আর্জেন্টিনার বিপক্ষে দুর্ভেদ্য দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কে এই পোলিশ গোলরক্ষক?
১৮ বছর বয়সেই গ্লাভসজোড়া খুলে রাখার জোগাড় হয়েছিল। ২০০৮ সালে জিম করার সময়ে হাতের ওপর এসে পড়ে ওয়েট (জিমের সরঞ্জাম), ভেঙে যায় দুই হাতই। সঙ্গে ফুটবল স্বপ্নও। চার মাস ফুটবলের বাইরে, ক্যারিয়ারই থেমে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু যার বাবা পোল্যান্ডের গোলবারের অতন্দ্র প্রহরী ছিলেন, তার ছেলে হয়ে হার মেনে নিলে কী হয়!
খেই হারাননি ভয়চেক শেজনি। জীবন যুদ্ধে এক পা, দু পা করে আজ তিনি স্বপ্নের ভুবনে, পোলিশ ফুটবলের নায়কদের একজন। ভেঙে যাওয়া হাত দুটিই বিশ্বস্ততায় পরিণত করে যে কিনা একাই লড়ে গেলেন লিওনেল মেসি ও তার দাপুটে দলের বিপক্ষে। অথচ সেই চোটের কারণে এখনও তিনি আর সবার মতো স্বাভাবিক সব কাজ করতে পারেন না!
কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচ হেরেছে রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলা পোল্যান্ড। রক্ষণাত্মক কৌশল নেওয়ায় পোল্যান্ডের সীমানাতেই বল বেশিরভাগ সময়ে থেকেছে, জিততে মরিয়া আর্জেন্টিনা একের পর এক আক্রমণ শানিয়ে গেছে। এরপরও ২-০ গোলের বেশি পাননি মেসিরা, এর নেপথ্যে বড় করে একটা নাম; তিনি শেজনি। পোলিশদের রক্ষণভাগও দায়িত্ব সামলেছে, তবে উড়ন্ত বলাকা হয়ে আলবিসেলেস্তেদের আক্রমণ থামিয়ে দেওয়ার পথে শেজনি ছিলেন অতুলনীয়। ১১ জনের বিপক্ষে একা বুক চিতিয়ে লড়েছেন পোল্যান্ডের হয়ে ৬৯টি ম্যাচ খেলা এই গোলরক্ষক।
বড় উদাহরণটিই দেওয়া যাক। ম্যাচের ৩৯তম মিনিটে পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা। আলভারেসের নেওয়া শট ফিরিয়ে দেন শেজনি। ফিরতি বলে মেসি হেড নেন, এ সময়ে সেজনির হাত মেসির মুখে লাগলে ভিএআরের সাহায্যে নিয়ে পেনাল্টি দেন রেফারি। স্পট কিক থেকে দারুণ শট নেন মেসি, কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে শটটি ফিরিয়ে দেন শেজনি। এবারের আসরের প্রথম গোলরক্ষক হিসেবে দ্বিতীয় পেনাল্টি সেভ করেন তিনি। সৌদি আরবের বিপক্ষেও পেনাল্টি ফেরান জুভেন্টাসের হয়ে খেলা এই গোলরক্ষক।
যা ২০০২ বিশ্বকাপের পর প্রথম। জাপান ও কোরিয়াতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে দুটি পেনাল্টি ফেরান যুক্তরাষ্ট্রের গোলরক্ষক ব্র্যাড ফ্রাইডেল। মেসির পেনাল্টি ফিরিয়ে আরও একটি রেকর্ডে নাম তুলেছেন পোলিশ গোলরক্ষক। নিজেই পেনাল্টির কারণ হয়ে নিজেই তা ঠেকানোর দিক থেকে বিশ্বকাপ ইতিহাসে এটা মাত্র দ্বিতীয় ঘটনা। প্রথমটা করেছিলেন ফ্রান্সের গোলরক্ষক জোয়েল বাটস, ব্রাজিলের বিপক্ষে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে।
মেসির পেনাল্টি ফেরানো অবিশ্বাস্য ছিল, এমন সাফল্যে প্রশংসায় ভাসছেন শেজনি। পাশাপাশি পুরো ম্যাচজুড়ে তিনি যেভাবে দলের গোলপোস্ট সামলেছেন, তা নিয়েও চলছে স্তুতি। পুরো ম্যাচ খেলা শেজনি একটি পেনাল্টি ফেরানো সেভ করেছেন ৯টি। ৪২ বার বল স্পর্শ করা পোলিশ এই গোলরক্ষক ডি-বক্সের মধ্যেই ৮ বার দলকে বিপদমুক্ত করেছেন, ছাঁপিয়ে পড়ে বল ফিরিয়েছেন ৬ বার। যে দুটি গোল তাকে হজম করতে হয়, সেখানে কিছুই করার ছিল না বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা এই গোলরক্ষকের।
আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচে শেজনির সেভগুলোর বর্ণনা দিতে গেলে সপ্তম মিনিট থেকেই শুরু করতে হবে। এ সময় ডি-বক্সের বাইরে থেকে মেসির নেওয়া ডান পায়ের দুর্বল শট সহজেই গ্লাভসবন্দি করেন তিনি। নবম মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে ডি মারিয়ার শট গায়ে লেগে ফিরে আসে। পরের মিনিটে ডান প্রান্ত দিয়ে আক্রমণে গিয়ে বাঁ পাশে মেসিকে বাড়ান মারিয়া। এগিয়ে গিয়ে কোণা থেকে শট নেন মেসি, কর্নারের বিনিময়ে দলকে বিপদমুক্ত শেজনি।
