দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের অপেক্ষায় দেশের প্রথম গ্রিন প্রাইভেট ইকোনমিক জোন
- ১০৪১ একর জায়গায় দেশের সর্ববৃহৎ প্রাইভেট ইকোনমিক জোন
- বরাদ্দ হবে ৪০০ প্লট
- ৬০ শতাংশ জায়গায় হবে কারখানা
- কর্মসংস্থান হবে ৫ লাখ লোকের
- শতভাগ সারফেইস ওয়াটার ব্যবহার
- সোলার প্যানেল পার্ক স্থাপন
- স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা
ঢাকার অদূরে যমুনা নদীর তীরে অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা নিয়ে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম শতভাগ গ্রীন ইকোনমিক জোন। সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন নামক এই প্রকল্পটি বর্তমানে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগের অপেক্ষায় রয়েছে।
১০৪১ দশমিক ৪৪ একর জায়গায় নির্মাণাধীন ইকোনমিক জোনে ভূমি উন্নয়নের ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে স্থানীয় ১৪টি প্রতিষ্ঠান ১১০ একর জমি বরাদ্দ নিয়েছে।
বাকি জমির জন্য সৌদি আরব, জাপান, চায়না, আমেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নরওয়েসহ কয়েকটি দেশের বিনিয়োগকারীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার পরিকল্পনা করছে অর্থনৈতিক অঞ্চলটি।
সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন লিমিটেডের পরিচালক শেখ মনোয়ার হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, এই ইকোনমিক জোনে মোট ৪০০টি প্লট হবে। শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে ৫ লাখে লোকের কর্মসংস্থান হবে এখানে।
তিনি বলেন, "স্থানীয় অনেক প্রতিষ্ঠান ভূমি বরাদ্দ নেয়ার চেষ্টা করছে। তবে এটি দেশের প্রথম গ্রীণ ইকোনমিক জোন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অপেক্ষায় রয়েছি।"
সম্পূর্ণ গ্রীণ ইকোনমিক জোন গড়ে তুলতে আন্তর্জাতিক মানদন্ডের পাশাপাশি স্থানীয় ন্যাচারাল রিসোর্সকে শতভাগ ব্যবহার করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। "আমেরিকান ভিত্তিক বিনিয়োগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার্স (পিডব্লিউসি) এবং জাপান ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউট (জেডিআই) একসাথে একটি ডিটেইড প্ল্যান প্রস্তুত করেছে," যোগ করেন মনোয়ার হোসেন।
সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন অথোরিটি বলছে, ইকোনমিক জোনের অবকাঠামো নির্মাণের শুরু থেকে কারখানা স্থাপন, পণ্য পরিবহন, শিল্প সংশ্লিষ্টদের শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ সব স্তরেই গ্রীন এনভারমেন্টের মানদন্ড থাকবে।
পুরো প্রকল্পকে সবুজ রাখতে ভূমির মাত্র ৬০ শতাংশ কারখানার জন্য বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। বাকি জমিতে খেলার মাঠ, লেক, বনায়ন, বিনোদন কেন্দ্র, হাসপাতাল, টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, সিইটিপি, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম, সোলার প্যানেল পার্কসহ নানা সবুজ অবকাঠামো গড়ে তুলার পরিকল্পনা রয়েছে।
তাছাড়া, এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা স্থাপন করা সব প্রতিষ্ঠানগুলোই শতভাগ সারফেস ওয়াটার ব্যবহার করবে। যমুনা নদী থেকে পাইপের পানি তুলে ফ্যাক্টরিতে দেয়া হবে। কারখানায় ব্যবহৃত ওই পানি এবং বর্জ্য সিইটিপির মাধ্যমে জিরো ডিস্টাসে রিইউজ করা হবে। বৃষ্টির পানি ধারণ করে রেখে তা সারাবছর ব্যবহারের জন্য রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম স্থাপন করা হবে। বায়ু ও শব্দ দূষন থেকে রক্ষার জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।
