‘কানাডার’ বোনো মরক্কোর ইতিহাস গড়ার নায়ক
দলের খেলোয়াড়রা যখন প্রতিপক্ষের জাল খুঁজে নিতে ব্যর্থ, তখন সব দায়িত্ব এসে চাপলো কাঁধে। গ্রিক পুরাণের ইকারুসের ডানা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। টাইব্রেকারে স্পেনের নেওয়া শটটি পোস্টে লেগে ফিরে এলো। ফেরার শুরু এখান থেকেই, এরপর উড়ন্ত বলাকা হয়ে স্পেনের দুটি পেনাল্টি ফিরিয়ে দিলেন ইয়াসিন বোনো। তাতে ধরা দিলো স্বপ্নের জয়, প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠলো মরক্কো।
আফ্রিকার চতুর্থ দল হিসেবে বিশ্বকাপের শেষ আটে উঠেছে মরক্কো। আফ্রিকা-আরব অঞ্চলের ঐতিহাসিক এই জয়ের নায়ক গোলরক্ষক বোনো। তার হাত গলে জালে জড়ায়নি স্পেনের কোনো পেনাল্টি শট। কার্লোস সোলের, সার্জিও বুসকেটসরা যেদিকেই শট নিয়েছেন, সেদিকেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বোনো। তার বিশ্বস্ত হাতে আটকে গেছে স্পেনের শেষ আটে ওঠার স্বপ্ন।
বোনোর পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার ছোট নয়। ১২ বছর ধরে ফুটবলের প্রতিযোগিতার আঙিনায় তার বিচরণ। ফুটবলের খোঁজ রাখা অনেকেই জানেন, মরক্কোর এই গোলরক্ষক খেলেন স্প্যানিশ ক্লাব সেভিয়ার হয়ে। কিন্তু কাতারের এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচের পর অনেকে নন, সবাই জেনে গেছেন নামটি। তিনি এখন নায়ক, আফ্রিকার রাজা। যে কিনা বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত কোনো গোল হজম করেননি।
অথচ এই দেশটির হয়ে নাও খেলা হতে পারতো বোনোর। মরক্কান বাবা-মা হলেও তার জন্ম কানাডার মন্ট্রিয়ালে, পছন্দ ছিলো দেশ বেছে নেওয়ার। ১৯৯১ সালে জন্ম নেওয়া বোনো বড় হয়ে বেছে নেন মরক্কোকে। এর আগে ছোট্ট বয়সে বাবা-মায়ের সঙ্গে পাড়ি জমান আফ্রিকার দেশটিতে, ৮ বছর বয়সে যোগ দেন মরক্কোর ক্লাব ওয়াইদাদ কাসাব্লাঙ্কাতে।
১৯ বছর বয়স পর্যন্ত এই ক্লাবটির হয়ে খেলেন বোনো। ২০১০ সালে গিয়ে ক্লাবটির সিনিয়র দলে সুযোগ মেলে তার, খেলেন ১১টি ম্যাচ। এর মধ্যেই নিজেকে প্রতিশ্রুতিশীল হিসেবে প্রমাণ করেন ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার এই গোলরক্ষক। ২০১২ সালে ডাক আসে স্পেন থেকে, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের 'বি' দলে জায়গা হয় বোনোর।
স্প্যানিশ ক্লাবটির 'বি' দলের হয়ে দুই বছর খেলার পর ২০১৪ সালে বোনোর জায়গা হয় সিনিয়র দলে। তবে অ্যাটলেটিকোর সিনিয়র দলের হয়ে খেলার আগেই ঠিকানা বদলে যায় তার। ধারে বোনোকে দলে ভেড়ায় জারাগোজা। স্পেনের দ্বিতীয় স্তরের ক্লাবটির হয়ে দুই বছরে ৩৫টি ম্যাচ খেলেন তিনি।
