মেসির শহর: কেমন ছিল তার শৈশবের দিনগুলো
আগেরদিনে তার এলাকা দেখতে কেমন ছিল, এখনও মনে করতে পারেন ৭০ বছর বয়সি সুজানা আরাউস। এলাকার মানুষ তখন সময় কাটাত বন্ধুদের সঙ্গে তাস খেলে। ছোট বাচ্চারা রাস্তায়ই হইহই করতে করতে ফুটবল খেলত।
এই বাচ্চাদের দঙ্গলে ছিল এক ছোটখাটো ছেলে। তার কল্যাণেই বিশ্ব মানচিত্রে আলাদা জায়গা পেয়ে গেল আর্জেন্টিনার এই ছোট জায়গাটি।
'ও ছিল আর দশটা বাচ্চার মতোই'—আরাউস এই মন্তব্যটি করেছেন এ গ্রহের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসিকে নিয়ে।
আর্জেন্টিনার রোজারিওর শহরের লা বাজাদা নামের এই এলাকাতেই কেটেছে মেসির শৈশব।
'ও বরাবরই খুব শান্তশিষ্ট ছিল,' মেসির সঙ্গে ফুটবল খেলা ৩৩ বছর বয়সি বারবারা সসি জানালেন। 'এখন যেমন ভদ্র দেখেন ওকে, সারা জীবন ও এমনটাই ছিল।'
রোজারিওর প্রধান স্থানীয় ক্লাব নিউয়েলস ওল্ড বয়েজ-এর যুবদলের হয়ে ছয় বছর খেলেছেন মেসি। এই অর্ধযুগে গোল করেছেন ৫০০-র বেশি।
ছোট্ট মেসির প্রতিভাই তার পরিবারকে আর্জেন্টিনা থেকে স্পেনে উড়িয়ে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে বেড়ে ওঠার হরমোন ঘাটতির চিকিৎসা করানো হয়। স্পেনে বার্সেলোনা ক্লাবে দীর্ঘ ২১ বছর খেলেন মেসি।
এই কাতালান ক্লাবেই বৈশ্বিক সুপারস্টার হয়ে ওঠেন মেসি। তিনি যতদিন ক্লাবে ছিলেন, ওই সময়ে বার্সা ৩৫টি ট্রফি জেতে—যার মধ্যে ছিল ১০টি লা লিগা, সাতটি কোপা দেল রে ও চারটি উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ।
ফুটবলের সর্বোচ্চ পুরস্কার ব্যালন ডিঅর সবচেয়ে বেশি সাতবার জিতেছেন লিওনেল মেসি। গত বছর আর্জেন্টিনার ক্যাপ্টেন হিসেবে খেলে ঘরে তুলেছেন কোপা আমেরিকা কাপের শিরোপা। এখন প্রস্তুত হচ্ছেন নিজের পঞ্চম—এবং সম্ভবত শেষ—বিশ্বকাপ খেলার জন্য। একমাত্র এই শিরোপাটা জেতাই এখনও বাকি আছে এই ফুটবল-বিস্ময়ের।
লা বাজাদায় কাটানো ১৩ বছর, সেখানকার সড়ক—যেখানে তার ফুটবল প্রতিভার প্রাথমিক বিকাশ হয়েছে—মেসির মাঝে ছাপ রেখে গেছে। ছোট্ট শহরটিতে এখন আর না থাকলেও, এখনও অনেকভাবেই সেখানে রয়ে গেছেন তিনি। এখানকার বিশাল ম্যুরাল আর বাসিন্দাদের স্মৃতিতে এখনও বাস করেন লিওনেল মেসি।
মেসির প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এখনও সেখানে পড়ান। তার হাই স্কুলের গ্রেড সংরক্ষিত আছে একটি নীল রেকর্ড বইয়ের পাতায়, বাকি সব শিক্ষার্থীর সঙ্গে।
