১% আমদানি শুল্কে অর্থনৈতিক অঞ্চলে হুমকির মুখে বিদেশি বিনিয়োগ
অর্থনৈতিক অঞ্চলে সব ধরনের শিল্পের জন্য সরকার কর্তৃক প্রস্তাবিত ক্যাপিটাল মেশিনারি বা মূলধনী যন্ত্রপাতির ওপর ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী নেতারা।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য ইতোমধ্যেই সরকারের কাছে আবেদনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)ও একই ধরনের আবেদনের পরিকল্পনা করছে।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের জেনারেল ম্যানেজার (হিসাব) সুমন ভৌমিক বলেন, "অর্থনৈতিক অঞ্চলে যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, সেটি দেখিয়ে আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করি। অনেক বিনিয়োগকারী এ সুবিধা দেখে এসেছে; আরও আসতে চাচ্ছে।"
"আমরা সুবিধার বিষয় বলে বিনিয়োগকারীকে এনেছি। এখন যদি তাদের বলি, যে সুবিধার কথা বলে তাদেরকে এনেছিলাম, এখন সেটি প্রত্যাহার করা হয়েছে— তাহলে আর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কেউ আসবে না," বলেন তিনি।
সুমন ভৌমিক আরও বলেন, "অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাইরেও ক্যাপিটাল মেশিনারির ওপর ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক, আবার যদি অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভেতরেও ১ শতাংশ দেওয়া লাগে— তাহলে কোনো ভেরিয়েশন রইলোনা। অর্থনৈতিক অঞ্চলের সুবিধা দেখে অনেক দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী আসতো। একটা পরিকল্পিত শিল্পায়ন হচ্ছিল, সেটি এখন বাধাগ্রস্ত হবে।"
"এখন থেকে এগুলো পরিবর্তন না হলে নতুন করে বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসবে বলে মনে হয় না," যোগ করেন তিনি।
বর্তমানে তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিচালনা করছে মেঘনা গ্রুপ— যেখানে দেশি-বিদেশি উভয় ধরনের উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়া, নতুন আরও একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন পেয়েছে এই শিল্প গ্রুপ।
বেজা সূত্রে জানা গেছে, অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রস্তাবিত এফডিআই আছে দেড় বিলিয়নের মতো। বর্তমানে অঞ্চলের মধ্যে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শিল্পের ক্যাপিটাল মেশিনারি বা মূলধনী যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ সামগ্রীর ওপর কর ছাড় দেওয়া হয়।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন টিবিএসকে বলেন, "ক্যাপিটাল মেশিনারির ওপর কোনো চার্জ ছিল না, কিন্তু নতুন বাজেটে প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক দিতে হবে। এটি যেন মওকুফ করা হয়, সেই বিষয়ে সুপারিশ করবো। আশা করি, সরকার এটা বিবেচনায় নেবে।"
শুক্রবার রাজধানীতে প্রস্তাবিত বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ক্যাপিটাল মেশিনারিতে ট্যাক্স বসানোর বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনীম বলেন, "কিছু কিছু ক্যাপিটাল মেশিনারিতে যেখানে শূন্য শতাংশ ছিল, সেখানে আমরা ১ শতাংশ করেছি। আমরা কোনো জায়গায় শূন্য দেখতে চাই না। অন্তত ১ শতাংশ থাকবে। আমরা কর আহরণ বাড়াতে চাই।"
এনবিআরের যুক্তি সত্ত্বেও, ব্যবসায়ী নেতারা সম্ভাব্য নেতিবাচক পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
এফবিসিসিআইয়ের মহাসচিব মো. আলমগীর বলেন, "১ শতাংশ বড় বিষয় না। এটা না করলেও পারতো। এখন অর্থনৈতি অঞ্চলের বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাবে। কারণ তারা দেখছে বাজেটে কোনো সুবিধাতো রাখেই নি, বরং কমিয়েছে।"
এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, "আমরা এটা প্রত্যাহারের আবেদন করবো সরকারের কাছে। আমরা সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত অন্য বিষয়ের সঙ্গে এ বিষয় তুলে ধরবো।"
তিনি বলেন, "অনেক প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবকাঠামো তৈরি করেছে, মেশিন আনার জন্য এখন তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। পরিকল্পিত শিল্পায়নের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চলে আরও সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন।"
