আধুনিক ফুটবলের সর্বশ্রেষ্ঠ দলের অভাবনীয় অধঃপতন!
১০ বছর আগের বার্সেলোনা ছিল আধুনিক ফুটবলের সর্বশ্রেষ্ঠ দল। সেক্সটুপল জেতা পেপ গার্দিওলার সেই দল ইউরোপীয় ফুটবলকেই বদলে দিয়েছিল। ২০১১ সালের বার্সেলোনাকে দেখে কিংবদন্তি স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনও বলেছিলেন, এরকম শক্তিশালী দল তিনি কখনো দেখেননি।
কিন্তু আসছে ফেব্রুয়ারিতে ইউরোপা লিগে খেলতে নামবে তারা। ন্যাপোলির বিপক্ষে দুই লেগের ম্যাচে জিততে না পারলে ইউরোপের দ্বিতীয় সারির এই টুর্নামেন্ট থেকেও ছিটকে যাবে দলটি।
বার্সেলোনার মতো এরকম অধঃপতন খেলাধুলার ইতিহাসেই বিরল। এ মাসে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে ০-৩ গোলে হারা বার্সেলোনা বর্তমানে এক অন্তঃসারশূন্য ক্লাব। বায়ার্ন এবারও চাইলে ৮-২ করতে পারতো স্কোরলাইন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বের ম্যাচটিতে ট্রেনিংসুলভ দৌড়েই বার্সাকে কেটে-ছিঁড়ে যাচ্ছিলেন লেভা-সানেরা।
এবছরের বার্সেলোনা অন্তঃসারশূন্য ক্লাবের সবচেয়ে যথাযথ উদাহরণ। যেন মাঠের ভিতরে ও বাইরে দু জায়গাতেই সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে কাতালান ক্লাবটি।
বার্সেলোনা ভক্তদের হয়তো মানতে কষ্ট হবে। কিন্তু যে বিষয়গুলোর বদৌলতে তারা একসময় গ্রেট ক্লাবে পরিণত হয়েছিল, সেগুলোর অস্তিত্ব এখনও রয়েছে। তবে তাদের নিজেদের শিবিরে নয়, ইউরোপের অন্যান্য বড় ক্লাবগুলোর দখলে!
ম্যানচেস্টার সিটি বা পিএসজির দিকে তাকাতে পারেন। এক অর্থে এই দুই ক্লাবকে এখনও সফল বলা যাবে না। কেননা, বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ ঢালার পরও এখন পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপায় হাত রাখতে পারেনি তারা। তবে সেই অধরা শিরোপার কাছাকাছি চলে এসেছে দু দলই। সর্বশেষ দুই আসরে রানার হয়েছে তারাই। হয়তো খুব দ্রুতই এদের মধ্যে একটি ক্লাবের হাতে উঠবে শিরোপা।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, যেসব দর্শন ও লোকজনের জন্য তারা আজ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের স্বপ্ন দেখতে পারছে সেগুলো এসেছে বার্সেলোনা থেকেই।
২০০৮ সালে বোর্ডের ঝামেলার জন্য পদত্যাগ করেন বার্সার তৎকালীন অর্থনৈতিক সহ-সভাপতি ফেরান সোরিয়ানো। দুই বছর পর হুয়ান লাপোর্তার সঙ্গে পদত্যাগ করেন তৎকালীন ডিরেক্টর অব ফুটবল চিকি বেগিরিস্তাইন।
বার্সেলোনার এই ফুটবল মস্তিষ্ক গিয়ে পাড়ি জমান ম্যানচেস্টার সিটিতে।
সিটির অবস্থা সেসময় বলতে গেলে একটি ফাঁকা ক্যানভাসের মতোই। যে কারণে সোরিয়ানো ও বেগিরিস্তাইনের হাতে সুযোগ ছিল নিজেদের 'বার্সেলোনা' দর্শনে ক্লাবটিকে আগাগোড়া সাজানোর। আর সিটিও চাইছিল বার্সার ফর্মুলা ব্যবহার করে তাদের ক্লাবকে গোছাতে।