"আমাদের যে মাস্টার প্লান রয়েছে তাতে এ কারখানায় পরিবেশ দূষণের কোনো সুযোগই থাকবে না। গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পানির অপচয় হয় এমন সুযোগ রাখা হবে না। প্রাকৃতিক সম্পদ শতভাগ ব্যবহারের টেকনোলজি থাকবে," বলেন মনোয়ার হোসেন।
কৃষিভিত্তিক এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অগ্রাধিকার
দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি পণ্যকে প্রক্রিয়াজাত শিল্পের অন্তর্ভুক্ত করতে এগ্রোবেইজড ইন্ডাস্ট্রিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্লট বরাদ্দের পরিকল্পনা সাজিয়েছে সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন।
যদিও প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ নেওয়া ১৪টি প্রতিষ্ঠান টেক্সটাইল, আরএমজি, ডাইং ফ্যাক্টরি, টেক্সটাইল অরিয়েন্টেড সুতা উৎপাদন, ব্যাকোয়ার্ড লিংকেজ পণ্য ও ইলেট্রিক পণ্য উৎপাদনের জন্য বরাদ্দ পেয়েছে।
মনোয়ার হোসেন বলেন, "আমাদের দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান এগ্রোবেইজড ইন্ডাস্ট্রির জন্য প্লট নিতে আসছে। তারা ভ্যালু এ্যাডেড পণ্য তৈরী করবে। এমনকি ভারতের একটি কোম্পানি প্লট নিতে আগ্রহী।"
আগ্রহীরা দেশের লোকাল মার্কেট থেকে বীজ সংরক্ষণ করে বাজারজাত করবে বলে জানান তিনি। মনোয়ার হোসেন আরও বলেন, আইটি ও টেলিকম সার্ভিস ওরিয়েন্টেড প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এগ্রো বেইজড ইন্ডাস্ট্রি করতে আগ্রহী টেলেঅস-এর প্রতিষ্ঠাতা অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম।
"আমরা প্রথমত বিদেশি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ চাই। সৌদি, জাপান, চীন, আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশের বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। পূনার্ঙ্গ অবকাঠামো শেষ হলে অনেক বেশি রেসপন্স পাবো। ফলে এই মূহুর্তে বরাদ্দ দেওয়া বন্ধ রয়েছে," যোগ করেন তিনি।
টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
ইকোনমিক জোনে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কারখানায় চাহিদা অনুযায়ী লোকবল যোগান দিতে একটি টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট গড়ে তুলার পরিকল্পনা রয়েছে ইকোনমিক জোনের মাস্টার প্ল্যানে। এতে স্থানীয় এবং উত্তরাঞ্চলের মানুষকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলার পরিকল্পনা রয়েছে। সব ফ্যাক্টরিতে কমপক্ষে ১ শতাংশ কর্মচারী যেনো প্রতিবন্ধীদের থেকে নিয়োগ দেওয়া হয় সে শর্ত দেওয়া হবে।
এছাড়া ফ্যাক্টরির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা, সন্তানদের পড়াশোনার জন্য স্কুল-কলেজ এবং বিশ্বমানের হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে ইকোনমিক জোনের মাস্টার প্ল্যানে।
শেখ মনোয়ার হোসেন বলেন, "একটি বিশ্বমানের হাসপাতাল করার জন্য ১০০ একর জায়গা কমার্সিয়াল ব্লক হিসাবে বরাদ্দ রেখেছি। নরওয়ের একটি কোম্পানি হাসপাতাল করতে চায় আমাদের সঙ্গে। তারা এখন বাংলাদেশে অংশিদার খুঁজছে। ডেভেলপার হিসাবে আমরাও তাদের সঙ্গে অংশীদারিত্বে যেতে পারি।"
এখন পর্যন্ত বরাদ্দ পেলেন যারা
সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ২০১৮ সালে ১৪টি কোম্পানিকে লাইসেন্স দিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ।
