ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কিভাবে?
প্রাণঘাতী হয়ে ওঠা ডেঙ্গু যা গতকয়েকদিনে দেশজুড়ে ১১টি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, হাইকোর্টের নির্দেশের পর এই রোগের বাহক এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে কি পদক্ষেপ নিতে পারে সিটি কর্পোরেশনগুলো?
প্রথাগতভাবে তারা যে পদ্ধতি ব্যবহার করছে তা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট নয়। পরিবেশের ক্ষতি করে কীটনাশক ছিটানো সত্ত্বেও মশার নিয়ন্ত্রণ না হওয়ায় এ পদ্ধতির অকার্যকারিতা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে।
তবে বিশ্বজুড়ে বহু উদ্বাবনী, কার্যকরী এবং অপেক্ষাকৃত সস্তা পদ্ধতি রয়েছে যার মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
এরমধ্যে একটি পদ্ধতিতে মশার ডিম্বাণুতে একধরণের বিশেষ ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করিয়ে ‘ভালো মশা’ দ্বারা সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয়া হয়। যার ফলে ধ্বংস হয়ে যায় ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ জন মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। শুধু জুলাই মাসের ১৪দিনে সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ১৬৪ জন। রোগীর সংখ্যা বাড়লেও ডেঙ্গু প্রতিরোধে শুধু মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।
যদিও বছর দেড়েক আগেই গবেষণায় উঠে এসেছে অকার্যকর হয়ে পড়ছে মশার ওষুধ। ওষুধে মরছেনা মশা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মশাবাহিত রোগে সারাবিশ্বে বছরে প্রাণ হারায় ৭ লাখ ২৫ হাজার মানুষ। বছরের পর বছর ধরে পৃথিবীর অন্যতম বিপদজনক প্রানী মশা। এরমধ্যে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারাবিশ্বে ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
বাংলাদেশেও বাড়ছে মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব। তবে অন্যান্য দেশ মশা নিধনে বিভিন্ন ধরণের পদ্ধতি গ্রহণ করলেও বাংলাদেশে তা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
‘ভালো মশা’ দিয়ে মশা মারা
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ওয়াল্ড মসকিউটো প্রোগ্রাম’ নামে একটি কর্মসূচীর মাধ্যমে ২০১৪ সাল থেকে ‘ভালো মশা’ দিয়ে মশা মারার একটি উদ্যোগ শুরু করেছে।
২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার টাউন্সভিলি শহরে ভালো মশা ছেড়ে দেয়। এ কর্মসূচীর সময় দেখা যায়, শহরে বসবাস করা নাগরিকদের মধ্যে যারা ঐ সময়ে শহরের বাইরে অন্য কোথাও যাননি তাদের মধ্যে মাত্র চারজনের ডেঙ্গু ধরা পড়ে। কর্মসূচী শুরুর আগে এ সংখ্যাটি ছিলে ৫৪।
ভালো মশা হলো –ওলবাছিয়া নামের এক ধরণের সংক্রমিত ব্যাকটেরিয়া। যা মানুষ বা কোন মেরুদণ্ডী প্রাণীর জন্য ঝুঁকিমুক্ত। এটি প্রাকৃতিকভাবে এডিস মশা প্রতিরোধী না। বিজ্ঞানীরা এটি মশার ডিম্বানুতে প্রবেশ করান। এটি কোন ধরণের জেনেটিক মেডিফিকেশন নয়।
ত্রুটিযুক্ত ডিম্বানুতে যখন মশা জন্মায়, তারা নিজেদেরও সংক্রমিত করে। তাদের ডিম্বানুও সংক্রমিত হয়।
অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, কলম্বিয়া এবং শ্রীলংকা সহ ১২ টি দেশের সরকার মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে এই কর্মসূচি চালাচ্ছে। এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এর সুফল পেয়েছে।
ডব্লিউএইচও বলছে, মশার সংখ্যা কমাতে Wolbachia-infected Aedes aegypti একটি নতুন কার্যকরী পদ্ধতি।
তবে বাংলাদেশে এ ধরণের পদ্ধতি নেই।
গাপ্পী মাছ দিয়ে মশা মারা
গাপ্পী মাছ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের একটি কার্যকর পদ্ধতি। এই ক্ষুদ্র মাছগুলো ঘরের মধ্যে এবং ঘরের আশেপাশের পানির মধ্যে স্থাপন করা যেতে পারে, যেখানে তারা এডিস মশার লার্ভা খেতে পারে। ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ায় গাপ্পী মাছ দিয়ে মশা মারার কর্মসূচী রয়েছে।
কম্বোডিয়ার দুটি জেলায় ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত গাপ্পী মাছ ছাড়ার একটি কর্মসূচি চালু করা হয়। এতে দেখা যায় পানিতে মশার লার্ভার পরিমান একদম কমে গেছে।
এডিবির স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞর মতে, গাপ্পী মাছ ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য কম খরচের ও নিরাপদ পদ্ধতি অংশ নিয়ে পারে পুরো কমিউনিটি।
তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “এডিস মশা পরিস্কার পানিতে জন্মায় বলে সেখানে গাপ্পী মাছ কার্যকরী নয়। গাপ্পী মাছ ময়লা পানির মশা মারতে সহায়ক। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে গাপ্পী মাছ ছাড়ার কোন কর্মসূচী নেই।”
তিনি বলেন, “ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশার ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করতে কাজ করা হচ্ছে। বিনামূল্যে ওষুধ দেয়া হয়। এছাড়া শিগগিরই সিটি করপোরেশনের কর্মীরা বাসা-বাড়িতে গিয়ে এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করবে।”