পরের কয়েক বছরে বার্সার কার্যনির্বাহী ও অন্যান্য পদের একাধিক ব্যক্তিকে ম্যানচেস্টারে ভিড়িয়েছেন এই দুজন। এই নিয়োগগুলোর পিছনে তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল যদিও ডাগআউটে একজনকে আকর্ষিত করা।
২০১৬ সালে আসে সেই কাঙ্ক্ষিত নিয়োগ। বায়ার্ন মিউনিখ ছেড়ে সিটিতে যোগ দেন পেপ গার্দিওলা। সাথে আনেন বার্সেলোনা থেকে তার সঙ্গী সব ব্যাকরুম স্টাফদের। ম্যানচেস্টারে মানিয়ে নিতে এক মৌসুম সময় নিলেও দ্বিতীয় মৌসুম থেকেই তারা সিটিকে তাদের বার্সেলোনা দলের মতোই আকর্ষণীয় ও ফলপ্রসূ ফুটবল খেলাতে শুরু করেন।
২০১৭-১৮ মৌসুমে ইংলিশ ফুটবলে নতুন রেকর্ড স্থাপন করে সিটি। সে মৌসুমে আগুয়েরোদের ১০০ পয়েন্ট ও ১০৬ গোল এখনও প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। পরের মৌসুমে (২০১৮-১৯) আবারও লিগ জিতে গার্দিওলা বাহিনী। জিতে নেয় চারটি ঘরোয়া শিরোপাই। ২০১৯-২০ মৌসুমে লিগে দ্বিতীয় হওয়ার পর এবছর আবারও লিগ শিরোপার দখল নিয়েছে সিটি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এখনও তেমন সাফল্য ধরা না দিলেও সার্বিকভাবে গার্দিওলার অধীনস্থ সিটি গত পাঁচ বছরে ইউরোপিয়ান দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ধারাবাহিক ও মানসম্মত ফুটবল উপহার দিয়েছে।
সিটির এ সাফল্য বার্সেলোনা শুধু দূর থেকে দেখতে পেরেছে। ন্যু ক্যাম্প থেকে প্রথমে কার্যনির্বাহী, তারপর কোচ, তারপর ফুটবল; সবকিছুই আখড়া গড়েছে ম্যানচেস্টারে। এবং সফলও হয়েছে।
সিটির মতো পিএসজি এরকম মাঠের বাইরের ব্যক্তিগুলোকে ধরে আনতে পারেনি। পেট্রোলিয়াম-সমৃদ্ধ কাতার ফরাসি ক্লাবটির মালিকানা দখল করে ২০১১ সালে। ততদিনে সোরিয়ানো ও বেগিরিস্তাইন ইতিহাদে জায়গা করে নিয়েছেন। কার্যনির্বাহী পদের লোকজন ও কোচরা যেহেতু সিটিতেই পাড়ি জমিয়ে ফেলেছেন, তখন পিএসজির হাতে তাই কেনার মতো একটি বস্তুই ছিল, মাঠের খেলোয়াড়েরা।
এছাড়া ক্লাবের গঠন বা দর্শনের চেয়ে পিএসজি সবসময়ই তারকা খেলোয়াড়দের উপরই বেশি জোর দিয়ে এসেছে। তাদের আধুনিক যুগের প্রথম দিকে জলাতান ইব্রাহিমোভিচ, ডেভিড বেকহাম, এডিনসন কাভানি এবং আনহেল ডি মারিয়ার মতো তারকাদের প্যারিসে ভিড়িয়েছে তারা।
কিন্তু এদের কোনোটাই নেইমারের মতো বড় দলবদল ছিল না। ২০১৭ সালে বিশ্ব রেকর্ড ২২২ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে এই ব্রাজিলিয়ানকে দলে ভেড়ায় পিএসজি। ন্যু ক্যাম্পে সেই বিখ্যাত ৬-১ গোলের ধবল-ধোলাইয়ের চার মাসের মাথায় এই দলবদল করে ফরাসি ক্লাবটি, 'এমএসএন'কে ভেঙে দিয়ে তারা কেড়ে নেয় এই বিখ্যাত ত্রয়ীর সর্বকনিষ্ঠ জনকে।