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, "এ ধরনের ট্যাক্সের যখন পরিবর্তন হয়, তখন এগুলো খুবই 'অ্যাডহক টাইপের' হয়। ট্যাক্স সুবিধা জেনে যে বিনিয়োগকারীরা এখানে এসেছেন। তারা এখন দেখতে পাচ্ছেন, তাদের খরচ আরও বেড়ে গেছে। হঠাৎ করে এমন পরিবর্তন আসলে, তাদের বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে তারা বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হবেন।"
"বিনিয়োগকারীরা পলিসির স্ট্যাবিলিটি দেখতে চায়। আশা করি, সরকার এ বিষয় বিবেচানায় নিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলে যে সুবিধা বিনিয়োগকারীরা পেয়ে আসছে, সেটি বজায় রাখবে।"
সেলিম রায়হান আরও বলেন, "ক্যাপিটাল মেশিনারি– এটা বিনিয়োগের বড় ধরনের উপাদান। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে গেলে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি করতেই হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে প্রণোদনা থাকা প্রয়োজন।"
অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা
বেজা সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত অনুমোদিত অর্থনৈতিক অঞ্চল মোট ৯৭টি; এরমধ্যে সরকারি অঞ্চল রয়েছে ৬৮টি এবং বেসরকারি ২৯টি। এগুলোর ১১টি উৎপাদনে রয়েছে– যারমধ্যে সরকারি ৩টি ও বেসরকারি ৮টি ।
আর নতুন করে বাস্তবায়নাধীন অর্থনৈতিক অঞ্চল ২৯টির মধ্যে সরকারি ১৫টি ও বেসরকারি ১৪টি।
এই অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে উৎপাদনরত শিল্প প্রতিষ্ঠান মোট ৫০টি। এরমধ্যে সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১৩টি এবং বেসরকারিতে ৩৭টি অঞ্চল রয়েছে। এছাড়া, নির্মাণাধীন ৫৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৬টি সরকারি অঞ্চলে ও ১৭টি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে রয়েছে।
অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে প্রায় ৬০,০০০ লোক কর্মরত রয়েছেন। এরমধ্যে বেসরকারি খাতে ৫৩,০০০ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
বেজার দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হল ২০৪১ সালের মধ্যে সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা। এর মাধ্যমে এক মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বার্ষিক ৪০ বিলিয়ন মূল্যের পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বেজা।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে সরকারের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নের জন্য ডেভেলপারদের দ্বারা আমদানিকৃত ব্যবহৃত নির্মাণ সামগ্রীর উপর নতুন ১ শতাংশ শুল্ক ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, "যদিও অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নে ব্যবহৃত জিনিসপত্রের ওপর পূর্বে শূন্য শতাংশ আমদানি শুল্ক দেওয়া হয়েছিল, আমি এটিকে ১ শতাংশে পরিবর্তনের প্রস্তাব করছি।"
মন্ত্রী অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে ব্যবসায়ীদের দ্বারা ব্যবহৃত যানবাহনের আমদানি শুল্ক পরিবর্তনেরও প্রস্তাব করেন।
তিনি বলেন, "আগে, অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থাপনাগুলোর দ্বারা ব্যবহৃত যানবাহনের জন্য আমদানি শুল্ক ছিল শূন্য শতাংশ। আমি এ আমদানি শুল্ক অব্যাহতি বজায় রাখার প্রস্তাব করছি, তবে অন্যান্য সমস্ত প্রযোজ্য কর ও শুল্ক যোগ করার প্রস্তাব দিচ্ছি।"
মন্ত্রী জানান, দ্রুততম সময়ে গোপালগঞ্জ, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, চাঁদপুর ও পাবনায় প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি জানান, ইতোমধ্যে দেশের ২৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০০টির বেশি কোম্পানিকে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব কোম্পানির প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ২৫০ কোটি মার্কিন ডলার।
এরমধ্যে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ হয়েছে ৫৫০ কোটি ডলার।
বর্তমানে এসব অঞ্চলে ৪৩টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে। আরও ৭০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণাধীন রয়েছে।