চুক্তির অধীনে বরাদ্দ পাওয়া কোম্পানিগুলো: সিরাজগঞ্জ ইজেড অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড (৫ একর), কন্টিনেন্টাল গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ (প্রাইভেট) লিমিটেড (৮ একর), ডায়নামিক ড্রেজিং (২ একর), নীট এশিয়া লিমিটেড (৮একর), এমকে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (৪ একর) রাতুল ফেব্রিক লিমিটেড (৫ একর), অ্যাক্টিভ কম্পোজিট মিলস লিমিটেড (২ একর), রাইজিং হোল্ডিংস লিমিটেড (১০ একর), রাইজিং স্পিনিং মিলস লিমিটেড (৫ একর), যশোর ফিড লিমিটেড (১৬ একর), মেরিনা প্রপার্টিজ (বিডি) লিমিটেড (২১ একর), টেক্সট টাউন লিমিটেড (৫ একর), স্কয়ার এক্সেসরিজ লিমিটেড (১২ একর) এবং স্কয়ার ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড (৭ একর)।
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর টিবিএসকে বলেন, "আমরা ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ পণ্য তৈরী করবো। আমাদের কাঁচামাল সংকট রয়েছে। সেটা জুতার জন্য হোক কিংবা ব্যাগ তৈরীর জন্য হোক। পরিবেশ বান্ধব কারখানা তৈরি করে সাসটেইনবেল বিজনেসের জন্য এখানে প্লট নিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, "এখানের লোকেশন প্রতিষ্ঠান তৈরীর জন্য খুবই উপযোগী। সহজে ওয়ার্কার পাওয়া যাবে। পরিবেশ বান্ধব ও পরিকল্পিত শিল্পায়নের জন্য এই অর্থনৈতিক অঞ্চল একটি আশীর্বাদ। জায়গা থাকায় এখানে স্কুল, কলেজ, ফায়ার সার্ভিসসহ আধুনিক সব সুবিধা থাকবে। শ্রমিকরা বসবাসের জন্য ভালো পরিবেশ পাবে।"
যে কারণে এটি লোভনীয়
ঢাকা রাজশাহী হাইওয়ের মূল সড়কের সঙ্গে স্থাপিত হচ্ছে ইকোনমিক জোনটি। যমুনা নদীর তীর ও বঙ্গবন্ধু সেতুর কছেই এর অবস্থান হওয়ায় সড়ক, রেল, বিমান, নদীপথ সব দিক দিয়েই যাতায়াতের জন্য সহজ এ ইকোনমিক জোন। দেশের ১৬টি জেলা নিয়ে গঠিত উত্তরবঙ্গে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান না থাকায় সহজেই শ্রমিক পাবেন শিল্প উদ্যোক্তারা। পাশাপাশি জীবন যাত্রার ব্যয় ঢাকার চেয়ে কম থাকাটাও একটা বড় সুযোগ বলে মনে করেন মনোয়ার হোসেন।
এর সঙ্গে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সহজ প্রাপ্তি আরও আকর্ষনীয় করে তুলছে এ অর্থনৈতিক জোনকে।
মনোয়ার হোসেন বলেন, "অর্থনৈতিক জোনকে কেন্দ্র করে এখানে নদীবন্দর হচ্ছে। ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডেপোট (আইসিডি) হচ্ছে এখানে। রেল যোগাযোগের বর্তমান লাইনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে যমুনার ওপর রেল সেতু হচ্ছে। চার লেনের রাস্তা হচ্ছে। ঢাকা বিমান বন্দর থেকে ৩-৪ ঘণ্টায় আপনি ইকোনমিক জোনে পৌছাতে পারবেন। এসব সুবিধার কারণেই বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রে এ ইকোনমিক জোন।"
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, "সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্লাটিনাম গ্রিন কনসেপ্টে গড়ে উঠবে। সেখানে গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত না করে আধুনিক শিল্পনগরীর সুযোগ-সুবিধাসহ দক্ষ জনগোষ্ঠীর বাসস্থান ও কর্মসংস্থান গড়ে উঠবে। শহরমুখী শ্রমজীবী মানুষ শহরের মানের শিক্ষালয়, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকবে সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোনে।"
গ্রামীণ জীবনের স্বকীয়তা বজায় রেখে উন্নয়নের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে কর্ম, শিল্প ও মানুষ। বায়ু, পানি দূষণমুক্ত সুস্থ পরিবেশে গড়ে উঠবে একটি দক্ষ ও উৎপাদনক্ষম জনগোষ্ঠী।