করোনার নয়া প্রভাব: ভয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে মানসিক অবসাদ
গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। বসন্তের পরপর যখন এ ভাইরাস বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে,তখন মানুষের ভেতর এক প্রকার বিচ্ছিনতার একাত্মতাবোধ গড়ে ওঠে। সিয়াটল হোক বা রোম-লন্ডন সবর্ত্র মানুষ নিজেদের আইসোলেশনে আবদ্ধ করে ফেলে রক্ষা করতে চেয়েছে; বিয়ের মত আয়োজনও স্থগিত ঘোষনা করেছে। মানুষের ভেতরে একটা ধারণা ছিল যে, অচিরেই এই বন্দীদশা তারা কাটিয়ে উঠবেন এবং শীঘ্রই ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হবে।
দুর্ভাগ্য যে, বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। করোনা মহামারী পরিস্থিতি এখন আগের চাইতেও ব্যাপক উদ্বেগের বিষয় হয়ে গেছে। বর্তমানে বেশিরভাগ সংক্রমণ ঘটছে সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রতি অসচেতন এবং উদাসীন মানুষের মাধ্যমে।
করোনায় সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । শুক্রবারে দেশটিতে করোনা রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়েছে আশি লাখের ওপরে এবং একদিনে নতুন সংক্রমণ ধরা পড়েছে সত্তর হাজার, যা জুলাইয়ের পর সর্বোচ্চ সংক্রমণের রেকর্ড।
শুধু কী যুক্তরাষ্ট্র! ইউরোপেও করোনা শনাক্তের সংখ্যা থেমে নেই; যুক্তরাজ্যে করোনা প্রাদুর্ভাবের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে কঠোর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা আরোপের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে; ফ্রান্সের শহরগুলোতে পানশালা, ব্যায়ামাগার, খেলাকেন্দ্র প্রভৃতি বন্ধের মাধ্যমে 'সর্বোচ্চ সতর্কতা' জারি করা হয়েছে।
জার্মানি এবং ইতালিও শনাক্তের সংখ্যায় ছাড়িয়ে গেছে আগের রেকর্ড। চেক প্রজাতন্ত্রের নীতিনির্ধারকেরা ইতিমধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, তাদের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা করোনার আক্রমণে ভেঙে পড়তে চলেছে। হাসপাতালগুলো উপচে উঠেছে নতুন সংক্রমিত রোগীতে; মৃত্যুর হারও মহামারীর পূর্বেকার যেকোন সময়ের চাইতে অধিক।
যে আশা এবং রোগ নিরাময়ের ভরসা মানুষকে করোনাভাইরাস আক্রমণের প্রথম তীব্রতাকে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল, সেখানে এখন ক্লান্তি এবং হতাশা এসে জমেছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে একদিকে যেভাবে করোনা সংক্রমণ নতুন গতিতে উত্থিত হচ্ছে, বিপরীতক্রমে মানুষের ভেতর বেড়ে চলেছে উদাসীনতা এবং সচেতনতাবোধের অভাব।
এ ক্রমবর্ধমান ধৈর্যচ্যুতি এবং সংক্রমণের প্রবর্ধনের যুগপৎ অথচ বিপজ্জনক সংমিশ্রণকে স্বাস্থ্য বিশ্লেষকেরা নতুন একটি 'চ্যালেঞ্জ' হিসেবে ভাবছেন যা আসন্ন সময়কে আরো বেশি 'শোকাবহ' করে তুলতে অবদান রাখবে।
সংখ্যাতাত্ত্বিক দিক থেকে অন্যান্য দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে অধিকতর মন্দ অবস্থায় না থাকলেও খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অনুমান করছে, পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই 'মহামারী অবসাদ বা হতাশা' নতুন একটা সংকটের বার্তাই উপস্থাপন করতে যাচ্ছে।
ডব্লিউএইচও'র ইউরোপ কার্যালয়ের আঞ্চলিক পরিচালক ড. হান্স ক্লোগ বলেন, "মানুষ এতদিনে ত্যাগ কিছু কম করেনি। সবাই মিলে এই ভাইরাস নিয়ে যতটা ভেবেছে, এর পেছনে যত শ্রম দিয়েছে, তাতে এখন আমরা পৃথিবীর যে প্রান্তেরই বাসিন্দা হইনা কেন, ক্লান্তি এসে ভর করাটাই স্বাভাবিক।"
করোনা ছড়িয়ে পড়াকালীন সেই বসন্তকে যদি ভয়ের সাথে তুলনা করা হয় তবে আসন্ন শরতে ভাইরাসের ভয়াবহতাকে অগ্রাহ্যতার চূড়ান্ত রূপ মানুষ প্রত্যক্ষ করবে! পশ্চিমা দেশগুলোতে করোনা আতঙ্কে যারা ক্ষণিকের জন্য বাড়ির বাইরে বেরোবার কথা ভাবতে পারতেন না, সেই তাদের অনেকেই এখন শীত পুরোপুরি জেঁকে বসার আগেই বাইরে দিব্যি নানান সামাজিকতায় অংশগ্রহণ করে চলেছেন। সেখানকার ফুটপাতগুলো ইস্টারের সময় স্বাস্থ্য সচেতনতাপূর্ণ যেসব বার্তা ও পোস্টার দিয়ে অলংকৃত ছিল, হ্যালোউইন আসার আগেই সেসবের লেশমাত্র যে থাকবেনা তা অনুমান করা শক্ত নয়।
"বসন্তে এটি ছিল পুরোপুরি ভয়ের অনুভূতি", "আর আমরা সবাই এ মহামারীতে একত্রে আছি, এ পর্যন্তই ভাবনার দৌড় ছিল তখন", বলেন আমেরিকান সাইকোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশনের মনোবিজ্ঞানী ভাইয়েল রাইট।