ডেঙ্গু প্রতিরোধে ভ্যাকসিন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার কমপক্ষে ২৫ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন মানবদেহে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয়। এর বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া হয় ৯ থেকে ৪৫ বছর। আন্তর্জাতিক ওষুধ উদ্ভাবক ও প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান স্যানোফি পাস্তুর ওই ভ্যাকসিন প্রস্তুত করে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ডেঙ্গভেক্সিয়া (Dengvaxia)|
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের আগে প্রথমবারের মতো ২০১৫ সালে মেক্সিকোতে এই ভ্যাকসিন বাজারে ছাড়ে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। একই বছর ফিলিপাইন ও ব্রাজিলে ভ্যাকসিন চালু করা হয়। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, এল সালভাদর, কোস্টারিকা, গুয়াতেমালা, পেরু ও প্যারাগুয়েসহ বিশ্বের ২০টি দেশে এই ভ্যাকসিন চালু আছে।
অন্যদিকে সিডিসি আটলান্টার তথ্য অনুসারে চলতি বছরের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রে এই ভ্যাকসিন চালুর অনুমোদন দেয় এফডিএ (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) । তবে এ ক্ষেত্রে বয়সসীমা ঠিক করে দেয়া হয় ৯-১৬ বছর। এদিকে বাংলাদেশ সরকারের রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) সিডিসি আটলান্টার এফিলিয়েটেড প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরও এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি নেই।
আইইডিসিআর এর পরিচালক অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনেই অনেক দেশে ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন চালু করা হয়েছে। তবে এই ভ্যাকসিন অনেকটা স্পর্শকাতর। আমাদের দেশে এই ভ্যাকসিন চালুর ব্যাপারে অনেকটা অগ্রগতি হয়েছিল। একটি কোম্পানি দেশে এই ভ্যাকসিন আনার ব্যাপারে সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কাছে আবেদনও করেছিল। কিন্তু সেখানে খুব একটা সাড়া মেলেনি। ফলে আপাতত বিষয়টি থেমে আছে।
ধরণ বদলেছে ডেঙ্গুর
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে তিন দিন ধরে রাজধানীর পান্থপথের একটি বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্বপ্না রায় (৩৫)। তার রক্তের প্লাটিলেট কখনো কমছে আবার কখনো বাড়ছে। তবে চিকিৎসকেরা সবচেয়ে বেশি চিন্তিত রক্তচাপ ক্রমশ কমে যাওয়া নিয়ে। তাই জ্বর কমলেও রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে স্বপ্না রায়কে ২৪ ঘণ্টা স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। আরো দুইদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর জানা যাবে স্বপ্না রায় ঝুঁকিমুক্ত কিনা। স্টেজ ৩ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত স্বপ্না রায়। স্বপ্না রায়ের মত এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে ৯৩৮ জন।
এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। তবে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় ডেঙ্গুর ধরণ বদলে যাওয়ায়। চিকিৎসকেরা জানান, এ বছর স্টেজ ৩ ডেঙ্গু সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইনফরমেশন অ্যান্ড ইমার্জন্সি কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুসারে, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ১২৪ জন। জুলাই মাসের ১৪ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ১৬৪ জন। গত বছর পুরো জুলাই মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ছিলো ৯৪৬ জন।
জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ২৪৭ জন চিকিৎসা নিয়েছে। এর মধ্যে চিকিৎসা শেষে বাড়ি গেছে ৩ হাজার ৩৩৬ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছে ৩ জন। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর তুলনায় অনেক বেশি বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা।
চিকিৎসকেরা জানান, এবার স্টেজ ৩ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি। স্টেজ ৩ ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। এতে করে রোগীর রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়ার পাশাপাশি রক্তচাপ দ্রুত কমে যায়।
প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, গত বছর থেকে ডেঙ্গুর প্যাটার্ন বদলে গেছে। তবে এবার বদলে যাওয়া ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। সাধারণত ১০৪-১০৫ ডিগ্রি জ্বরে শক ডিনড্রোম দেখা দিতো। কিন্তু এবার ১০১-১০২ জ্বর এবং শরীরে কোন ধরণের ব্যথা না হলেও শক সিনড্রোম দেখা যাচ্ছে। এতে রোগীর রক্তচাপ কমে যায়, শরীরে পানিশূণ্যতা বেড়ে যায়, পেটে, ফুসফুসে পানি জমে, রোগী জ্ঞান হারায়।
রোগ হয়ে যাওয়ার পরা রোগীকে পানি খাওয়াতে হবে। জ্বর এক দুই দিন হলেই চিকিৎসকেরা শরণাপন্ন হতে হবে।