বাবা-মায়েরা—যারা এখন দাদা-দাদি—এখনও স্মৃতি রোমন্থন করেন, মেসি আর তাদের সন্তানরা কীভাবে খেলতে যেত। মেসির বন্ধুরা এখন প্রাপ্তবয়স্ক, নিজেরাই সন্তানের বাবা-মা হয়ে গেছেন।
ডাউইডাউইকজ, বয়স ৭৫। ১৯৭০-এর দশকে স্বামীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছিলেন তিনি। তিন বছর সেখানে একটি পার্স তৈরির কারখানায় কাজ করে লা বাজাদায় ফিরে আসেন।
ডাউইডাউইকজ ও আরাউস মেসি ও তার পরিবারকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন। মেসির দাদি সেলিয়ার কথা মনে আছে তাদের। ছোট্ট নাতিকে দলে নেওয়ার জন্য এই কোচ থেকে ওই কোচের কাছে ধরনা দিতেন তিনি।
মেসির বয়স যখন ১০, তখন মারা যান সেলিয়া। গোল করার পর উদযাপন করার জন্য মেসি যখন আকাশের দিকে ইশারা করেন, সেটি তিনি করেন দাদির স্মরণে।
ডাউইডাউকজের ভাষ্যে, মেসি ছিলেন 'খুবই ভালো বাচ্চা'।
ওই সড়কেরই আরেক বাসিন্দা সেবাস্তিয়ান মুরুয়া তার সঙ্গে একমত পোষণ করে বললেন, 'হোর্হেকে [মেসির বাবা] আমি বলাম, তোমার কাছে সোনার টুকরা আছে।' ৬৬ বছর বয়সি মুরুয়া একটি বেকারিতে কাজ করেন।
মুরুয়ার চার ছেলে। তাদের একজন মেসি যে সড়কে খেলতেন সেখানে ছোট্ট একটা ফুটবল ক্লাব খুলেছে। ক্লাবটির আপ্তবাক্য হচ্ছে, 'লা পেলোতা সিয়েম্প্রে আল ১০'—অর্থাৎ 'সবসময় ১০ নম্বরকে বল (পাস) দেবে'। মেসির সম্মানেই এই আপ্তবাক্য স্থির করেছে ক্লাবটি।
মুরুয়া একগাল হেসে বলেন, 'এলাকায় স্পেসশিপের মতো নতুন কোনো গাড়ি দেখা গেলেই বুঝবেন, ওই টিন্টেট জানালার পেছনে বসে আছে লিও অথবা ওর পরিবারের কেউ।
'ওদেরকে আমার অভিবাদন। ওরা একটা পরিবার হিসেবে বেড়ে উঠেছে। মুদি দোকানে ওদের সঙ্গে দেখা হলে ওরা শুভেচ্ছা বিনিময় করে, যেন সারা জীবন আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি।' মেসির পরিবারের সদস্যরা এখনও এ এলাকায় থাকে।
গত দশকে মাদকযুদ্ধের জন্য রোজারিওতে সহিংসতা বেড়ে গিয়েছিল চড়চড় করে। শহরটিতে হত্যাকাণ্ডের হার জাতীয় গড়ের চেয়ে চারগুণ বেশি। আগের প্রজন্মের মানুষরা লা বাজাদাকে শান্তিপূর্ণ এলাকা বললেও সেখানকার সর্বত্র ভেসে বেড়ায় অনিরাপত্তার গন্ধ।
ছোটবেলায় মেসির সঙ্গে ফুটবল খেলতেন বারবারা সসি। তিনি এখন ১৩ বছর বয়সি এক মেয়ের মা। লা বাজাদার এক পরিত্যক্ত মাঠে হাঁটতে হাঁটতে সসি জানালেন, 'সন্ধ্যা ৭টার পরে আমি আমার মেয়েকে বাইরে যেতে দিই না। ওর স্কুল বাড়ি থেকে মাত্র তিন ব্লক দূরে, তবু ওর একা একা স্কুল থেকে ফেরাটা মাত্র কদিন হলো স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছি।'
