রপ্তানিতে প্রণোদনা আরও কমল, খরচ বাড়ার আশঙ্কা পোশাক খাতের
২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণের (এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন) কথা রয়েছে বাংলাদেশের। এজন্য বেসরকারি খাতকে প্রস্তুত করতে সরকারের পরিকল্পনার আওতায়, পাঁচ মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো প্রায় সকল রপ্তানি পণ্যের জন্য প্রণোদনা হ্রাস করা হয়েছে। বাংলাদেশের একক বৃহত্তম রপ্তানি আয়কারী– পোশাক খাত, সরকারের নগদ সহায়তারও বৃহত্তম সুবিধাভোগী। ফলে তারাই সবচেয়ে বেশি সুবিধা হারাবে।
রোববার (৩০ জুন) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রজ্ঞাপনে প্রণোদনা হ্রাসের এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়। সার্কুলার অনুযায়ী, আর্থিক পরিমাণের দিক থেকে সর্বাধিক প্রণোদনা পাওয়া তৈরি পোশাক খাতের (আরএমজি) জন্য বিশেষ প্রণোদনার হার শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ (০.৫) থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ (০.৩) করা হয়েছে।
এলডিসি গ্রাজুয়েশনের আরও সময় বাকি থাকতে থাকতেই –দেশের অর্থনীতির বর্তমান সংকটের সময়ে প্রণোদনা হ্রাসের এই সিদ্ধান্তটি ভালো হয়নি বলে মনে করছেন পোশাকখাতের সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, দুই দফায় প্রণোদনা কর্তনের ফলে আগামীদিনগুলোয় রপ্তানিও কমে যাবে।
নতুন অর্থবছরের প্রথমদিন, অর্থাৎ সোমবার (১ জুলাই) থেকে কার্যকর হচ্ছে এই প্রজ্ঞাপন, যা ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে।
তবে এতে ক্রাস্ট চামড়া রপ্তানিতে প্রণোদনা শূন্য শতাংশ থেকে বাড়িয়ে শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ (০.৬) করা হয়েছে। একমাত্র এই একটি পণ্যেই তা বাড়ানো হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রণোদনা বাবদ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে সরকার। তবে প্রণোদনার হার কমিয়ে দেওয়ার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রণোদনা খরচ কমে আসবে।
প্রজ্ঞাপনে, নতুন বাজারে রপ্তানিতে প্রণোদনা ১ শতাংশীয় পয়েন্ট কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। পাট ও পাটপণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত মাছ, কৃষিপণ্যসহ অন্যান্য খাতের জন্যও হ্রাসকৃত এই হার প্রযোজ্য হবে।
এটি কার্যকর হওয়ার আগে, সর্বোচ্চ প্রণোদনা হার ছিল কৃষিপণ্যে। যেমন আলু, প্রক্রিয়াজাত মাংসের মতো পণ্য রপ্তানিতে ১৫ শতাংশ হারে দেওয়া হতো। ফেব্রুয়ারির আগে এসব পণ্যে নগর প্রণোদনার হার ছিল ২০ শতাংশ।
সাম্প্রতিক প্রজ্ঞাপনটিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, সরকার ৪৩টি রপ্তানি পণ্যে নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে।
অর্থমন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, নগদ প্রণোদনার সিংহভাগ বা ৬৫ শতাংশ পায় তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল (বস্ত্র) শিল্প।
হ্রাসকৃত হার পুনর্বিবেচনার দাবি রপ্তানিকারকদের
নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন– বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এখন প্রণোদনা হ্রাসের সময় না। এতে স্থানীয় স্পিনিং মিলসহ ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ নগদ প্রণোদনার জন্য আবেদন করতে প্রণোদনার তুলনায় বেশি খরচ পড়ে যায় মন্তব্য করে তিনি বলেন, "সরাসরি প্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয়ের ওপর প্রণোদনা দেওয়া হলে আমাদের হয়রানি কিছুটা হলেও কমবে।"
বিকেএমইএ'র এই নেতা জানান, এখন আমাদের আমদানি খরচ আরও বাড়বে, কারণ "প্রণোদনা হ্রাসের কারণে আমরা কাঁচামাল আমদানি করতে বাধ্য হব।"
প্রণোদনা এখন না কমিয়ে ২০২৫ বা ২০২৬ সালেও কমানো যেত বলেও মনে করেন তিনি।
