কিশোর পেলেকে যেদিন দেখলাম!
রেনাতো কারভালহোর বয়স ছিল তখন ১১, ঐ একবারই তিনি পেলের সাথে দেখা করেছিলেন।
১৯৫৮ সাল। কারভালহো পোকোস দে ক্যালডাস নামের এক ছোট্ট শহরের এক স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তিনি এবং তার বন্ধুরা অবাক হয়ে গেলেন যখন জানতে পারলেন, ব্রাজিল জাতীয় ফুটবল দল তাদের স্কুলের মাঠে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নেবে।
কারভালহো স্মরণ করে বলেন, "পেলে অনেক চিকন ছিলেন, তিনি তখন মাত্র ১৭ বছরের এক কিশোর। কিন্তু আমি এটা কখনোই ভুলব না।"
বৃহস্পতিবার ৮২ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন পেলে; সেই রোগা ১৭ বছর বয়সী হিসেবে ব্রাজিলকে সুইডেনে তাদের প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপা এনে দেওয়ার ৬৫ বছর পর। কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল এবং ফাইনালে ছয়টি গোল করার পর ব্রাজিলকে ১২ বছরে তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ এনে দেন পেলে। তিনিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি ইতিহাসে তিনটি বিশ্বকাপ জিতেছেন।
"পেলে ছিল ব্রাজিলের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাপন, পেলের কারণে ব্রাজিলকে আন্তর্জাতিক সংবাদের শিরোনামে ব্রাজিলকে দেখা যেত," বলেন ৭৬ বছর বয়সী কারভালহো, যিনি এখন একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী।
"এটি পেলেরই কাজ, যিনি তার শিল্প এবং ফুটবল দিয়ে, সারা বিশ্বে ব্রাজিলের নাম ছড়িয়ে দিয়েছেন।"
প্রাক্তন সান্তোস এবং নিউ ইয়র্ক কসমস তারকা বৃহস্পতিবার বিকাল ৩:২৭-এ টায় সাও পাওলোর আলবার্তো আইনস্টাইন হাসপাতালে মারা যান। এর কারণ হিসেবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে "একাধিক অঙ্গ কাজ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে তিনি মারা গিয়েছেন।"
এর আগে তার কোলনে একটি টিউমার ধরা পড়ে। এরপর এক বছরেরও বেশি সময় ধরে হাসপাতালে যাওয়া-আসার মধ্যে ছিলেন পেলে। কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই চিকিৎসায় সাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল তার শরীর।
ব্রাজিলীয় সরকার টুইট করেছে: "ফুটবলের রাজা বলতে গেলে তার দেশের সমার্থক শব্দ ছিলেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাকে মনে রাখবে মাঠের বাইরে একজন ভদ্রলোক এবং মাঠের ভেতরে একজন জাদুকর হিসেবে।"
ব্রাজিলের আসন্ন নতুন রাষ্ট্রপ্রধান লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন পেলে গ্যারিঞ্চা, সক্রেটিস এবং ম্যারাডোনার মতো ফুটবল গ্রেটদের সাথে স্বর্গে ফুটবল খেলতে যোগ দেবেন।
লুলা টুইটে আরও বলেন, "এখন পর্যন্ত খুব কম সংখ্যক ব্রাজিলীয়ই তার মতো আমাদের দেশের নাম উজ্জ্বল করতে পেরেছে। পুরো গ্রহের ভিন্ন ভাষাভাষীরা পর্তুগিজ ভাষা উচ্চারণ করতে না পারলেও, একটি জাদুর শব্দ উচ্চারণ করতে পারে: 'পেলে'।"
কারভালহো মনে করেন, পেলের দল, যে দল চারটি বিশ্বকাপের মধ্যে তিনটিই জিতে নিয়েছিল, সেই দলটি তাদের দেশকে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে তুলে ধরেছিল।
১৯৫৮ সালের আগে পৃথিবীর অনেকেই ব্রাজিল সম্পর্কে কিছুই জানত না। ১৯৭০ সালের পর এটি ফুটবলের দেশ হিসেবে স্থায়ীভাবে খ্যাতি পেয়ে যায়।
কারভালহো বলেন, "ব্রাজিল ১৯৫৮ দলটি ততটা গৌরব অর্জন করতে পারেনি, পরের দলগুলো যেভাবে করতে পেরেছিল। তখন কোনো টিভি ছিল না। আমরা একটি রেডিওতে খেলার ধারাভাষ্য শুনতাম, রাস্তার মোড়ে বাজানো হতো। পেলে কে বা তিনি কী হয়ে উঠবেন তা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না।"
কারভালহো তার স্কুলে ব্রাজিল জাতীয় দলের ট্রেনিংয়ের স্মৃতিচারণ করেন, "খেলোয়াড়রা পেনাল্টি শ্যুটের প্র্যাকটিস করতো আর আমরা গোলপোস্টের পেছনে দাঁড়াতাম। ম্যাজোলা নামে একজন খেলোয়াড় ছিলেন, খুব জোরে শট মারতেন। আমাদের ভয় দেখানো হয়েছিল যে, ম্যাজোলার শট যদি আপনার গায়ে লাগে তবে আপনি মারা যাবেন। তাই যখন সে বলটি শ্যুট করতে দৌড়ে আসতো আমরা সবাই মাটিতে শুয়ে পড়তাম, কারণ আমরা মারা পড়তে চাইনি।"
পেলে নম্র খেলোয়াড় হিসেবে বেশ পরিচিত ছিলেন এবং অনেকেরই তাকে নিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত গল্প রয়েছে। কিন্তু পেলের সময় অনেক আগে শেষ হয়েছে, ফুটবলও বদলে গেছে। পেলের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নামলেও অনেকেই মনে করেন যে তার কফিন দেখতে রাস্তায় লক্ষ লক্ষ লোক নামবে না, যেমনটি হয়েছে দিয়েগো ম্যারাডোনার ক্ষেত্রে দুই বছর আগে।
৪১ বছর বয়সী এক রিসেপশনিস্ট ডনি আলভেজ জানান, "যখন আয়ারটন সেনা (ব্রাজিলীয় কিংবদন্তী রেসিং ড্রাইভার) ১৯৯৪ সালে মারা যান তখন পুরো দেশ থমকে গিয়েছিল, পেলের ক্ষেত্রে সেটা হবে না। ফুটবল এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত যে মানুষ এটাকে আর বিশ্বাস করে না। তারা জাতীয় দলকে আগের মতো ভালোবাসে না। তারা ক্লান্ত।"
কারভালহোও এ ব্যাপারে সম্মত হন। "আমি মনে করি মানুষ পেলের মৃত্যুকে আরও স্বাভাবিকভাবে নেবে। পেলের সাফল্যের দিনগুলো অনেক আগেই চলে গেছে। লোকেরা জানে যে সে কে কিন্তু তারা তাকে অতটা ব্যক্তিগতভাবে চেনে না, তাই তার মৃত্যু আরও স্বাভাবিকভাবেই নেওয়া হবে।"
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান