যেভাবে একটি ন্যাপকিনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল মেসির বার্সেলোনা অধ্যায়
বার্সেলোনা ছাড়া অন্য কোনো ক্লাবের জার্সিতে এখনো লিওনেল মেসিকে কল্পনা করা কঠিন বিষয়। কিন্তু সেই অকল্পনীয় ব্যাপারটিই ঘটতে চলেছে।
সেই ১৩ বছর বয়সে প্রথম লাল-নীল জার্সিটিকে আপন করে নিয়েছিলেন মেসি। গত ২১ বছরে নিজেকে সেই জার্সির সমার্থকও বানিয়ে ফেলেছেন এই আর্জেন্টাইন।
যেমন নাটকীয়ভাবে শেষ হচ্ছে, এই ছয়বারের ব্যালন ডি'অর জয়ীর বার্সেলোনা অধ্যায় শুরুও কিন্তু হয়েছিল এরকম নাটকীয়ভাবেই। বার্সেলোনার ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ক্যারিয়ারটি শুরু হয়েছিল একটি ন্যাপকিনের মাধ্যমে।
১৯৯৯ সালে নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজের যুব দলের কোচ আদ্রিয়ান কোরিয়া ১২ বছরের মেসিকে নিয়ে বলেছিলেন, 'এই ছেলের দিকে যখন আপনি তাকাবেন, মনে হবে এ তো ফুটবলই খেলতে পারবে না।এই ছেলে খাটো, হ্যাংলা, অনেক ছোটও। কিন্তু সে খেলা শুরু করার সাথে সাথেই আপনি বুঝবেন এই ছেলেকে অন্যভাবে তৈরি করা হয়েছে। ও অসাধারণ। দুর্দান্ত কিছু একটা হতে যাচ্ছে সে।'
কথা সত্য। সেই বয়সেই নিজের জাত চিনিয়েছিলেন মেসি। নিউওয়েলসের ছয় বছরে প্রায় ৫০০টির মতো গোল করেছিলেন তাদের যুব দলের হয়ে।
মেসির প্রতিভা নিয়ে কারো কোন সন্দেহ না থাকলেও অস্বাভাবিক শারীরিক গড়ন তার পেশাদার ফুটবলার হওয়ার সম্ভাবনাকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল।
মাত্র ১০ বছর বয়সে তার শরীরে 'গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সি' নামের জটিল এক ব্যাধি ধরা পড়ে। এর কারণেই বাকি শিশুদের তুলনায় ক্ষীণকায় ছিলেন মেসি, এবং তার শারীরিক বৃদ্ধিও একরকম আটকে গিয়েছিল।
চিকিৎসার জন্য তখন মাসে প্রায় ৮৪ হাজার টাকা খরচ হচ্ছিল, যা বহন করার সামর্থ্য ছিল না তার পরিবারের। নিউওয়েলস প্রথম কিছুদিন চিকিৎসার খরচে সাহায্য করলেও একসময় তারাও সরে যায়।
সেসময় রিভার প্লেট মেসির ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসার খরচের কথা শোনার পর তারাও পিছিয়ে যায়।
বাবার স্বাস্থ্য বীমার মাধ্যমে দুই বছর চিকিৎসা চলার পর মেসিকে তাই নতুন গন্তব্যের খোঁজ করতে হয়েছিল।
ঐতিহাসিক ন্যাপকিন চুক্তি
ভাগ্যক্রমে, স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনার সাথে যোগাযোগ হয়ে যায় মেসির। তার এজেন্টরা মিলে বার্সায় একটি ট্রায়ালের ব্যবস্থা করেন এই প্রডিজির।
ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে ন্যু ক্যাম্পে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা বার্সার তৎকালীন ট্যাকনিকাল সেক্রেটারি জোসেপ মারিয়া মিঙ্গুয়েলাও উপস্থিত ছিলেন সেই ট্রায়ালে। মেসিকে দেখে তিনি এতোটাই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন যে ১৩ বছরের সেই ছেলেকে 'পরবর্তী ম্যারাডোনা' খেতাবই দিয়ে বসেন।
সবাই তখন একই কথা বলতো। প্রথম দেখায় কেউ বিশ্বাস করতে পারতো না ছেলেটা কতো ছোট। এরপর খেলা দেখার পর কেউ বিশ্বাস করতে পারতো না ছেলেটা কত দুর্দান্ত।
