ব্যয় কমাচ্ছেন ভোক্তারা, ঝুঁকিতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার
আয়ের তুলনায় নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান চড়া দামের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হয়ে, ভোক্তারা এখন তাদের ব্যয় কমাচ্ছে। ফলে মহামারি সৃষ্ট মন্দা থেকে দেশের ভি- আকৃতির অর্থনৈতিক পুনরূদ্ধার নতুন প্রতিকূলতার মুখে পড়েছে।
বাড়তি মূল্যের এই যন্ত্রণা বিশেষ করে, সীমিত আয়ের লোকেরা এমন মাত্রায় অনুভব করছে- যা আগে কখনো করেনি। প্রায় সমস্ত দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্য তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে তারা বাধ্য হচ্ছে, স্বাভাবিক কেনাকাটা কমাতে এবং সেগুলোর সস্তা বিকল্প সন্ধানে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসে চাল, আটা, ডাল, তেল, মাছ, মাংস, শাকসবজি, সাবান ও দুধের দাম ১২ শতাংশ বেড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ভোক্তা মূল্য সূচক এবং শ্রম শক্তি সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে, ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ভোক্তা মূল্য বার্ষিক ৬.১৭% বেড়েছে। অন্যদিকে, একই সময়ে শ্রমজীবী মানুষের মজুরি হার বেড়েছে মাত্র ৬.০৩%।
অথচ সরকারি তথ্য অনুযায়ী-ই, দেশের জিডিপিতে ৬৯% অবদান রাখে ব্যক্তিগত খরচ।
ভোক্তারা কীভাবে অদরকারি খরচ কমাতে কোমরের বেল্টখানাও শক্ত করে বাঁধছেন–তা জানতে শুনুন মগবাজারের দিলু রোডের একটি খাবারের মালিক আমজাদ হোসেনের ঘটনা। এক মাস আগেও প্রতিদিন সকালে ৩০-৩২ কেজি আটার রুটি-পরোটা বিক্রি করতেন তিনি। গত কয়েক দিন ধরে আটা-ময়দার ব্যবহার ২৪-২৫ কেজিতে নামিয়ে এনেছেন, কারণ বাড়তি দামের ভয়েই তার ছোট্ট রেস্তোরাঁয় কমেছে খদ্দেরের আনাগোনা।
ছোট হয়েছে রুটির আকার, ভোজ্যতেলের বর্তমান ব্রক্ষ্মতালু গরম করা দামের কারণে এখন মাত্র কয়েক ফোঁটা দিয়ে ভাজা হচ্ছে পরোটা।
"ফেব্রুয়ারি থেকে আমাদের বিক্রি কমছে। আমরা এক মাস আগের তুলনায় খাবার তৈরির পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছি," বলেন আমজাদ।
আমজাদ হোসেনের মতোই খাবারের দাম না বাড়িয়ে খদ্দেরদের সন্তুষ্ট রাখতে পরিবেশনের পরিমাণ কমিয়েছে রাজধানীর ছোট-বড় অনেক হোটেল-রেস্তোরাঁ। তবুও, আয় না বাড়ায় গ্রাহকরা প্রধানত রেস্তোরাঁর খাবার থেকে দূরে দূরেই থাকছে, কারণ তাদের জীবনযাত্রার নাভিশ্বাস ওঠানো ব্যয় মেটাতে একপ্রকার যুদ্ধই করতে হচ্ছে।
আয়ের সাথে সামঞ্জস্য রাখতে শুধু হোটেল-রেস্তোরাঁ নয়, মধ্য ও নিম্নবিত্তের সংসারেও শুরু হয়েছে কৃচ্ছতা সাধন। পরিমাণে কম খেয়ে কিংবা তেল-মসলার কম ব্যবহারে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমতা রক্ষার চেষ্টা করছেন সবাই।
