন্দর ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে।'
তিনি জানান, ভারতীয় বিমানবন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশি পণ্য পরিবহনের পরিমাণ মাসিক ১৫০–২৫০ টন থেকে বেড়ে ৩৫০–৫০০ টনে উন্নীত হয়েছে।
ঢাকা বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে এর কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা অনেকটা বাড়বে। একটি জাপানি কোম্পানি নতুন টার্মিনালের গ্রাউন্ড ও কার্গো অপারেশন পরিচালনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে দক্ষতা আরও বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন বিএফএফএ সভাপতি। চলতি বছরের শেষ নাগাদ নতুন টার্মিনালের অবশিষ্ট কাজ শেষ হতে পারে বলে জানান তিনি।
দিল্লির কাছে ব্যবসা হারিয়েছে ঢাকা
ইন্ডিয়া সি ট্রেড নিউজ-এর তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দিল্লি বিমানবন্দর ২ লাখ ৬০ হাজার টন রপ্তানি কার্গো পরিচালনা করেছে, যেখানে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র ৫,০০০ টন, যা মোট কার্গোর ২ শতাংশেরও কম।
তবে ২০২৪ সালের মার্চ প্রান্তিকে দিল্লি বিমানবন্দরের হ্যান্ডল করা মোট ৯০,০০০ টন কার্গোর মধ্যে বাংলাদেশের হিস্যা বেড়ে ৮,০০০ টনে দাঁড়িয়েছে, যা মোট কার্গোর ৯ শতাংশ।
বেঙ্গালুরুর ফেডারেশন অভ ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশনের (এফআইইও) সহসভাপতি ইসরার আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের কার্গো এভাবে বাড়ায় কার্গোজট দেখা দিয়েছে। আর এয়ারফ্রেইট বেড়েছে প্রায় ৩০০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক নাসির আহমেদ খান টিবিএসকে বলেন, 'দিল্লি বিমানবন্দরে স্থানান্তরিত হওয়া প্রতি কেজি পণ্যে ১৬ সেন্ট লোকসান দিচ্ছে ঢাকা বিমানবন্দর। পরিমাণ হিসাব করা হলে মোট রাজস্ব ক্ষতি আরও বেশি হবে।'
এমনিতেই ঢাকা বিমানবন্দরে এয়ারলাইন্সগুলো আসতে চায় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'যখন এটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে যে দিল্লি হয়ে রপ্তানি করা যায়, তখন এয়ারলাইন্সগলো ঢাকা বিমানবন্দরে আসবে না। তখন কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের দিক থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে অনেক বাজে অবস্থা সৃষ্টি হবে।'
নাসির আরও বলেন, 'যখনই দিল্লি হয়ে কার্গো যাবে, তখন এর সুবিধা পাবে ভারতীয় ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাররা। ফলে আমরা যারা স্থানীয় আছি, তারা ব্যবসা হারাবে এবং অনেক লোক বেকার হবে।
'যেসব সমস্যার কারণে ভারত হয়ে কার্গো যাচ্ছে, সেগুলো যদি আমরা সমাধান না করি তাহলে এ সমস্যার উত্তরণ হবে না।'
উচ্চমূল্যের বাইরেও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাররা অভিযোগ করেছেন, ঢাকা বিমানবন্দরের চারটি কার্গো স্ক্যানারের মধ্যে মাত্র দুটি কার্যকর থাকে। এছাড়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কার্গো হ্যান্ডলিং আরও বেশি মসৃণ করা এবং সেজন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে আসার ওপর জোর দিয়েছেন তারা। এসব বিষয়ের যদি সমাধান করা যায়, তাহলে দিল্লি হয়ে কার্গো পাঠানোর প্রয়োজন হবে না বলে মনে করেন তারা।
ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা পর্যাপ্ত জায়গা পাচ্ছে না
দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পাঠানোর কারণে পর্যাপ্ত জায়গা পাচ্ছে না ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা।
ভারতের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তির আওতায় ঢাকা থেকে সিল করা রপ্তানি কার্গো সীমান্তে ন্যূনতম তল্লাশি করে সরাসরি দিল্লি বিমানবন্দরে পৌঁছানো যায়।
ভারতীয় উৎপাদনকারীরা সি ট্রেড নিউজকে বলেন, তাদের রপ্তানি চালানের জন্য বিমানে জায়গা পাওয়া এখন খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। এর ফলে বিমানে জায়গা পাওয়ার জন্য তারা প্রিমিয়াম দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিলের (এইপিসি) চেয়ারম্যান সুধীর সেখরি বলেন, ভারতীয় রপ্তানিকারকরা আগে থেকেই লোহিত সাগর সংকটের কারণে বেশি ফ্রেইট চার্জ গুনছেন। এর পাশাপাশি তারা সমুদ্রপথের বদলে আরও ব্যয়বহুল আকাশপথে পণ্য পরিবহন করতেও বাধ্য হচ্ছেন।
দিল্লি এয়ার কার্গো টার্মিনালের মাধ্যমে বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্য পরিবহন ভারতীয় পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ ও পরিবহন খরচ আরও বাড়িয়ে দেবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকা থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩০টি পণ্যবোঝাই ট্রাক দিল্লি যায়। এর ফলে কার্গো প্রবাহ ধীর হয়ে যায় এবং এয়ারলাইন্সগুলো এ পরিস্থিতির অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন সেখরি।
এয়ারফ্রেইটের চার্জ বেড়ে যাওয়ায় প্রতিযোগিতাসক্ষমতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি ভারতীয় রপ্তানিকারকরা কার্গো হ্যান্ডলিং ও প্রক্রিয়াকরণে বিলম্ব এবং ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালে তীব্র কার্গোজটের কারণে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েছেন বলে জানান তিনি।