নেইমারের দলবদলের পরই শুরু হয় বার্সার পথ হারানো। এই ব্রাজিলিয়ানের শূন্যস্থান পূরণ করতে গিয়ে একের পর এক উল্টা-পাল্টা দলবদল করতে আরম্ভ করে কাতালানরা। বড় বড় চুক্তি দিতে শুরু করে বয়স্ক খেলোয়াড়দের।
এসব অপটু দলবদল ও বিশাল বিশাল চুক্তি একসময় ক্লাবের অর্থনৈতিক কাঠামোকেই ভেঙে দেয়। ক্লাবের সম্মিলিত মূল্যের চেয়ে বেড়ে যায় তাদের ঋণ।
আর এ কারণেই গত গ্রীষ্মে লিওনেল মেসিকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় বার্সা। অশ্রুসিক্ত মেসি যোগ দেন সেই পিএসজিতেই।
খেলোয়াড় হিসেবে মেসির উন্মোচনের দিন প্যারিসকে দেখে মনে হচ্ছিল বিশাল বড় সামরিক বিজয় উদযাপন করতে রাস্তায় নেমে এসেছে পুরো শহর। আর মেসিকে দেখে তখন আর কোনো বেতনভুক্ত কর্মচারী মনে হয়নি, মনে হয়েছে যুদ্ধজয়ের পুরস্কারই তিনি।
একসময় বার্সেলোনাকে দেখা হতো ফুটবল বিশ্বের কেন্দ্র হিসেবে। যে কারণে তাদের দর্শন ও প্রতিভাদের নিয়ে এতো আগ্রহ ছিল সবার। এখন তারা এক পতিত সাম্রাজ্য। তাদের সকল বিশেষত্বকে কেড়ে নিয়েছে ধনী ও শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীরা।
বার্সেলোনায় কী বাকি থাকল তাহলে?
একটি স্টেডিয়াম। জাদুঘরে থাকা ট্রফি ক্যাবিনেট। এবং জার্সির লাল-নীল রং।
হয়তো ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে থাকা এই ক্লাবকে পথপ্রদর্শন করাবেন জাভি। তারুণ্যে ঘেরা দলটিকে গার্দিওলার দর্শনে গড়ে তোলার এমন সুযোগ আর কেউই পাবেন না। তবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দশ ম্যাচের মধ্যে মাত্র তিনটিতে জয়ের দেখা পাওয়া জাভির জন্যও যে কাজটি সহজ হবে না, সে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে ভালোভাবেই।
ইউরোপা লিগে নেমে যাওয়া ও অর্ধ মৌসুমেই লিগ টেবিলে রিয়ালের চেয়ে ১৫ পয়েন্টে পিছিয়ে থাকা বার্সেলোনাকে দেখে আধুনিক ফুটবলের ধরণ সম্বন্ধে একটি পরিষ্কার ধারণা পেতে পারেন।
হ্যাঁ, বড় দলগুলো সবসময়ই একে অপরের সাথে লড়াই করবে। আমরা জানি, যদি একটি দল কোনো আকর্ষণীয় দর্শন নিয়ে হাজির হয়, তাহলে তাদেরকে কপি করা হবে। কিন্তু গত ১০ বছরে ধনী ক্লাবগুলো যেভাবে বার্সাকে যেভাবে অপদস্থ করে তাদের ধারণাগুলো চুরি করেছে, সেটা দেখে আপনাকে বলতেই হবে- স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।
কোনো যুগান্তকারী দর্শনকে একবার ফলপ্রসূভাবে প্রয়োগ করেই থেমে গেলে চলবে না, সেই দর্শনকে আকরে ধরে সামনে এগুতে হবে আপনাকে।
সূত্র: দ্য অ্যাথলেটিক।
অনুবাদ: কিরো আদনান আহমেদ।