সড়কের অপর পাশের পৌর ভবন দেখানলেন সসি। জানালেন, কদিন আগেই ওই ভবনের সামনে একজন গুলি ছুড়েছিল। তখন রাত ছিল। কপাল ভালো, কেউ আহত হয়নি।
সসি বললেন, 'আমার বাচ্চাদের বলি, গুলির শব্দ শুনলেই মাটিতে শুয়ে পড়বে। আতশবাজির শব্দ শুনলেও। গোটা এলাকাটাই বদলে গেছে।'
তবে লা বাজাদার কিছু জিনিস এখনও আগের মতোই রয়ে গেছে।
মেসির হাই স্কুলের যে নীল রেকর্ড বইয়ে তার গ্রেড লেখা আছে, সেটি এখনও স্কুলের অফিসের একটি তাকে রক্ষিত আছে। একজন সেক্রেটারি রেকর্ড বইটি এনে দেখালেন।
বই দেখে জানা গেল, হাই স্কুলের প্রথম বর্ষ শেষ হওয়ার আগেই বার্সেলোনায় পাড়ি জমিয়েছিলেন মেসি।
স্কুল প্রশাসনের কর্মী, ৪০ বছর বয়সি সিন্টিয়া ভেগা গর্বের সুরে জানালেন, 'ও কখনও নিজের শেকড় ভোলেনি। ওর কথার আর্জেন্টাইন টানও কখনও মিলিয়ে যায়নি। ছেলেটা ওর দেশ আর শহরকে ভালোবাসে। খাঁটি রোজারিনোর মতোই কথা বলে ও।'
মেসির এলিমেন্টারি স্কুল এসকুয়েলা নং ৬৬ জেনারেল লাশ হেরাস-ও কাছেই। এই স্কুলটির সঙ্গে মেসির নাড়ির টান বেশি মজবুত, কারণ প্রাথমিক শিক্ষার পুরো সময়টাই এখানে কাটিয়েছেন ফুটবল জাদুকর। ২০০৫ সালে, ১৮ বছর বয়সে স্কুলটিতে গিয়েছিলেন তিনি। এরপর নানা সময়ে নানাভাবে সাহায্য দিয়েছেন নিজের এলিমেন্টারি স্কুলে। কম্পিউটার থেকে শুরু করে অন্য প্রদেশে স্কুল স্কুল ট্রিপের খরচ পর্যন্ত জুগিয়েছেন তিনি।
মেসির পঞ্চম ও ষষ্ঠ গ্রেডের শিক্ষিকা আন্দ্রেয়া সোসা জানালেন, 'একবারও এসব সাহায্য প্রকাশ্যে আসুক, তা চায়নি ও।'
স্কুলটির বাইরের দেয়ালে এখন শোভা পাচ্ছে ব্রাজিলিয়ান শিল্পী পাউলো কনসেন্টিনোর আঁকা মেসির ম্যুরাল। সোসা বললেন, তাদের স্কুলের হলে হেঁটে বেড়ানো ছোট্ট ছেলেটি যে এত সব অর্জন করেছে, তা এখনও অকল্পনীয় লাগে তার কাছে।
সোসা আরও বললেন, গত বছর কোপা আমেরিকা জিতে নিশ্চয় মেসির কাঁধ থেকে বড় একটা বোঝা নেমে গেছে। কারণ তার হাত ধরে আর্জেন্টিনায় একটা আন্তর্জাতিক ট্রফি আসবে—এই আশায় বুভুক্ষুর মতো বসে ছিল দেশবাসী।
সোসা মনে করেন, ক্যারিয়ারে ইতি টানা আগে একটা বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে আনার জন্য এখনও ভীষণ চাপে আছেন মেসি।
৩৫ বছর দায়িত্ব পালনের পর এবার অবসরে যাচ্ছেন ৫৫ বছর বয়সি সোসাও। নিজের প্রাক্তন ছাত্র যখন জীবনের নতুন ধাপে প্রবেশ করতে যাচ্ছে তখন তার জন্য শুভকামনা জানিয়ে এই শিক্ষক বললেন, 'আশা করি ও যা কিছুতে বিনিয়োগ করেছে, তার প্রত্যেকটা জিনিস উপভোগ করবে।'