২০১৬ সালে লা লিগার দল জিরোনা দলে নেয় বোনোকে। ক্লাবটির হয়ে চার বছর খেলার মাঝে এক বছর ধারে সেভিয়ার হয়ে খেলেন তিনি। ২০২০ সালে এসে বোনোকে কিনে নেয় সেভিয়া। এরপর গত তিন মৌসুম ধরে ক্লাবটির গোলপোস্টের অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি। ২০২০-২১ মৌসুমে প্রতিপক্ষের ১৫টি আক্রমণ রুখে দেন তিনি, গত মৌসুমে ১৩টি।
২০১৩ সাল থেকে মরক্কো জাতীয় দলে নিয়মিতভাবে খেলে আসা বোনো সেভিয়ার হয়ে সবচেয়ে বড় কাজটি করেন ২০২০ সালে। সেবার ইউরোপা লিগের সেমি-ফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ২-১ গোলে হারায় সেভিয়া। ওই ম্যাচে ৬টি অসাধারণ সেভ করে নায়ক বনে যান ৩১ বছর বয়সী এই গোলরক্ষক। ফাইনালে ইন্টার মিলানের বিপক্ষে সেভিয়ার ৩-২ গোলের জয়ে ২টি দারুণ সেভ করেন বোনো। এরপর তার সঙ্গে চার বছরের চুক্তি করে ক্লাবটি।
২০২০-২১ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ষোলোতে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে হারের ম্যাচেও দুটি দারুণ আক্রমণ রুখে দেন বোনো। পরের মৌসুমটি স্বপ্নের মতো কাটে তার। ২০২১-২২ মৌসুমে লা লিগার সেরা গোলরক্ষক জারোমা ট্রফি জেতেন মরোক্কান এই গোলরক্ষক। তাকে পুরস্কৃত করা পর রিয়াল মাদ্রিদের তারকা গোলরক্ষক থিবো কর্তোয়া বলেন, 'তাকে অভিনন্দন জানানো উচিত। সে দারুণ একজন বন্ধু এবং এটার যোগ্য দাবিদার।'
মরক্কোর হয়ে ৪৯টি ম্যাচ খেলা বোনো এবারের বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে দেয়াল তুলে দাঁড়িয়েছিলেন। তার হাত ফাঁকি দিয়ে বল জালে জড়াতে পারেননি লুকা মদ্রিচ, ইভান পেরিসিকরা। বেলজিয়ামের বিপক্ষেও তার খেলার কথা ছিল, কিন্তু ভালো বোধ না করায় এই ম্যাচ থেকে নিজেই সরে দাঁড়ান তিনি। ম্যাচটি মরক্কো জেতে ২-০ গোলে, গোলপোস্ট সামলান মুনির মোহান্দ মোহামেদি।
কানাডার বিপক্ষে ২-১ গোলের জয় পাওয়ার গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ দিয়ে দলে ফেরেন বোনো। এই ম্যাচেও কোনো গোল হজম করেননি তিনি, কানাডার পাওয়া গোলটি ছিল আত্মঘাতী। মরক্কোর সেন্টার-ব্যাকের গায়ে লেগে বল জড়ায় জালে। অর্থাৎ, এবারের বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিপক্ষ মরক্কোর জালে বল পাঠাতে পারেনি। যার নেপথ্য নায়ক বোনো। কিংবা বলা যায় কোনো গোল হজম করেননি বোনো। এমনকি সেটা পেনাল্টি শুট আউটেও নয়।
স্পেন-মরক্কোর মধ্যকার ম্যাচটি টাইব্রেকারে গড়ানোর আগে দুটি দারুণ সেভ করেন বোনো। ম্যাচ পেনাল্টি শুট আউটে যাওয়ার অন্যতম কারণ এটি। পেনাল্টি শুট আউটে তার রেকর্ড অবিশ্বাস্য। ক্যারিয়ারে ২৬ শতাংশ পেনাল্টি ফিরিয়েছেন বোনো। এখন পর্যন্ত ৫০টি পেনাল্টি শটের মুখে দাঁড়ানো দীর্ঘদেহী এই গোলরক্ষক ফিরিয়েছেন ১৩টি শট।