তারা এখন একেবারে আবশ্যক না হলে কোনো বাড়তি না খরচ করার ব্যাপারে সতর্ক হয়েছেন। তারই প্রতিফলন দেখা গেছে, দৈনন্দিন কাজের অংশ মোবাইল ও ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর বিক্রি কমে যাওয়ার ঘটনায়। ঢাকার কারওয়ান বাজার থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজার–সবখানেই আসন্ন মাহে রমজানকে কেন্দ্র করে ভোক্তাদের কেনাকাটায় দেখা যাচ্ছে স্তিমিত ভাব।
ব্যবসায়ীদের দাবি, খুচরা বাজারে নিত্যপণ্যের বিক্রিও স্বাভাবিকের চেয়ে কম।
ভোক্তারা বড় বড় প্যাক থেকে বের হয়ে ছোট প্যাকে ঝুঁকছেন শিশুখাদ্য ও কসমেটিক পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে। অন্যদিকে, ঈদ ও পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে চাঙ্গা বিক্রিবাট্টায় ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নও উবে যাচ্ছে ফ্যাশন হাউজগুলোর।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আয় বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির তুলনায় কম হওয়ায়, ভোক্তারা এখন খাদ্যপণ্যের অতিরিক্ত খরচ মেটাতে গিয়ে ততোটা আবশ্যক নয়- এমন পণ্য যেমন পোশাক, আসবাবপত্র, ইলেকট্রনিক্স এবং অন্যান্য বিলাসবহুল আইটেম কিনছেন না।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দিনমজুরদের মজুরি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে না। তাই তারা আগের মতো খাবার কিনতে পারছে না।"
তিনি আরো বলেন, শ্রমিক শ্রেণির মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে।
যখন আয় কমে যায়, তখন নিম্ন আয়ের মানুষের প্রথম ক্ষতি হয় তাদের খাদ্য গ্রহণ। জীবনধারণের এই অতি-দারকারি চাহিদা মেটাতে, অনেকে তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে কাজ করতে পাঠায়, উল্লেখ করেন ড. মনসুর।
বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, অনেকে চিকিৎসায় খরচ বন্ধ করতেও বাধ্য হয়, যার ফলে ভবিষ্যতের উৎপাদনশীলতা নষ্ট হয়।
ভোক্তারা সস্তা বিকল্প খুঁজছেন:
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সীমিত আয়ের ভোক্তাদের সস্তা পণ্যের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করছে। চালের ক্ষেত্রে, তারা আর ভালো মানের খোঁজ করে না। স্বল্প পরিমাণে কিনছেন নন-ব্র্যান্ডের পণ্য।
ঢাকার সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারের একটি চালের দোকানের মালিক সাব্বির আহমেদ টিবিএসকে বলেন, তার অনেক গ্রাহক, যারা আগে ভালো চাল কিনতেন, তারা এখন মোটা চাল বেছে নিচ্ছেন।
মিনিকেট ভ্যারাইটির দাম এখন প্রতি কেজি ৬৬ - ৬৮ টাকা, অন্যদিকে মোটা চাল ৫০ - ৫৫ টাকায় বিক্রি হয়, বলে জানান সাব্বির।
তিনি বলেন, "আমার ভালো মানের চালের বিক্রি কয়েকদিন আগের দৈনিক ৮০-১০০ কেজি থেকে এখন ৫০ কেজিতে নেমে এসেছে।"
একই বাজারের সবজি বিক্রেতা আমিনুল ইসলাম জানালেন, দাম বেশি হওয়ায় তার বিক্রিও কম হচ্ছে। বেগুন, কুমড়ো, করলা ও লেবুর মতো দামি সবজি কেনা থেকেও বিরত থাকছেন মানুষ।
আমিনুল বলেন, ভোক্তারা বেশির ভাগই আলু ও টমেটো কিনছেন, যা এখন সস্তায় বিক্রি হচ্ছে।