১৯তম মিনিটে আবারও আলবিসেলেস্তেদের আক্রমণ। মেসির উঁচু করে বাড়ানো পাসে দুর্বল হেড দেন আকুনা, যা গ্লাভসবন্দি করতে কোনো বেগই পেতে হয়নি শেজনিকে। ৩৩তম মিনিটে ডি মারিয়ার নেওয়া বাঁকানো কর্নার শট জালে জড়িয়ে যাচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে কর্নারের বিনিময়ে পোল্যান্ডকে বাঁচান তিনি। ৩৬তম মিনিটে আলভারেসের শট ফেরানো শেজনি ৩৯তম মিনিটে মেসির পেনাল্টি শট আটকে দেন।
৪৩ তম মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে শট নেন আলভারেস। তার শট পাঞ্চ করে ফেরান শেজনি, তবে পুরোপুরি বিপদমুক্ত করতে পারেননি। বল গিয়ে লাগে অপ্রস্তুত ডি পলের গায়ে, এবার বলের নিয়ন্ত্রণ নেন পোলিশ গোলরক্ষক। ৬১তম মিনিটে মেসির পাস থেকে বাঁ পাশ দিয়ে গিয়ে ক্রস করেন তাগলিয়াফিকো। বল পেয়ে শট নেন আলিস্টার, কিন্তু তার শট সহজেই নিয়ন্ত্রণে নেন শেজনি।
৭১তম মিনিটে অসাধারণ আক্রমণ সাজায় আর্জেন্টিনা। বাঁ প্রান্ত দিয়ে এগিয়ে গিয়ে ছোট বক্সে কাটব্যাক করেন তাগলিয়াফিকো। সেখান থেকে মেসির নেওয়া শট ফিরিয়ে দেন শেজনি। যোগ করা সময়ের দ্বিতীয় মিনিটে তাগলিয়াফিকোর চিপ-ইন ঝাঁপিয়ে ফেরান তিনি। এর বাইরেও আরও কিছু সেভ ছিল, সব মিলিয়ে মেসিদের সামনে রীতিমতো চীনের প্রাচীর তুলে দাঁড়িয়েছিলেন শেজনি।
অথচ পেশাদার ফুটবলার হয়ে ওঠার আগেই ঝরে যাচ্ছিলেন তিনি। দুই হাতের সেই চোট কাটিয়ে দুই বছরের মাথায় পোল্যান্ড অনূর্ধ্ব-২০ দলে জায়গা করে নেন শেজনি, খেলেন অনূর্ধ্ব-২১ দলেও। জাতীয় দলের অভিষেকের বছর ২০০৯ সালেই ইংলিশ ক্লাব আর্সেনালে পেশাদার ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু হয় তার। ইংলিশ ক্লাবটিতে আট বছর থাকেন তিনি। মাঝে ব্রেন্টফোর্ড ও রোমাতে তিন বছর খেলেন ধারে। ২০১৭ থেকে ইতালিয়ান জায়ান্ট জুভেন্টাসে খেলছেন এই গোলরক্ষক।
সংগ্রামের ক্যারিয়ারের বাবার কাছ থেকেই হয়তো বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন শেজনি। তার বাবা মাচেজ শেজনিও ছিলেন পেশাদার ফুটবলার, সেটাও ছেলের মতো গোলরক্ষক। পোল্যান্ডের বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে দীর্ঘ ১৯ বছর খেলা মাচেজ শেজনি পোল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন পাঁচ বছর। যদিও এই সময়ে বেশি ম্যাচ খেলা হয়নি তার, সাতটি আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোলপোস্ট সামলানোর দায়িত্ব পান তিনি।
বাবার দেখানো পথে হেঁটে হয়তো তাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পণ করেছিলেন ভয়চেক শেজনি। তাই তো তার ভেঙে যাওয়া দুই হাতই এখন পরাক্রমশালী, দুর্ভেদ্য। যদিও সে সময় পড়েছিলেন শেজনি। ভয়াবহ সেই চোটের বর্ণনায় তিনি বলেছেন, 'আমি জিমে স্কুয়াট করছিলাম। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলায় আমার হাতের এসে পরে ওয়েট (জিমের সরঞ্জাম), আমার দুটি হাতই ভেঙে যায়। ওটা কিছুটা উদ্ভট ছিল। তখন জিমে থাকা কয়েকজন আমার হাতের অবস্থা না বুঝে হাসি চাপার চেষ্টা করছিল। পরে তারা দেখেন আমার হাত সোজা নেই। এটা খুব কঠিন ছিল। সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন।'
'চার মাস আমি ফুটবল খেলতে পারিনি, ওই চোটের প্রভাব আমার পুরো জীবনে পড়েছে। স্বাভাবিক মানুষদের মতো আমি সব কাজ করতে পারি না। বেশ কিছু দিক দিয়ে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ি সে সময়। তবে আমি চোট কাটিয়ে উঠবো; তা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। চোট কাটিয়ে উঠে আমি একজন ভালো গোলরক্ষক হতে যাচ্ছি, এই বিশ্বাস আমাকে এগিয়ে নেয়।' যোগ করেন পোলিশদের গোলপোস্টের অতন্দ্র এই প্রহরী।