"কিন্তু এখন পরিস্থিত ভিন্ন। আগের সেই ভয়ের অনুভূতি এখন অকেজো। উলটো তার জায়গা নিয়েছে এসে শ্রান্তি আর অবসাদ"।
বিশ্বের কিছু দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণের কঠোর প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ এবং কার্যকর হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, এমনকি চীন যেখান থেকে এই ভাইরাসের উত্থান – সেখানেও সংক্রমণের মাত্রা কয়েক মাস ধরে তুলনামূলকভাবে কম। চীনা শহর কিন্দাওতে নতুন করে এক ডজন করোনা রোগী শনাক্ত হবার পরে কর্তৃপক্ষ সে শহরের ৯.৫ মিলিয়ন বাসিন্দার করোনা শনাক্তকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
মাঝের কিছু সময় ভাইরাসটির প্রকোপ অনেকটাই কমে আসে এবং মৃত্যুর হারেও লক্ষনীয় হ্রাস প্রকাশ পায়। এখন আবার নতুন করে সংক্রমণের হার জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের চিন্তার উদ্রেক করছে। এক যুক্তরাষ্ট্রেই করোনায় সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন ২ লাখ ১৮ হাজারের ওপর মানুষ।
মানুষের ভেতর মাসের পর মাস কোয়ারেন্টিনে থেকে যে হতাশার জন্ম হয়েছে বলা যায়, তার একপ্রকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াই দেখা যাচ্ছে সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের করোনা পরিস্থিতির ওপর। দক্ষিণ এবং মধ্য-আটলান্টিক অঞ্চলে নতুন 'হট স্পট' তৈরী হচ্ছে যা ক্রমশ পশ্চিমে প্রসারিত হচ্ছে। ইলিনয়ের মত অঙ্গরাজ্যগুলোতে নতুন করে রেকর্ডসংখ্যক দৈনিক মৃত্যুর হিসাব কষা হচ্ছে।
জার্মানিতে গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে ৭,৩৩৪ জনের সংক্রমণ রেকর্ড করা হয়েছে যা একেবারে নতুন জাতীয় রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। করোনার তীব্রতায় ইতালি সমগ্র ইউরোপের ভেতর একেবারে মাত্রাজ্ঞানহীন লকডাউন স্থাপন করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল; এবার নতুন সংক্রমণের তোড়ে আবারো রাত ১০টার পর থেকে কারফিউ ঘোষণা করেছে দেশটি।
ভাইরাস এখন ছড়াচ্ছে শহুরে ও গ্রামীন উভয় সম্প্রদায়ের মাধ্যমে। গুচ্ছ সংক্রমণ এড়াতে অন্যান্য নগরের মত শিকাগোতেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টানা ছয় সপ্তাহ বন্ধ রাখা হয়; পরবর্তীতে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভাইরাস ছড়ানোর দায় গিয়ে পড়ে ওয়াশিংটনের স্পা সেন্টার, ভারমন্টের হকি লীগ, নর্থ ক্যারোলাইনার ব্যাপ্টিস্ট চার্চ থেকে শুরু করে লং আইল্যান্ডের এক 'সুইট ১৬' পার্টির ঘাড়েও। নতুন করোনা আক্রান্তদের মুখেও এই গুচ্ছ সংক্রমণের প্রতিধ্বনি- স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পর্যায়ে 'কনট্যাক্ট ট্রেসার'দের সংস্পর্শে এসে ভাইরাস আক্রান্ত হয়েছেন, এমন দাবী তাদের।
যাতায়াত বা মেলামেশার সুযোগের সীমাবদ্ধতার জন্য আগে কোথা থেকে সংক্রমণ ঘটেছিল তা নির্ণয় করা কঠিন ছিল না।এখন বলাই বাহুল্য এ প্রক্রিয়া অনেক জটিল হয়ে গেছে। রোগী বলতেই পারছেনা ঠিক কার মাধ্যমে বা কোন স্থান হতে সে সংক্রমিত হয়েছে। ফলে নেয়া যাচ্ছে না কোনরূপ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও।
ফলস্বরূপ, সাধারণ মানুষের মত পশ্চিমা ডাক্তারেরাও এখন চাইছেন ২০২০ এর শীঘ্র সমাপ্তি!
করোনা শুরুর দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের চল্লিশোর্ধ শ্যানা গ্রুম তাঁর প্রতিবেশীদের মাঝে ইতিবাচকতা ও আনন্দ ছড়ানোর প্রচেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন, পেশাগত জীবনে যিনি একজন সেবিকা। প্রতিবেশী শিশুদের মন আনন্দে উদ্বেলিত করতে তিনি তাঁর জানালার পাশে করোনা লকডাউনের পুরোটা সময় একটি টেডি বিয়ার সাজিয়ে রেখেছিলেন। সবুজাভ মাস্ক পরিহিত ক্ষুদ্র এই খেলনাটি একই সাথে শিশুদের ভেতর করোনা সচেতনতা ও মাস্কের ব্যবহার বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে। শ্যানা সম্প্রতি এই টেডিটি সরিয়ে নিয়েছেন। ভাইরাস তাঁকে শারীরিকভাবে সংক্রমিত না করতে পারলেও আহত করেছে মনকে, তাঁর আত্মবিশ্বাসকে। "আমরা তো একে স্প্রিন্টের সাথে তুলনা করেছিলাম, বুঝতে পারছি এটি এখন ম্যারাথনে রূপ নিয়েছে।'
সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস