মেসির এমন প্রস্থানই কি হওয়ার ছিল না?
বার্সেলোনা বলতে পারবে না তারা জানতো না কী আসতে যাচ্ছে।
বুরোফ্যাক্স-কাণ্ডের একবছরও পেরোয়নি। বিশ্বের সকল ফুটবল ভক্তকে অবাক করে দিয়ে সেই ঘোষণা দেয়ার পরও লিওনেল মেসি তার ছোটবেলার ক্লাবে থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও সর্বকালের সেরা ফুটবলারকে আরও একবার হাতছাড়া করলো বার্সা। এক বছরের মধ্যে মেসিকে দুইবার হারানোটা কোন দুর্ভাগ্য হতে পারে না, তা নিখাদ অব্যবস্থাপনা।
এটি নতুন করে বলার কোন অপেক্ষা রাখে না যে, মেসির কাছে বার্সেলোনা শুধু একটি ক্লাব না। এটি তার বাড়ি, তার ঠিকানা। বার্সার সাথে তার সম্পর্ক শুধু ব্যবসায়িক চুক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ না। গত আগস্টে যখন মেসি ক্লাব ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন তার বাচ্চারা কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিল। বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়েই তখন থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ওদিকে ম্যানচেস্টার সিটি ও পিএসজি বিশাল অঙ্কের চুক্তি নিয়ে তার সাক্ষরের অপেক্ষায় বসে ছিল। কিন্তু যখন সময় এসেছিল, তখন আর শেষ পর্যন্ত ক্লাবকে ছাড়তে পারেননি মেসি।
হয়তো এবারও তাই হবে। এই হতাশার মাঝেও বার্সেলোনা ভক্তরা নিশ্চিতভাবেই এই আশাটুকু পুষে রাখছেন মনে। গতকাল বার্সেলোনার দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দুই পক্ষের মধ্যে 'পূর্ণ সমঝোতা' হলেও লা লিগার আরোপিত আইনের জন্য মেসিকে রাখতে পারছে না তারা। হয়তো লা লিগা কর্তৃপক্ষকে চাপ দেয়ার জন্যই এই পথে হেঁটেছে বার্সা।
হয়তো না। এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। এবার বার্সা সরাসরি ঘোষণাই দিয়ে দিয়েছে, মেসি থাকছেন না, যা গতবার হয়নি। ঘোষণা দেয়ার পর পরই মেসির ক্যারিয়ারের ধারণকৃত মুহূর্তগুলো নিয়ে সাত মিনিটের একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে বার্সা। আজ ক্লাব সভাপতি হুয়ান লাপোর্তা জানিয়েছেন, মেসিকে ছাড়াই 'নতুন অধ্যায়' শুরু করতে যাচ্ছে তার ক্লাব।
লা লিগার উপর চাপ প্রয়োগের জন্য না কি বার্সেলোনা এবার আসলেই নিরুপায়, সেটা কয়েকদিনের মধ্যে জানতে পারবো আমরা। কিন্তু এই জগাখিচুড়ি পরিস্থিতিতে কীভাবে এসে পৌঁছালো কাতালান ক্লাবটি, তার পরিষ্কার কোন ব্যাখ্যা হয়তো তখনো দাঁড় করানো যাবে না।
বার্সেলোনা ভালোভাবেই জানতো মেসির চুক্তি শেষ হয়ে আসছে। গত গ্রীষ্মে পরিবারের চাপে মেসি থেকে যাওয়ার পর বার্সা ১০ মাস সময় পেয়েছে এই আর্জেন্টাইনকে নতুন চুক্তি দেওয়ার। কিন্তু চুক্তি নবায়ন করেনি তারা। আলোচনা পেছাতে পেছাতে এবছর জুন এসে গেলেও আলোর মুখ দেখেনি নতুন চুক্তি। বার্সেলোনা অবশ্যই জানতো, ফ্রি এজেন্ট হয়ে গেলে মেসিকে আবার নতুন খেলোয়াড় হিসেবে নিবন্ধিত করতে হবে তাদের। এবং ক্লাবের অর্থনৈতিক টানাপোড়নের জন্য আটকে যেতে পারে সেই নিবন্ধন।
তাহলে এতো বড় ঝুঁকি কেনো নিতে গেলো তারা? কারণ হতে পারে দুটি।
