২০১৪ সালের চেয়েও একাট্টা হয়ে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পশ্চিমের, কিন্তু রাশিয়াকে টলাতে পারবে না
রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ জব্দ করে আবারও দেশটির ওপর অর্থনৈতিক চাপ তীব্র করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে আমেরিকা ঘোষণা দেয়, আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সুইফট পেমেন্ট নেটওয়ার্ক থেকে কিছু নির্দিষ্ট রাশিয়ান ব্যাংককে বের করে দেবে তারা।
ইউক্রেনে চালানো হামলার মধ্যেই রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য এ ব্যবস্থা নিয়েছে আমেরিকা। অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোও রাশিয়ার ওপর একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে চলেছে। এভাবে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ঘটনাকে বিশেষজ্ঞরা নজিরবিহীন বলছেন।
তবে বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন যে, রাশিয়ার পাল্টা ব্যবস্থা—যার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রার (সিবিডিসি) রিজার্ভ ব্যবহারও আছে—মস্কোকে এই নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ সোমবার জানায় যে, মার্কিন নাগরিকদের রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। যা যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকটির সম্পদ জব্দ করার সমতুল্য।
কিছু মিত্রদেশও যুক্তরাষ্ট্রের পথ ধরেছে। ২৬ জন রাশিয়ানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইইউ। যুক্তরাজ্য ঘোষণা দিয়েছে, রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ব্রিটিশ নাগরিকদের আর্থিক লেনদেন নিষেধ করা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, এমন নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার অর্থনৈতিক খাত ভালোই ঝামেলায় পড়বে। কয়েকদিন ধরেই দেশটির অর্থনৈতিক খাত বেশ টালমাটাল। সোমবার মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুবলের দাম পড়ে গেছে ২১ শতাংশ। তবে মঙ্গলবার ফের রুবলের দাম ১২ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেড়েছে। এ সপ্তাহে দেশটির স্টক এক্সচেঞ্জ মস্কো এক্সচেঞ্জ বন্ধ হয়ে গেছে।
ইয়াৎ-সেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক লিন জিয়াং বলেছেন, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়া সবচেয়ে বড় যে ধাক্কা খাবে সেটি হলো, দেশটি বিদেশের ব্যাংকগুলোতে রাখা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আনতে পারবে না।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৬৪৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৩১১ বিলিয়ন ডলার আছে বিভিন্ন দেশে সিকিউরিটি ও বন্ড আকারে। আর ১৫২ বিলিয়ন ডলার আছে বিদেশি ব্যাংকগুলোতে।
আমেরিকা ও ইইউ যদি রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জব্দ করে, তবে রুবলের দাম আরও পড়ে যেতে পারে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার নিজস্ব পদ্ধতি আছে রাশিয়ার। এসব অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশটির অর্থনৈতিক ভিত্তি টলে যাবার সম্ভাবনাও খুব কম বলে মনে করছেন তারা।
এর একটি কারণ হলো ২০১৪ সালের আগেও রাশিয়া এরকম অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হয়েছিল। সে সময় বেশ কিছু রাশিয়ান কোম্পানির সম্পদ জব্দ করা হয়, বাজেয়াপ্ত করা হয় কিছু রাশিয়ান ব্যাংকের কার্ড। ফলে তখনও এবারের মতোই বিপাকে পড়েছিল দেশটির অর্থনৈতিক খাত। কিন্তু আগেরবারের ওই নিষেধাজ্ঞায়ও রাশিয়ার অর্থনীতি টলে যায়নি। সে সময় দেশটি এই ধাক্কা সামলায় বেশ কিছু উদ্যোক্তাকে সরকারি সহায়তা দিয়ে এবং অফশোর কোম্পানিকে বৈধতা দিয়ে।
গবেষকরা বলছেন, এবারের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা নজিরবিহীন হলেও ২০১৪ সালের দিকে আগেও একবার নেওয়ায় সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো আগের পদক্ষেপেরই সামান্য সম্প্রসারিত রূপ। রাশিয়া ইতিমধ্যে এসব নিষেধাজ্ঞা সামলানোর উপায় ভেবে রেখেছে বলে ধারণা করছেন তারা।
ইতিমধ্যে কিছু কিছু উপায়ের প্রয়োগ দেখাও গেছে। যেমন, ক্রেমলিন সম্প্রতি বৈদেশিক মুদ্রা ঋণ নেওয়ার ওপর এবং রাশিয়ান নাগরিকদের দেশের বাইরে বৈদেশিক মুদ্রা নেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
সম্প্রতি রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান এলভিরা নাবিউলিনা বলেন, রাশিয়ার নিজস্ব অর্থনৈতিক লেনদেনের বার্তা আদানপ্রদানের মাধ্যম এসপিএফএস দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে মসৃণভাবেই সুইফটের কাজ চালানো যাবে।
এদিকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার পরপরই রাশিয়ায় সুদের হার সাড়ে ৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। এই নীতি গ্রহণের আপাতত রুবলের দামপতন ঠেকানো গেছে।
গবেষক চেন জিয়া বলেন, মার্কিন নেতৃত্বাধীন পেমেন্ট সিস্টেমকে পাশ কাটানোর জন্য রাশিয়া সিবিডিসি পদ্ধতির আশ্রয় নিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার গ্রহণযোগ্যতার কথাও ভাববে রাশিয়া। কেননা রাশিয়াকে সুইফট থেকে বের করে দিলে অন্যান্য সদস্যদেশগুলোর ওপর এর গুরুতর প্রভাব পড়বে।
কনটেম্পোরারি চায়না-রাশিয়া রিজিয়নাল ইকোনমি রিসার্চ ইন্সটিটিউট-এর প্রেসিডেন্ট সং কুই বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর রাশিয়া। এই সম্পদও দেশটিকে বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সাহায্য করতে পারে।
তাই সব মিলিয়ে অনেক বিশ্লেষক ও গবেষকই ধারণা করছেন, রাশিয়ার ওপর ২০১৪ সালের চেয়ে বেশি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েও এবার সুবিধা করতে পারবে না পশ্চিমা দেশগুলো।
- সূত্র: দ্য গ্লোবাল টাইমস