মধ্যবিত্ত মানুষ, যারা আগে অনেকে সুপারশপ থেকে কিনতেন, তারাও সস্তার বিকল্প খুঁজছেন।
মীনা বাজারের হেড অব অপারেশন শামীম আহমেদ জায়গিরদার বলেন, গত কয়েকদিন ধরে স্কয়ার, ইউনিলিভারের মতো ব্র্যান্ডের প্রসাধনী বিক্রি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। মাসওয়ারি হিসাবে ফেব্রুয়ারিতে বিক্রি ৮% কমেছে।
সবজির বিক্রিও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এছাড়া মানুষ এখন সাবান, তেল ও শ্যাম্পুর ছোট প্যাকেট কিনছে বলেও জানান তিনি।
ঈদের মৌসুমে ব্যবসাপাতির মন্দা নিয়ে উদ্বেগে ফ্যাশন হাউজগুলো:
দেশের ফ্যাশন হাউসগুলি মহামারি-জনিত অভিঘাতের ক্ষতি থেকে ধীরে ধীরে ব্যবসায় ফিরে আসছিল। শীতকালে ভালো বেচাকেনা হওয়ার পর, গ্রীষ্ম মৌসুমেও ভালো ব্যবসার আশা করছিল তারা। কিন্তু পণ্যের দাম বৃদ্ধি তাদের শঙ্কিত করে তুলেছে। আশঙ্কা এই যে, আসন্ন পহেলা বৈশাখ এবং ঈদ উৎসবে তাদের ব্যবসা পুনরুদ্ধার ব্যাহত হবে।
তবে ব্যবসায়ীরা টিবিএসকে জানিয়েছেন,তাদের বর্তমান বিক্রির পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলেও- তা এখনও সন্তোষজনক।
বাংলাদেশ ফ্যাশন ডিজাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও অঞ্জনসের মালিক শাহিন আহমেদ বলেন, "করোনাভাইরাস এবং মূল্যস্ফীতি ইতিমধ্যেই মানুষের পকেটে ধাক্কা দিয়েছে। ফলে এই পহেলা বৈশাখের জন্য আমরা তেমন কোনো প্রস্তুতি নিইনি, তবে ঈদুল ফিতরের জন্য আমাদের প্রস্তুতি ভালো।"
ইলেকট্রনিক্স, মোটরসাইকেল বিক্রিতে ধীর গতি:
টিভি, রেফ্রিজারেটর এবং মোবাইল হ্যান্ডসেটসহ ইলেকট্রনিক্স পণ্যের বিক্রয় মহামারির শীর্ষ প্রাদুর্ভাবের কালেও বেশ স্বাভাবিক ছিল। ২০২০ সালের মহামারির সর্বোচ্চ সময়ে মোটরবাইক বিক্রি ধীর গতি লক্ষ্য করলেও, পরের বছর ২০২১ সালেই তা বেশ ভালভাবে পুনরুদ্ধার করেছিল।
তবে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামের সাম্প্রতিক বৃদ্ধি এই পণ্যগুলির বিক্রিতে প্রভাব ফেলেছে। এই বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মোবাইল ফোনের বিক্রয় প্রবৃদ্ধি হয়েছে নেতিবাচক ৫%, স্বল্পমূল্যের মোটরসাইকেল বিক্রিও কিছুটা ধীরগতির প্রবৃদ্ধির পথে পড়েছে।
ওয়ালটন মোবাইলের চিফ বিজনেস অফিসার (সিবিও) এস এম রেজোয়ান আলম বলেন, গ্রীষ্মকালে সাধারণত বৈদ্যুতিক পণ্যের বিক্রি বেশি হয়, তবে এ বছর সেই প্রবণতা নেই। মোবাইল ফোনের বিক্রিও গত বছরের তুলনায় কম বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ মোটরসাইকেল অ্যাসেম্বলার অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএএমএ) সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব কুমার রায় বলেন, এ শিল্পে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন শুরু হওয়ায় পর দাম কমতে শুরু করায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাইকের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু, সস্তা দু-চাকার বাহনের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে, যা খরচ সচেতন গ্রাহকদের দ্বিধা-সংকোচ তুলে ধরছে।