প্রথমত, তর্কসাপেক্ষে বার্সেলোনার ইতিহাসের সবচেয়ে ঝঞ্ঝাটপূর্ণ সময়টি ছিল গত এক বছর। এই সময়ে বোর্ডের দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা ও অযোগ্যতায় একদম তলানিতে এসে ঠেকেছিল ক্লাবের ভাবমূর্তি। করোনা মহামারির পাশাপাশি বিদায়ী প্রেসিডেন্টের প্রস্থান, নতুন প্রেসিডেন্টের আগমন ও মাঝখানে নির্বাচনী টালবাহানা মিলিয়ে এই সময়টায় একরকম অকার্যকর অবস্থাতেই ছিল বার্সেলোনা বোর্ড। হুয়ান লাপোর্তা দায়িত্ব পাওয়ার পর তিন মাস সময় পেয়েছিলেন। সেই সময়টাতে বোর্ড মূলত ব্যস্ত ছিল সুপার লিগ প্রকল্প নিয়ে।
হতে পারে, এতসব রাজনীতির ভিড়ে হয়তো হারিয়ে গিয়েছিল মেসির চুক্তির প্রসঙ্গ। এটা অনেক বড় বেখেয়ালিপনা হলেও, সাম্প্রতিক ইতিহাস বলছে, এরকম বেখেয়ালিপনা যদি কোন ক্লাব করতে পারে, সেটা বার্সাই।
দ্বিতীয় কারণটা কিছুটা কন্সপিরেসি থিউরির মতো শুনাবে।
এই ঘটনা কি হওয়ারই ছিল না? অর্থনৈতিকভাবে মেসিকে রাখার সামর্থ্যই তো হারিয়ে ফেলেছিল বার্সা। মেসিকে নতুন চুক্তি দিয়ে একটি পূর্ণ দল দাঁড় করানোটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। মেসিকে বিক্রি করার চিন্তা করলে, বা তাকে নতুন চুক্তি না দিতে চাইলে অকল্পনীয় রোষানলের মুখে পড়তে হতো বোর্ডকে। সুতরাং সেই চিন্তা বাদ। আর মেসিকে রাখতে হলে দলের প্রায় অর্ধেক ফুটবলারকেই বিক্রি করে দিতে হতো।
বোর্ড এখন যা করেছে, এতে কিন্তু খুশি থাকছে সবাই। অর্থনৈতিকভাবে, শেকল ভেঙে আবারও নতুন করে শুরু করার সুযোগ পাচ্ছে বার্সা। মেসি যোগ দিচ্ছেন ম্যান সিটি বা পিএসজিতে; যেখানে ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে এসে নিজেকে প্রমাণের যথেষ্ট সুযোগও পাবেন তিনি। আর ভক্তরা ক্লাব বা মেসি কাউকেই দোষারোপ করবে না। কারণ দোষ তো লা লিগার উপরই চাপানো হয়ে গেছে।
এই তত্ত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য উল্টো যুক্তিও দিতে পারেন আপনি। বার্সা মেসিকে ক্লাবে রাখার জন্যই তার বন্ধু সার্জিও আগুয়েরোকে দলে ভিড়িয়েছিল এই গ্রীষ্মে। মেসির সাথে সমঝোতা হওয়ার পর জাঁকজমকপূর্ণভাবে সেই ঘোষণা দেয়ার পরিকল্পনাও করছিল বার্সা।
তবে কারণ যাই হোক না কেনো, পরিণতি একই থাকছে।
অনেক বছর ধরেই ম্যাচের সময় ন্যু ক্যাম্প পর্যটকদের ভিড় বার্সাকে ভুগিয়ে চলেছে। যারা বেড়ানোর উদ্দেশ্যে মাঠে আসে তারা মাঠে এসে নীরব থাকে, দলকে ঠিকভাবে সমর্থন দেয় না। পাকা ভক্তদের মতো গলা ফাটিয়ে চেঁচায় না, পাকা ভক্তদের সাথে গানের সুরে তাল মিলায় না। পরিবেশ ঠিক রাখতে ক্লাব কর্তৃপক্ষ একসময় গ্যালারির এক পাশে একটি গানের বিভাগ খুলতে বাধ্য হয়েছিল।
এখন হয়তো সেই পর্যটক সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে বার্সা। কারণ যারা ন্যু ক্যাম্পে ঘুরতে আসতো, তাদের প্রায় সবাই মেসিকে দেখার জন্যই কাতালুনিয়ায় পা রাখতো। এবং মেসি তাদের কখনো হতাশ করতো না বলেই এই পর্যটকের ভিড় কখনো শেষ হতো না।
জাদুকরের খেলা দেখার পূর্ণাঙ্গ স্বাদ নিতেই হয়তো পর্যটকরা মাঠে নীরব থাকতো। সেই নীরবতা নিয়ে এখন আর ভাবতে হবে বার্সেলোনার। অন্যরকম এক নীরবতা এখন গ্রাস করবে কাতালান ক্লাবটিকে। সেই নীরবতা থেকে মুক্তি পায় কি না ক্লাবটি, তা-ই এখন দেখার বিষয়। যেভাবেই দেখা হোক না কেন, মেসির প্রস্থানের জন্য দিনশেষে নিজেদেরকেই কাঠগড়ায় রাখতে হবে বার্সার।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।
- অনুবাদ: কিরো আদনান আহমেদ।