বার্সেলোনার তৎকালীন ট্যাকনিকাল ডিরেক্টর চার্লি রিজাক মেসির খেলা দশ মিনিট দেখে চলে গিয়েছিলেন। মেসির পরিবার ও এজেন্টরা ভেবেছিল, বার্সেলোনার স্বপ্ন তাহলে এখানেই শেষ।
কিন্তু আসলে হয়েছিল উল্টোটা।
'দুই মিনিট দেখেই আমি বুঝেছিলাম। আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে সেও একই কথা বলবে,' বলছিলেন রিজাক।
কিন্তু বোর্ডের লোকজন তারপরও রাজি ছিল না। তখন ১৩ বছরের ছেলেকে ক্লাবে ভেড়ানোই অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার ছিল, আর এই ছেলে তো এসেছে আটলান্টিকের অপর প্রান্ত থেকে।
এছাড়া মেসির দামও কিন্তু কম না। চিকিৎসা খরচের জন্য মাসিক ৮৪ হাজার টাকা, তার সাথে মেসির বাবাকে দিতে হবে বাৎসরিক ৪৭ লাখ টাকা। একটা বাচ্চা ছেলের পেছনে এতো টাকা খরচ করার জন্য প্রস্তুত ছিল না বার্সা।
বার্সার গড়িমসি দেখে মেসির এজেন্টরা তখন খেলল দুর্দান্ত এক চাল। ২০০০ সনের ১৪ই ডিসেম্বর পম্পেরিয়া টেনিস ক্লাবে একটি টেনিস ম্যাচ শেষে তারা রিজাককে জানাল, বার্সেলোনা না চাইলে মেসিকে তারা রিয়াল মাদ্রিদে নিয়ে যাবে।
রিজাকের হাতে তখন কোন কাগজ ছিল না। পকেট থেকে একটা ন্যাপকিন বের করে সেই ন্যাপকিনেই তৎক্ষণাৎ নিয়ে নিলেন মেসির সাক্ষর। তর্কসাপেক্ষে ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দলবদলটি হল একটি ন্যাপকিনের মাধ্যমে।
মেসির এজেন্ট হোরাসিয়া গাজ্জালিয়োর কাছে এখনো আছে সেই ন্যাপকিনটি। সেখানে লেখা, "বিভিন্ন পক্ষের দ্বিমত থাকা সত্ত্বেও বার্সেলোনার ট্যাকনিকাল সেক্রেটারি হিসেবে আমি, চার্লি রিজাক, শর্তসাপেক্ষে লিওনেল মেসিকে স্বাক্ষর করাচ্ছি।'
লা মাসিয়ায় যোগ দেয়ার পর প্রথম বছরটায় কিছুটা ভুগতে হয়েছিল মেসিকে। দলবদল সংক্রান্ত জটিলতার জন্য প্রথম বছর তেমন প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলা হয়নি তার। এছাড়া পরিবারের লোকজন আর্জেন্টিনায় ফিরে যাওয়ার পর কিছুটা গৃহকাতরও হয়ে পড়েছিলেন ১৩ বছরের মেসি। কথাবার্তা কম বলায় নতুন দেশে এসে সতীর্থদের সাথেও ঠিকভাবে মিশতে পারছিলেন না।
তবে পরের বছরই নিজের পায়ে দাঁড়ান মেসি। হরমোনের চিকিৎসা নেওয়ার পর শারীরিকভাবে কিছুটা বলিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রয়্যাল স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের তালিকায় নিবন্ধিত হওয়ার পর খেলতে পারছিলেন নিয়মিত ফুটবলও।
এরপর আর কখনোই পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মেসির। জেরার্ড পিকে ও সেস্ক ফ্যাব্রিগাসের মতো সতীর্থদের সাথে মিশে মেসি হয়ে উঠেন লা মাসিয়ার সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতিভা। তাদের দল 'বেবি ড্রিম টিম'কে এখনো বার্সেলোনার ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী যুবদল হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।
২০০৩ সালে জোসে মরিনহোর পোর্তোর বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচ দিয়ে সিনিয়র দলে অভিষেক হয় মেসির। এরপর গত ১৭ বছরে ক্লাবের জার্সিতে ৭৭৮টি ম্যাচ খেলে করেছেন ৬৭২ গোল, জিতেছেন ৩৪টি ট্রফি, ভেঙেছেন অসংখ্য রেকর্ড। ব্যক্তিগত পুরষ্কার হিসেবে জিতেছেন ছয়টি ব্যালন ডি'অর সহ অসংখ্য সম্মাননা।