রমজানে বহুল বিক্রিত পণ্যের চাহিদা এখনও জমেনি:
রমজান মাসে যেসব নিত্যপণ্যের বিক্রির কাটতি বেশি থাকে, সেগুলোর বিক্রি সাধারণত দেশের নিত্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে বেড়ে যায়। শব-ই-বরাতের পর থেকে এবং রমজান শুরু পর্যন্ত বাড়তে থাকে এই বিকিকিনি, একইসাথে দামও বেড়ে যায়।
তবে এ বছর লেনদেন স্বাভাবিকের চেয়ে কম। এছাড়া নিত্যপণ্যের দামও বেশ নিম্নমুখী প্রবণতায় রয়েছে।
খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী হক ট্রেডিং-এর স্বত্বাধিকারী আজিজুল হক টিবিএসকে বলেন, পাইকারি বাজারের ভিড়ে রমজানের আগে, সাধারণত বছরের এ সময় বন্দর নগরীর কোতোয়ালি মোড় থেকে খাতুনগঞ্জ পর্যন্ত প্রচণ্ড যানজট সৃষ্টি হয়, কারণ ব্যাপক বিক্রিবাট্টা চলে। কিন্তু এ বছর বাজারে বিক্রি এতটাই কম যে, বাজারে কোনো পরিবহনের গাড়ি নেই বললেই চলে।
রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার কারওয়ান বাজারের ভাই ভাই স্টোরের স্বত্বাধিকারী হাবিবুর রহমান বলেন, রমজানকে সামনে রেখে ছোলা, চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপণ্যের চাহিদা কিছুটা বাড়লেও- তা আগের বছরগুলোর তুলনায় অনেকটাই কম।
বেশিরভাগ ভোক্তা এখন সস্তা পণ্য খুঁজছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
হোটেল ব্যবসায় স্থিতাবস্থা:
নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বমুখী মিছিল খাবারের ব্যবসাগুলিকে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ফেলেছে। সংকট মোকাবিলা করার জন্য, বেশিরভাগ হোটেল দাম বাড়ানোর পরিবর্তে পরিবেশনের পরিমাণ কমানোর বিকল্প বেছে নিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলিতে অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পরও তাদের মধ্যে অনেকেই খদ্দের ধরে রাখতে মাছ, মাংস এবং শাকসবজিসহ কিছু খাবারের দাম বাড়াতে পারেনি। রেস্তোরাঁতে মানুষের ভিড়ও ক্রমেই কমে আসছে।
অনলাইন ফুড ডেলিভারি সার্ভিস হাংরি-নাকির চিফ অপারেটিং অফিসার তাহমিনা ফেরদৌসি বলেন, হোটেলগুলোতে খাবার পরিবেশনের পরিমাণ হয়তো কমে গেছে। সে হিসেবে খাবারের দাম তেমন বাড়েনি। আবার বিভিন্ন অফারের মাধ্যমে ভোক্তাদের ধরে রাখছে খাদ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলস্বরূপ, প্রবৃদ্ধি কমে গেলেও, বিক্রি এখনও কমেনি।
পাঠাও-এর চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ফাহিম আহমেদ জানান, তার কোম্পানি যেসব গ্রাহক মূল্যছাড়ের চেয়ে খাবারের গুণমান এবং ডেলিভারির পরিষেবাকে অগ্রাধিকার দেয়, তাদের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়। তাই, পাঠাও ফুডের অর্ডার বৃদ্ধি এখনও কমেনি।
তিনি অবশ্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে পণ্যের দাম বাড়তে থাকলে আগামী দিনে পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যেতে পারে।