একারণে রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে হাতেম বলেন, "গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে এবং একইসঙ্গে ব্যাংক লোনের সুদের হারও বেড়েছে। ফলে আমাদের খরচ আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে।"
পোশাক শিল্পের শীর্ষ সংগঠন– বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-র সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান টিবিএসকে বলেন, তৈরি পোশাক খাতে প্রণোদনা ব্যাপকবভাবে কমানো হয়েছে।
"এখন আমরা রপ্তানিতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাব। আগের ইনসেনটিভ রেট অনুযায়ী আমরা অনেকগুলো অর্ডার নিয়েছি, ফলে আমাদের ক্ষতি হবে। এই সময়ে এক্সপোর্ট অর্ডারের পরিমাণ বাড়াতে, মার্কেটে টিকে থাকতে, কম্পিটিটিভ থাকার জন্য প্রণোদনা যেন না কমে সেজন্য পদক্ষেপ নেওয়া উচিত" বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিজিএমইএয়ের পরিচালক এবং ক্লাসিক ফ্যাশন কনসেপট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ আজিম টিবিএসকে বলেন, "আমাদের জন্য বিকল্প সুযোগ-সুবিধা না দিয়ে এভাবে ক্রমান্বয়ে প্রণোদনা কর্তন করলে – আমাদের টিকে থাকাটা আরও কষ্টকর হবে। প্রণোদনা হার কমিয়ে আনা হচ্ছে; তবে আমাদের পোশাক শিল্পের জন্য বিভিন্ন ধরনের নীতিগত সুবিধা বাড়াতে হবে। ইন্ডিয়া, চায়না, ভিয়েতনামে এই শিল্প সরকারের থেকে যে ধরনের নীতিগত সুবিধা পেয়ে থাকে – সেগুলো বিবেচনায় এনে আমাদের দেশেও চালু করতে হবে।"
বিজিএমইএ'র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, "অর্থনীতি এখন প্রতিকূল অবস্থায় রয়েছে, এরমধ্যে আমাদের দেশের রপ্তানির সুবিধা কমানো হচ্ছে, যার আমি কোনো যৌক্তিকতা দেখি না।"
ব্যাখ্যা করে তিনি জানান, "আমাদের ২০২৯ সাল পর্যন্ত এই প্রণোদনা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।"
গবেষণা প্রতিষ্ঠান– সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমানের মতে, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের জন্য প্রণোদনা কমিয়ে আনতে হবে, ব্যবসায়ীদের এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে।
তিনি উল্লেখ করেন, "ব্যবসায়ীরা এক সময় রপ্তানি আয়ের ডলারের দাম ৮৬ টাকা পেত, এখন তা ১১৮ টাকা পর্যন্ত পাচ্ছে। আমি মনে করি, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমায় রপ্তানিকারকরা বেশ লাভবান হয়েছে।"
"ব্যবসায়ীরা যে সমস্যায় রয়েছে এটা মানতে হবে। কারণ এক বছর আগেও ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পেত, এখন তা ১৪ শতাংশ। সবমিলিয়ে ব্যবসায়ীদের খরচও বেড়ে গেছে। তবে সরকার প্রণেদানা কমালে– রপ্তানিকারকদের অন্যভাবে সহায়তা করতে হবে।"
"আমাদের রপ্তানিকারকদের অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, রপ্তানি পণ্য পরিবহনে তাদের খরচ বেশি হয়। এছাড়া এসব ব্যবসায়ীদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা পাওয়া আরও সহজ করতে হবে। একইসঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা ও প্রতিযোগিতা কীভাবে বাড়ানো যায়– সেদিকে উদ্যোগ নিতে হবে" – যোগ করেন মুস্তাফিজুর।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান টিবিএসকে বলেন, "জ্বালানি ও বিদুতের দাম বাড়ার কারণে ব্যবসায়ীরা সংকটে রয়েছে। এরইমধ্যে তাঁদের রপ্তানির ওপর প্রণোদনাগুলো তুলে নেয়া হলে তাঁদের সংকটটা আরও বাড়বে।"
চলতি বছরের জানুয়ারিতে, বস্ত্রখাতের পাঁচটি এইচএস কোডের আওতায় রপ্তানি হওয়া পণ্যে কোনো নগদ সহায়তা দেওয়া হবে না বলে জানানো হয়। এইচএস কোডগুলো হলো– ৬১০৫, ৬১০৭, ৬১০৯, ৬১১০ এবং ৬২০৩।
বিজিএমইএ'র তথ্যমতে, নগদ সহায়তা প্রত্যাহার করা এই পাঁচ ধরনের আইটেম ২৫.৯৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় অর্জনে ভূমিকা রেখেছে, যা গত অর্থবছরে হওয়া মোট রপ্তানির ৪৬.৭১ শতাংশ। মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির মধ্যে যা ছিল ৫৫.২২ শতাংশ।