আনহেল দি মারিয়া: বড় ম্যাচের কালো ঘোড়া
২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে চোটের জন্য খেলতে পারেননি। অনেককেই আফসোস করতে দেখা যায়, সেদিন তিনি থাকলে হয়তো আর্জেন্টিনা আর লিওনেল মেসির অপেক্ষাটা এত দীর্ঘ হতো না। থাক সেসব 'যদি' এবং 'কিন্তু'র তর্ক। আনহেল দি মারিয়া যে বড় ম্যাচে খেলোয়াড়, এটি আরেকবার প্রমাণ করে দিলেন।
কাতার বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের বিপক্ষে হারের পর আর্জেন্টিনার দরকার ছিল একটা মুহূর্তের, যা পারবে তাদের বিশ্বকাপ স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে। সেটি লিওনেল মেসি উপহার দিলেন মেক্সিকোর বিপক্ষে, তার করা গোলের পাসটি দিয়েছিলেন দি মারিয়াই।
যদিও দি মারিয়ার নিজেই সেই পাসের খুব বেশি গুণগান গাননি, তার মতে, তিনি শুধু বলটা মেসিকে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সেই পৌঁছে দেওয়ার কাজটাই মেসির সঙ্গে ২০০৫ সাল থেকে করে আসছেন মারিয়া। কাতার বিশ্বকাপে এই যাত্রা পেল পূর্ণতা।
২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনাল না খেলতে পারার কষ্টই যেন কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে এসে মেটালেন। অথচ তার খেলা নিয়ে সংশয় ছিল এবারও। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে পাওয়া চোটের জন্য খেলতে পারেননি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ ষোলোর ম্যাচ। কোয়ার্টার-ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে নেমেছিলেন বদলি হিসেবে কিছুক্ষণের জন্য। সেমি-ফাইনালেও জয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় তাকে নামানোর ঝুঁকি নেননি লিওনেল স্কালোনি। কারণ তিনি জানতেন, ফাইনালেই দেখা দিতে হবে সত্যিকারের দি মারিয়াকে। যেই মারিয়া বড় ম্যাচ হলেই বারুদের মতো জ্বলে উঠেন। যেই মারিয়া কখনোই হতাশ করেন না তার দলকে।
দি মারিয়া হতাশ করেননি এবারও। ম্যাচের ২০ মিনিটে আর্জেন্টিনার পাওয়া পেনাল্টি তার কল্যাণেই, তার আঁকাবাঁকা দৌড়ের দিশা না পেয়ে দেম্বেলে ফাউল করে বসেন দি মারিয়াকে। সেখান থেকে গোল করে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দিতে ভুল করেননি লিওনেল মেসি। ৩৬ মিনিটে প্রতি-আক্রমণ থেকে যে দুর্দান্ত গোলটি করল আর্জেন্টিনা, সেটির শেষ ছোঁয়াটি ছিল দি মারিয়ারই। গোল করার পর কান্না আটকে রাখতে পারেননি তিনি। আর রাখবেনই বা কেন! এটি যে তারই মুহূর্ত ছিল।
এরপরেও ফ্রান্সের রক্ষণভাগের সঙ্গে যা করলেন, সেটিকে ছেলেখেলা বললেও ভুল হবে। ৩৫ বছর বয়সী দি মারিয়া যে আর ২৪ বছরের টগবগে যুবক নন, সেটি ভাবতে কষ্টই হচ্ছিল তার দৌড় দেখে। ফিটনেস পুরোপুরি ফেরত আসেনি তা বোঝা গেল যখন স্কালোনি ৬০ মিনিটের মাথায় তাকে তুলে নিলেন। এরপর ম্যাচে একের পর এক নাটকে বাঁক বদল হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়ের মালা গলায় ঝুলিয়েছে আলবিসেলেস্তেরাই।
কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল করা দি মারিয়াই ২০২১ কোপা আমেরিকার ফাইনালে করেছিলেন আর্জেন্টিনার একমাত্র গোলটি, সেটিই পরে জয়সূচক হয়ে দাঁড়ায়। স্বাগতিক ব্রাজিলের বিপক্ষে করা সেই গোলের মাধ্যমে আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের আন্তর্জাতিক শিরোপা না জেতার ক্ষরা ঘোচান মারিয়া।
এরপর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন ইতালির বিপক্ষে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে 'ফিনালিসিমা'তেও করেন আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম গোল। আলবিসেলেস্তেরা ম্যাচটি জেতে ৩-০ গোলে। ২০০৮ অলিম্পিকের ফুটবলে আর্জেন্টিনার স্বর্ণ জয়ের পেছনেও বড় অবদান ছিল দি মারিয়ার। ফাইনালে গোল করেছিলেন তিনি। লিওনেল মেসি সেখানেও ছিলেন তার সঙ্গী। ২০০৫ যুব বিশ্বকাপের শিরোপাও জেতেন মেসিকে সাথে নিয়েই। মেসি যদি হন পাবলো পিকাসো, দি মারিয়া হলেন তার তুলির রঙ।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তো বটেই, ক্লাব ফুটবলে অসংখ্য বড় ম্যাচে দলের সেরা পারফর্মার ছিলেন দি মারিয়া। ২০১৪ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে হয়েছিলেন ম্যান অব দ্যা ম্যাচও। রিয়াল মাদ্রিদের ১২ বছরের অপেক্ষা ঘোচানো দশম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে অগ্রণী ভূমিকা ছিল মারিয়ার।
দি মারিয়া যেন জন্মেছেনই তার খেলা দলগুলোর অপেক্ষা ঘোচানোর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। নয়তো আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের ট্রফি ক্ষরা, ৩৬ বছরের বিশ্বকাপ ক্ষরা কিংবা রিয়াল মাদ্রিদের ১২ বছরের অপেক্ষার সব কেন এক দি মারিয়ারই শেষ করতে হবে!
দি মারিয়ার নিজের অপেক্ষাও অবশেষে শেষ হল, আট বছর যে যন্ত্রণা পুষে রেখেছিলেন মনের ভেতর, তা কাতারে মরুভূমিতে কবর দিয়েই দিলেন আর্জেন্টিনার সাফল্যের এই নেপথ্য নায়ক।